আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। ভদ্রমহিলা বললেন, বয়সে অনেক ছোট তুমি। তুমি করে বলছি বলে আবার রাগ করছ না তো?
জি না।
তুমি আজ রাতে ন’টার দিকে একবার আসবে? শেলীর বাবা বাসায় থাকবেন তখন। আসতে পারবে?
যদি বলেন আসতে আসব।
হ্যাঁ। আসবে তুমি। আমি বরংচ গাড়ি পাঠাব।
গাড়ি পাঠাতে হবে না। আমি আসব।
আর শোন, শেলীর চিঠিটা থাকুক আমার কাছে।
সমস্ত দিন কাটল এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে। একি কাণ্ড করল শেলী? কেন করল? বোধহয় কিছু না ভেবেই করেছে। সারা দুপুর শুয়ে রইলাম। কিছুই ভাল লাগছে না। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। এর মধ্যে করিম সাহেব এসে খ্যান খ্যান শুরু করেছেন। তার বক্তব্য –সফিক কোন সাহসে তাকে চায়ের দোকানে যোগ দিতে বলল। চাকুরি নাই বলেই রিকশাওয়ালাদের জন্যে চা বানাতে হবে? সফিক ভেবেছেটা কী? মান-সম্মান বলে একটা জিনিস আছে ইত্যাদি। আমার বিরক্তির সীমা রইল না। করিম সাহেব বক বক করতেই লাগলেন, আমার দাদার বাবা ছিলেন জমিদার বুঝলেন? তিনটা হাতী ছিল আমাদের। জুতা হাতে নিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে কেউ হাঁটতে পারত না। জুতা বগলে নিতে হত। আমাদের বসত বাড়ির ইট বিক্রি করলেও লাখ দুই লাখ টাকা হয় বুঝলেন?
সফিক আসলো সন্ধ্যাবেলা। অতিব্যস্ত সে। এসেই এক ধমক লাগাল, সন্ধ্যাবেলা শুয়ে আছিস। কাপড় পর। নীলগঞ্জ হোটেল এ্যান্ড রেস্টুরেন্ট দেখিয়ে আনি।
আরেক দিন দেখব। আজ কাজ আছে এক জায়গায়। নটার সময় যেতে হবে।
নটা বাজতে দেরি আছে। উঠ দেখি। করিম সাহেব। আপনিও চলেন দেখি। সবাই মিলে রেস্টুরেন্টটা দাঁড় করিয়ে দেই।
করিম সাহেব মুখ লম্বা করে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
সফিক হাসি মুখে বলল, ঘর ভাড়া নিয়ে নিয়েছি। সাইন বোর্ড। আজ সকালে টাঙ্গিয়ে দিয়ে আসলাম। জিনিসপত্তর কেনাকাটা বাকি আছে। লালুকে সাথে নিয়ে সেই সব কিনব, এক্সপার্ট আদমি সে।
সফিকের উৎসাহের সীমা নেই। আমি শুনছি কী শুনছি না। সেই দিকেও খেয়াল নেই। নিজের মনেই কথা বলে যাচ্ছে, ঘরের মধ্যে পার্টিসন দিয়ে থাকার জায়গা করেছি। দিব্যি পড়াশুনা করতে পারবি তুই। ইলেকট্রিসিটি আছে, অসুবিধা কিছু নাই। তুই আর করিম সাহেব তোরা দুইজন কাল পরশুর মধ্যে চলে আয়।
করিম সাহেব?
হ্যাঁ ও আর যাবে কোথায়? পঞ্চাশ বৎসর বয়সে কী আর নতুন করে চাকরি করা যায়? দুই একদিন গাই গুই করবে তারপর দেখবি ঠিকই লেগে পড়েছে হা হা হা।
ঘরের সামনে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। নড়বড়ে একটা ঘর কোনো মতে দাঁড়িয়ে আছে।
এই তোর ঘর?
তুই কী ভেবেছিলি? একটা সাত মহল রাজপ্রাসাদ?
কে আসবে তোর এখানে চা খেতে?
আসবে না কেন সেইটা শুনি আগে?
একটা ছেলে এসে ঘরের তালা খুলে দিল। সফিক হৃষ্ট চিত্তে বলল, এর নাম কালু। দারুণ কাজের ছেলে।
কি রে ব্যাটা আছিস কেমন?
বালা আছি স্যার।
আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম সব। সারি সারি বেঞ্চ পাতা। ফাঁকে ফাঁকে আবার টুল কাঠের চেয়ার। মেঝেতে ইদুর কিংবা সাপের গর্ত। দরমার বেড়ায় এক চিলতে জায়গা আবার আলাদা করা। তার মধ্যে গাদাগাদি করে রাখা দুটি জরাজীর্ণ চৌকি।
সফিক বলল, কি রে পছন্দ হয়েছে?
আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম, ভালই তো।
বুঝতে পারছি তোর পছন্দ হয়নি। দেখবি সব হবে। আমি না খেয়ে দিন কাটিয়েছি। রাস্তায় রাস্তায় সুচ পর্যন্ত বিক্রি করেছি। আমি, কী ভেবেছিস ছেড়ে দিব? আয় চা খাই।
কোথায় চা খাবি?
পাশেই চায়ের দোকান আছে একটা।
চায়ের দোকানের মালিক সফিককে দেখে। গম্ভীর হয়ে গেল।
সফিক হাসিমুখে বলল,
ভাল আছেন নাকি রহমান সাব?
ভাল আর কেমনে থাকুম কন। আমার দোকানের পিছে দোকান দিছেন, ভাল থাকন যায়?
এই তো ভালরে ভাই কম্পিটিশন হবে। যেটা ভাল সেটা টিকবে।
সফিক ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। হাসি থামিয়ে বলল, রহমান সাব সব বি. এ. এম. এ পাস ছেলেরা কাজ করবে আমার দোকানে। এই দেখেন একজন বি. এ.পাস।
রহমান সাহেব সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। সফিক গম্ভীর হয়ে বলল, আর আমাদের ম্যানেজার কে জানেন নাকি? নিশানাথ জ্যোতির্ষিণব। জ্যোতিষ সাগর। বুঝেন কাণ্ড ইয়া দাড়িইয়া গোফ।
রহমান সাহেব নিস্পৃহ সুরে বললেন, ভদ্রলোক আপনেরা সাবধানে থাকবেন। পাড়াটা গুপ্ত বদমাইশের পাড়া। আমি থাকতে পারি না। আর আপনেরা নতুন মানুষ।
গুণ্ডা বদমাইশ কী করবে আমাদের? আমাদের ম্যানেজার সাক্ষাত দুর্বাষা মুণি। কাঁচা গিলে ফেলবে।
কাঁচা গিললে তো ভালই। আপনেরা চা খাইবেন? এই চা দে দেখি।
রহমান সাহেব গম্ভীর হয়ে বিড়ি ধরালেন। সফিক ফিসফিস করে বলল, ব্যাটা তখন থেকেই ভয় দেখাচ্ছে শুধু। একবার মিনো গুণ্ডাকে নিয়ে আসব। মিনো গুণ্ডাকে দেখলে রহমান সাহেবের দিল ঠাণ্ডা হয়ে যাবে দেখিস।
মিনোটা কে?
আছে আছে। আমার কাছেও জিনিসপত্র আছে। হা হা হা। মিনো গুণ্ডা আমার ছাত্র ছিল।
পান্থনিবাসে ফিরলাম রাত আটটার দিকে। বাড়ির সামনের জায়গাটা অন্ধকার। সেই অন্ধকারে ঘাপটি মেরে কে যেন বসে আছে। সফিক কড়া গলায় বলল, কে ওখানে কে?
কোনো সাড়া শব্দ নেই। আরেকটু এগিয়ে যেতেই বুকের মধ্যে কী ধরনের যেন অনুভূতি হল। দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে চেঁচালাম, কে কে?
আমি নিশানাথ।
আমরা অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলাম না। জগতে কত অদ্ভুত ঘটনাই না ঘটে। সফিক প্রথম বলল, ভাবলেশহীন গলা, এইখানে কী মনে করে নিশানাথ বাবু? কিছু ফেলে গিয়েছিলেন নাকি?