অঞ্জুর কাছে শুনলাম মা আজকাল কারো সঙ্গে কথাবার্তা বিশেষ বলেন না। আমার সঙ্গেও বললেন না। অভাবে অনটনে এরকম হয় নাকি মানুষ? আবেগ শূন্য কথাবার্তা। সেই চরম অভাব এখন তো আর নেই। এখন এরকম হবে কেন? বাবার ধারণা মায়ের সঙ্গে জীন থাকে। আমাকে একবার একা পেয়ে ফিসফিস করে বললেন, সব জীনের কাণ্ড কারখানা।
কিসের কাণ্ড কারখানা?
জীনের। তোর মাকে জীন ধরেছে।
কী যে বলেন। আপনি!
বাবার পাগলামী মনে হল সেরে গেছে। সহজ স্বাভাবিক কথাবার্তা। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবার কথা জিজ্ঞেস করলেন,
সফিক কেমন আছে? রেবাকে বিয়ে করেছে নাকি? আহা কেন করল না। নিশানাথ কই? সন্ন্যাসী হয়ে গেছে? আহারে বড় ভাল মানুষ ছিল! সন্ন্যাসী তো হবেই। ভালো মানুষ সংসারে থাকতে পারে?
অঞ্জকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবার বেহালাব সখা মিটে গেছে নাকি রে?
অঞ্জু লাফিয়ে উঠল, সবচে দারুণ খবরটা তোমাকে দেয়া হয়নি দাদা। বাবা চমৎকার বেহালা বাজায়। যা চমৎকার! যা চমৎকার!
সে কী?
হ্যাঁ দাদা, তুমি বিশ্বাস করবে না। কী চমৎকার! মা পর্যন্ত হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে থাকেন।
বেহালা কিনেছেন নাকি বাবা?
না হারু-গায়েনকে খবর দিলেই সে বেহালা দিয়ে যায়। তুমি আজ বল বাবাকে বাজাতে। সন্ধ্যার পর সবাই গোল হয়ে বসব। বেশ হবে দাদা। বলবে তো?
বাবাকে বেহালা বাজানোর কথা বলতেই তিনি আঁৎকে উঠলেন, পূর্ণিমা আজকে। পূর্ণিমার সময় বেহালা বাজালে পরী নামে এটাও জানিস না, গাধা নাকি? পরীক্ষণেই গলার স্বর নামিয়ে বললেন, তুই তো বিশ্বাস করলি না। যখন বললাম তোর মার সঙ্গে জীন আছে। জীন আছে বলেই তো যখন বাজাই তখন এমন করে তাকায় আমার দিকে–ভয়ে আমার বুক কাঁপে। এই দেখ হাতের লোম খাড়া হয়ে গেছে।
ঢাকায় ফিরে আসার দিন মা আমাকে একশ টাকার একটি নোট দিয়ে বললেন, তুমি যে টাকা পাঠিয়েছিলে সেই টাকা; সাথে নিয়ে যাও; ফেরিওয়ালা হবার দরকার নেই। যখন টাকার দরকার হবে লিখবো।
আমার চোখে পানি এসে গেল। মা এরকম হয়ে গেলেন কী করে? দু’দিন ছিলাম। এর মধ্যে একবার মাত্র তিনি আগের মত সহজ স্বাভাবিক ভাবে কথা বললেন। আগের মত নরম স্বরের মিষ্টি কথা, তোর বাবার বেহালা শুনে যা। মানুষের মধ্যে যে কী গুণ আছে তা বোঝা বড় কষ্ট। এখন বড় আফসোস হয়। কে জানে তাঁর এই আফসোস কী জন্যে?
বাবার কাছে যখন বিদায় নিতে গেলাম। তিনি যেন কেমন কেমন ভঙ্গিতে তাকালেন। যেন আমাকে চিনতে পারছেন না। খানিকক্ষণ পর গম্ভীর হয়ে বললেন, চলে যাবেন যে চা, টা খেয়েছেন? চা না খেয়ে যাবেন না যেন। অঞ্জু খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, আপনি আপনি করছে কেন বাবা?
চিনতে পারছ না?
বাবা রাগী গলায় বললেন, হাসিস না। শুধু শুধু, চিনিব না কেন? না চেনার কী আছে?
বাবা ঘোর লাগা চোখে তাকালেন। আমার বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। সত্যি তাহলে আমাকে চিনতে পারছেন না। অঞ্জু বলল, তুমি মনে হয় ঘাবড়ে গেছ দাদা। মাঝে মাঝে বাবার এরকম হয়। কাউকে চিনতে পারেন না। আবার ঠিক হয়ে যায়।
ঢাকায় এসে দুটি চিঠি পেলাম। একটি পারুলোব। পারুলের চিঠিতে একটা দারুণ মজার খবর আছে। তার জমজ মেয়ে হয়েছে। পারুলের সব কাণ্ড কারখানাই অদ্ভুত। দ্বিতীয় চিঠিটি লিখেছে শেলী। তিন লাইনের চিঠি।
পরম শ্রদ্ধেয় স্যার,
আমার সালাম জানবেন। মা আপনাকে চিঠি লিখতে বললেন। আপনি তার সঙ্গে দেখা করবেন। আপনি আর আসেন না কেন?
বিনীতা
শেলী
এত বড় বাড়ি খাঁ খাঁ করছে
এত বড় বাড়ি খাঁ খাঁ করছে।
কেউ কোথাও নেই। গেটের পাশে দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকত আজ সেও নেই। দরজার সামনে ভাৱী পর্দা দুলছে। পর্দা টেনে ভেতরে ঢুকতে সংকোচ লাগলো। কে জানে হয়তো শেলীর মা ভেতরে বসে আছেন। তিনি কখনো আসেন না। আমার সামনে। হয়ত বিরক্ত হবেন। হয়ত লজ্জা পাবেন।
বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলাম। এগারোটা বাজাব ঘণ্টা দিচ্ছে। এদের বসবার ঘরে অদ্ভুত একটা দেয়াল ঘড়ি আছে। বাজনার মত শব্দে ঘণ্টা বাজে।
কাকে চান?
আমি চমকে দেখি চশমা পড়া একজন মহিলা পর্দা সরিয়ে উঁকি দিচ্ছেন। আমি ইতস্তত করতে লাগলাম; কে জানে ইনিই হয়তো শেলীর মা। থেমে থেমে বললাম, আমি শেলীর মাস্টার।
হ্যাঁ আমি চিনতে পারছি। কী ব্যাপার?
আমাকে আসতে বলেছিলেন।
কে আসতে বলেছিলেন?
শেলীর মা আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন।
ভদ্রমহিলার ভ্রূ কুঞ্চিত হল। অবাক হয়ে তাকালেন।
আমি, আমি খবর দিয়েছিলাম? কেন, আমি খবর দেব কেন? ঘাম বেরিয়ে গেল আমার। পিপাসা বোধ হল। শেলীর মা শান্ত স্বরে বললেন, ঘরে এসে বসুন। কেউ নেই আজকে। শেলী তার ফুপার বাসায় গেছে। ফিরতে রাত হবে। আচ্ছা খবর দিয়েছে কে?
আমি ঘামতে ঘামতে বললাম, তাহলে হয়ত ভুল হয়েছে আমার। আচ্ছা আমি তাহলে যাই।
না না চা খেয়ে যাবেন। চা দিতে বলছি। খবর কে দিয়েছে আপনাকে?
আমি শুকনো গলায় বললাম, শেলী চিঠি দিয়েছিল।
ও তাই। আছে চিঠিটা? দেখি একটু।
শেলীর মা ভ্রূ কুঁচকে সে চিঠি পড়লেন। বন্ধ করে খামে ভরলেন আবার খুলে পড়লেন। আমার মনে হল তাঁর ঠোঁটের কোণায় একটু যেন হাসির আভাস।
চা আসতে দেরি হল না। চায়ের সঙ্গে দুটি সন্দেশ। ঝাক ঝাঁকে রুপোর গ্লাসে বরফ মেশানো ঠাণ্ডা পানি। ভদ্রমহিলা খুব কৌতূহলী হয়ে আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছেন। এক সময় যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এই ভঙ্গিতে বললেন, হ্যাঁ একবার অবিশ্য বলেছিলাম শেলীকে তোমাকে এখানে আসবার কথা লিখতে! তেমন কোনো কারণে নয়।