কিসের কী ব্যাপার?
সাধুজী কোথায়?
চলে গেছে।
কোথায় চলে গেছে?
আমি কি জানি কোথায় গেছে। আমাকে জিজ্ঞেস করেন কেন?
কখন গেছেন?
দুপুরে।
হঠাৎ চলে গেলেন যে?
কী মুশিবত আমি তার কী জানি। যেতে চাইলে আমি ধরে রাখব নাকি? শ্বশুর বাড়ি এইটা?
আমি বেশ অবাক হলাম। নিশানাথ বাবু কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ করে চলে যাবেন এটা ভাবা যায় না। তা ছাড়া তার যাওয়ার কোনো জায়গাও সম্ভবত নেই। কে জানে হয়ত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিংবা হয়ত চায়ের দোকানে বসে আছে একা একা। আমি কাপড় না ছেড়েই চায়ের দোকানে চলে গেলাম। না সেখানে সাধুজী যাননি। রাস্তার মোড়ে যে ছেলেটি পান সিগারেট বিক্রি করে সে বলল–সাধুজী সুটকেস হাতে নিয়ে উত্তর দিকে গেছেন। তার দোকান থেকে দুপ্যাকেট স্টার সিগারেট কিনেছেন।
মেসে ফিরে যেতেই নয়। নম্বরের ছেলেটির সঙ্গে দেখা হল। এই ছেলেটি এক পত্রিকার অফিসে কাজ করে। তার সব সময় নাইট ডিউটি। সারাদিন দরজা বন্ধ করে ঘুমায়, কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলে না। মেসে সে খায় না। ছুটি-ছাঁটার দিন তার কেরোসিন চুলায় নিজেই দেখি রান্না করে। আমাকে দেখেই ছেলেটি বলল, সফিক সাহেব কখন ফিরবেন?
জানি না কখন।
সফিক সাহেবের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
কী ব্যাপার?
ছেলেটি আড় চোখে রশীদ মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, আসেন আমার ঘরে বসি। আপনি তো আসেন নাই কখনো। আমি নিজেই অবশ্যি কাউকে বলি না। আমার একা একা থাকতে ভাল লাগে। সিঙ্গেল রুম নিয়েছি। এই জন্যে।
তার ঘর নবী সাহেবের ঘরের মতো গোছানো। দেখেই মনে হয় নারীর স্পর্শ আছে। দেয়ালে আবার নীলরঙ্গা একটি তৈলচিত্র। জ্যোৎস্না রাত্রির ছবি। অসম্ভব সুন্দর এই ছবিটি ঘরের চেহারা পাল্টে ফেলেছে। তাকালেই মন বিষগ্ন হয়।
আমার ছোট ভাইয়ের আঁকা। আর্ট কলেজে পড়ে ফোর্থ ইয়ার। আপনি কী চা খাবেন? চায়ের ব্যবস্থা আছে।
না চা খাব না। আমি, ভাত খাই নাই এখনো। আপনি কী জন্যে ডাকছিলেন।
ছেলেটি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
সাধুজী আজ দুপুরে আমার কাছে একটি ঘড়ি রেখে গেছেন। সফিক সাহেবকে দেয়ার জন্যে। খুব দামী ঘড়ি।
আমি চুপ করে রইলাম। ছেলেটি বলল,
তিনি যাওয়ার সময় কাদছিলেন। আমার এমন খারাপ লাগল বুঝলেন। বিকালে এক জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল, যাই নাই দরজা বন্ধ করে বসেছিলাম।
আমি বললাম, আপনার নাম আমি জানি না। কী নাম ভাই?
সুলতান। সুলতান উদ্দিন। সাধুজী ছাড়া কেউ আমার নাম জানে না। কারো কাছে যাইনা তো। সাধুজীর কাছে একবার গিয়েছিলাম। মনটা খুব খারাপ সেই সময়। হঠাৎ গেলাম। তিনি অনেক কথা বললেন এখনো মনে আছে।
কী বললেন?
এই সান্ত্রনার কথা আর কি! অন্য রকম করে বললেন। সান্ধনার কথা বলা তো খুব কঠিন। সবাই বলতে পারে না। খুব হৃদয়বান মানুষ লাগে।
আমি অনেকক্ষণ বসে রইলাম তার ঘরে। কথাবার্তা না–চুপচাপ বসে থাকা। ছেলেটি একেবারেই কথাবার্তা বলে না যতবার বললাম, উঠি? ততবারই বলে, বসেন না। আরেকটু বসেন। সফিক সাহেব আসলে যাবেন। রাত এগারোটা পর্যন্ত সফিকের জন্যে অপেক্ষা করে খেতে গোলাম; এত রাত পর্যন্ত কাদের থাকে না। টেবিলে ভাত তরকারী ঢেকে রেখে ঘুমাতে যায়। কিন্তু আজ দেখি জেগে আছে। ভাত তরকারী বাড়তে বাড়ষ্ণুপ্রিশ্ন করে বলল, হুঁনছেন সারা করিম সার মাল খাইছে আইজ।
কী বললি?
মাথা ফট্টি নাইন। বমি কইরা ঘর ভাসাইয়া দিছে। আমারে সাফ করতে কয়। আমি কইছি মাল খাওয়া বমি আমি সাফ করি না। ভদ্রলোকের ছেলে আমি কী কন্ন স্যাব? অন্যায়। কইলাম।
উপরে উঠেই করিম সাহেবের সঙ্গে দেখা। বারান্দায় রাখা চৌকিবা উপর লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন। আমাকে দেখেই মাথা তুলে বললেন, সাধুজী চলে গেছে শুনেছেন? শালা রশীদ মিয়ার পেটে আমি একটা তিন নম্ববী চাকু যদি না ঢুকাই তাহলে আমি বেজন্ম কুত্তা। শালার মাকে আমি…
করিম সাহেব অনর্গল কুৎসিত কথা বলতে লাগলেন। তারপর এক সময হাড় হড় কবে বমি করে ফেললেন।
আপনার কী শরীর খারাপ করিম সাহেব?
না শরীর ঠিকই আছে। শালার সস্তার তিন অবস্থা। সস্তা জিনিস খেয়ে এখন মরণ দশা। ছয় টাকা করে বোতল বুঝলেন? বলতে বলতে আবার বমি।
সফিক আসল বারোটার দিকে। নিশানাথ বাবু চলে গেছেন এই খবরে তার কোনো ভাবান্তব হল না। ভেলভেটের বাক্সে মোড়া ঘড়ি ফেলে রাখল টেবিলের এক কোণায়। তার ভাবভঙ্গি এ রকম যেন নিশানাথ বাবুর ঘর ছেড়ে যাওয়া তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না। বোজই এবকম হয়। রাতে ঘুমতে যাবার সময় বলল, চায়ের দোকান স্টার্ট দিয়ে দিব এইবার। খোঁজখবব শুরু করেছি। দুহাজার টাকা সেলামী দিলে শ্যামলীতে একটা ঘর পাওয়া যায়। ভাল ঘর; আভাকে বলব টাকাটা ধার দিতে।
দিবে সে?
দিবে নিশ্চয়ই। আর না দিলে কী আছে, ছোট করে শুরু করব। নবী সাহেবকে বলব কিছু দিতে।
নবী সাহেব অবশ্যি দিবেন।
সবাই দিবে। দেখিস না কী করি।
আমি বললাম, শুধু আমাদের ম্যানেজারই নেই। সফিক কোন উত্তর দিল না। বাতি নিবিয়ে মশারি ফেলে শুয়ে পড়ল। বাইবে করিম সাহেব মস মাস করে হাটতে লাগলেন। বমি টমি করলে শুনেছি মাতালদেব নেশা কেটে যায়। কিন্তু বাত যত গভীর হচ্ছে করিম সাহেবের নেশাও মনে হয় ততই গাঢ় হচ্ছে।
তিনি উঁচু গলায় বলছেন, ভয় পাওয়ার লোক না। আমি। কাউকে ভয় পাই না। লাথ দিলে সব ঠিক ঠাক। এমন লাথ ঝাড়ব পাছায় বাপের নাম ভুলিয়ে দিব।