এক সময় সফিক বিরক্ত হয়ে বলল,
ঘুমাতে যান করিম সাহেব।
কেন? তোমার হুঁকুম নাকি? আমি কী তোমার হুঁকুমের গোলাম?
চুপ করেন করিম সাহেব।
তুই চুপ কর শালা।
সফিক আর কথা বাড়াল না। আমার অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসল না। এপাশ ও পাশ করতে লাগলাম। বুঝতে পারছি সফিকও জেগে আছে। সফিক একবার ডাকল, জেগে আছিস নাকি রঞ্জু?
আমি জবাব দিলাম না। বাইরে করিম সাহেবেরও আর কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। সফিক এক সময় মশারির ভেতরেই একটা সিগারেট ধরিয়ে খিক খ্যক করে কাশতে লাগল। অন্ধকার ঘরে একটা লাল ফুলকি উঠানামা করছে। দেখতে দেখতে ঘুম এসে গেল।
ঘুম ভাঙলো শেষ রাত্রে। ঘরের দরজা হাট করে খোলা। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। বৃষ্টির ছাটে বিছানা ভিজে একাকার। আমি ডাকলাম, সফিক এই সফিক।
কোন উত্তর নাই। বাইরে বেরিয়ে দেখি সে সিগারেট হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে বসে বৃষ্টিতে ভিজছে। আমাকে আসতে দেখে ক্লান্ত স্বরে বলল, ঘুম আসেছে নারে।
বৃষ্টিতে ভিজছিস তো।
সফিক একটু সরে বলল, জ্যোতির্ষাণবের জন্যে খারাপ লাগছে। বেশ খাবাপ লাগছে। সকাল হলেই খুঁজতে বের হব। ঢাকাতেই আছে নিশ্চয়ই।
সফিক খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, অনু মারা গেছে। গত পরশু চিঠি পেয়েছি। একটা টেলিগ্রাম করার দরকার মনে করে নাই।
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
তুই তো আমাকে কিছু বলিস নাই সফিক।
এই সব বলতে ভাল লাগে না।
কি ভাবে মারা গেল?
সাপে কেটেছিল। তাই লেখা। ওঝা টঝা নাকি এসেছিল। আমি সফিকের হাত ধরালাম। আশ্চর্য জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। অথচ সহজ স্বাভাবিক মানুষের মত বসে আছে।
তোর তো ভয়ানক জ্বর সফিক।
হ্যাঁ শরীরটা খাবাপ।
আয় শুযে থাকবি? মাথায় জল পট্টি দেব?
নাহ এইসব কিছু লাগবে না। আমার ভালুক জ্বর; সকালবেলা থাকবে না দেখবি।
জ্যোতির্ষিণবকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
সম্ভব অসম্ভব সব জায়গায় খোজা হয়। ছিন্ন মুল মানুষেবা যে সব জায়গায় রাতে ঘুমায়, সফিক গভীর বাতে সেই সব জায়গায় খুঁজতে যায়। কমলাপুব বেল স্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল লাভ হয় না। কিছু। ফুটপাতে যে সব পামিস্টরা হাতেব ছবি আঁকা সাইন বোর্ড টানিয়ে বসে থাকে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়, লম্বা চুল দাড়ির এক সাধু— হাত দেখেন, তাকে কেউ দেখেছেন? নিশানাথ নাম।
কেউ কিছু বলতে পারে না। নবী সাহেবের কথামত পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয় :
লম্বা চুল দাড়ি পরনে গেরুয়া রঙ্গের পাঞ্জাবি প্রখ্যাত জ্যোতিষ নিশানাথ জ্যোতির্ষিণবের সন্ধান প্রার্থী।
বিজ্ঞাপন ছাপার তিন দিনের দিন হন্তদন্ত হয়ে হাজির হয় আভা। আপনাদের জ্যোতিষী কোথায় গেছে?
সফিক বিরক্ত হয়ে বলে, কোথায় গেছে জানলে বিজ্ঞাপন দেই নাকি?
আমি ভাবলাম আপনাদের কোন পা্বলিসিটির ব্যাপার বুঝি।
তার পাবলিসিটি লাগে না। সে অনেক বড় দরের জ্যোতিষ।
আভা শান্ত স্বরে বলে, তিনি বড় জ্যোতিষী ছিলেন। আমার হাত দেখে জন্মবার বলে দিয়েছিলেন। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম।
শুধু নিশানাথ নয়। নবী সাহেবও পান্থ নিবাস ছেড়ে চলে গেলেন। স্কুল থেকে মহাসমারোহে তাকে বিদায় দেয়া হয়েছে। আমরাও তার বিদায় উপলক্ষে একটু বিশেষ খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করেছিলাম। খেতে পারলেন না। মুখে নাকি কিছুই রুচছে না। খাওয়া বন্ধ করে একবার ফিসফিস করে বললেন, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। পান্থ নিবাসে শিকড় গজিয়ে গেছে। বলতে বলতে তার চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগল।
সিরাজ সাহেবের প্রমোশন হয়েছে। অফির্সাস গ্রেড পেয়েছেন। অফিস থেকে তাকে কোয়ার্টার দেয়া হয়েছে। সুন্দর কোয়ার্টার। তাঁর সঙ্গে একদিন গিয়ে দেখে আসলাম। দক্ষিণ দিকে চমৎকার বারান্দা। হুঁ হুঁ করে হাওয়া বয়। সিরাজ সাহেবও পান্থনিবাস ছেড়ে চলে গেলেন। যাবার আগের দিন রাতে বিদায় নিতে এলেন আমাদের কাছ থেকে। কথা সরে না। তাঁর মুখে। অনেকক্ষণ বসে রইলেন চুপ চাপ। এক সময় বললেন, সুখেই ছিলাম ভাই আপনাদের সাথে। আনন্দেই ছিলাম। নিশানাথ বাবুর খালি ঘরটা দেখলে চোখে পানি আসে। আমার স্ত্রীকে তিনি বড় স্নেহ করতেন।
সত্যি সত্যি চোখে পানি ছলছলিয়ে উঠল। সফিক শুয়ে ছিল। সফিকের মাথায় হাত রেখে বললেন, জ্বর কী আবার এসেছে?
আছে অল্প।
অবহেলা করবেন না ভাই। ভাল ডাক্তার দেখাবেন।
ক্ষণিকক্ষণ চুপ থেকে আমতা আমতা করে বললেন, আমি অতি দরিদ্র মানুষ তবু যদি কখনো কোন প্রয়োজন হয়…
সফিক কথার মাঝখানে আমাচকা জিজ্ঞেস করল, আপনার ছোট বোন রেবা, তার কী বিয়ে হয়েছে?
হ্যাঁ গত বৈশাখ মাসে বিয়ে দিয়েছি। ঢাকাতেই থাকে। ভাল বিয়ে হয়েছে। ছেলেটা অতি ভাল। আমি ভাবি নাই এত ভাল বিয়ে দিতে পারব।
সফিক আর কিছু বলল না। সিরাজ সাহেব বললেন, আপনারা দু’জন একদিন গিয়ে যদি দেখে আসেন সে খুব খুশি হবে। আপনাদেবকে চিনে খুব। সেই দিনও জিজ্ঞেস করল। আপনার অসুখের কথা।
নতুন কোন বোর্ডার এল না পান্থনিবাসে। শুনেছি। রশীদ মিয়া মেস ভেঙে বাড়ি বানিয়ে ভাড়া দেবেন। মেসে নাকি তেমন আয় হয় না। এর মধ্যে মার চিঠি পেলাম :
তোমার পাঠানো একশত টাকা পাইয়াছি। আমি শুনিয়া মর্মাহত হইলাম যে তুমি পড়াশুনা ছাড়িয়া কাপড় ফেরি করিয়া বেড়াও। তোমার দুই মামা অত্যন্ত বিরক্ত হইয়াছেন। তোমাব মনে রাখা উচিত তোমার নানা অত্যন্ত বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। তুমি ছোটলোকের মত ফেরিওয়ালা হইয়াছ এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি। পারুলের মত তুমিও যে বংশের মান ডুবাইবে তাহা ভাবি নাই। দোয়া জানিও। অতি অবশ্য একবার আসিবে। তোমার বাবার একটি পা অচল। হাঁটা চলা করিতে পারে না…