কৈ মাছ খাওয়ার জন্য এত দূর যাবেন?
নারিকেলের চিড়া করে রাখবে। এখন না। যাই কী করে?
এইবার ফিরে এসে তিনি অত্যন্ত গম্ভীর মুখে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। যেন অত্যন্ত রহস্যময় একটি ব্যাপার তিনি জেনে ফেলেছেন। ব্যাপারটি দু’দিন পর আমরাও জানলাম। রাতের খাওয়ার পর বাবা আঠারো উনিশ বছরের একটি মেয়ের ছবি সফিকের টেবিলের উপর রেখে গম্ভীর হয়ে সফিকের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সফিক অবাক হয়ে বললো, এ ছবি কার? আর এই মেয়েটিই বা কে?
বাবা রহস্যময় হাসি হেসে বললেন, রেবার ছবি।
রেবা? রেবা কে?
যেই হোক তোমার পছন্দ হয়েছে তো?
সফিক এবং আমি দুজনেই মুখ চাওয়া চাওয়ি করি। বাবা নিজেই খোলসা করেন, রেবা হচ্ছে সিরাজ সাহেবের বোন। ওর সঙ্গেই তোমার বিয়ে ঠিক করে এসেছি। পাকা কথা দিয়ে ফেলেছি।
সফিকের চেয়ে বেশি হকচাকিয়ে যাই আমি। বাবার যে কি সব লোক হাসানো কাণ্ড কারখানা।
সফিক কিন্তু সহজ ভাবেই বলে, পাকা কথা দিয়ে ফেলেছেন চাচা?
হ্যাঁ তা বলতে গেলে দিয়েই ফেলেছি। তোমার বাবা বেঁচে নাই। আমাকেই তো দেখতে হবে সব। ঠিক কিনা তুমিই বল?
তা ঠিক।
বাবা মহা উৎসাহী হয়ে ওঠেন। হাসি হাসি মুখ। তোমাকেও ওদের খুব পছন্দ। সিরাজের বৌ এখানে এসে দেখে গেছে তোমাকে। বড় ভাল মেয়ে বড় ভাল। সফিক চুপ করে থাকে। বাবা উৎসাহ এবং উত্তেজনায় ছটফট করতে থাকেন।
তোমাদের বিয়ের পর আমি কিন্তু তোমাদের বাসাতেই থাকব। রেবাকেও বললাম এই কথা।
সফিক আঁতকে উঠে বলে, তাকেও বলেছেন এই কথা?
বলব না কেন? সংসারের মাথা তো মেয়েরাই হয়। হয় না?
তা হয়।
আমার ধারণা ছিল সফিক রেগে মেগে একটা কাণ্ড করবে। বাবাকে নিয়ে আমি মহা লজ্জায় পড়ব। সে রকম কিছু হল না। সে যেন লজ্জায় পড়েই উঠে গেল সামনে থেকে।
আমি পরের সপ্তাহেই বাবাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসলাম। ঢাকায় রেখে চিকিৎসাও কিছু হচ্ছে না। শুধু শুধু টাকা নষ্ট। মা একটির পর একটি উদ্বিগ্ন চিঠি পাঠাচ্ছেন। ট্রেন ছাড়বার আগে আগে দেখি সিরাজ, সাহেব আজীজ সাহেব। আর আমাদের জ্যোতির্ষিণর এসে হাজির। তারা বিদায় জানাতে এসেছেন। আজীজ সাহেবের হাতে আবার প্রকাণ্ড একটা খাবারের ঠোঙ্গা। ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবা ছেলে মানুষের মত ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। কী যে অস্বস্তিকব অবস্থা।
একশ টাকা মনি অর্ডার
মা’র নামে একশ টাকা মনি অর্ডার করে পাঠিয়ে দিলাম। আমার আর্থিক টানাটানি কিছু দূর হয়েছে। কলেজে বেতন মাফ হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যাবেলা একটা ভাল টিউশনি জোগাড় হয়েছে। ক্লাস নাইনের একটি মেয়েকে সপ্তাহে চার দিন পড়াই। মেয়েটি খুবই শান্ত স্বভাবের। বড়ই লাজুক। সারাক্ষণ মুখ নিচু করে পড়ে। যদি কিছু জিজ্ঞেস করি বইয়ের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়। মুখ তুলে তাকায় না। পড়ানো শেষ করে যখন যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াই তখন লাজুক মুখে বলে, স্যার একটু বসেন।
মেয়েটি দ্রুত চলে যায় ভেতরে; ফিরে আসে বরফ দেয়া এক গ্রাস পানি এবং ঝাক ঝাকে একটি কাচের বাটিতে কিছু খাবার নিয়ে। বিকালে আমার কিছুই খাওয়া হয় না। ক্ষিধায় নাড়ি মোচড় দিতে থাকে। লোভীর মত খাবারটা খাই। মেয়েটা নরম গলায় বলে, স্যার আরো খানিকটা আনি? আমার লজ্জা লাগে তবু অপেক্ষা করি খাবারের জন্যে। মাসের এক তারিখে মেয়েটি অতি সংকোচে টাকা দেয়। আমার হাতে। যেন স্যারকে টাকা দেয়াটা একটা লজার ব্যাপার। এত ভাল লাগে আমার। মাঝে মাঝে ছোটখাটো দু’একটা উপহার কিনে আনতে ইচ্ছা হয়। সাহস হয় না। হয়ত মেয়েটির মা কিছু মনে করবেন। মেয়ের মা কখনো আমার সামনে আসেন না। পর্দার আড়াল থেকে মাঝে মাঝে কথা বলেন, শেলী অংকে খুব কাঁচা। দেখবেন ভাল করে।
জি দেখব।
বাড়ির কাজ ঠিকমত করে না। ধমক দেবেন। আপনাকে ভাল মানুষ পেয়ে শুধু ফাঁকি দিচ্ছে বোধ হয়।
মেয়েটির বাবার সঙ্গে দেখা প্রায় হয় না বললেই হয়। তিনি সারাক্ষণ ব্যস্ত। যখন হঠাৎ এক আাধাদিন দেখা হয় তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, চিনতে পারলাম না তো। কে আপনি?
আমি সংকোচে বলি, আমি শেলীর মাস্টার।
তাই তো তাই তো। আমি গত সপ্তাহেই তো দেখলাম। একটুও মনে নাই। লজ্জার ব্যাপার।
ভদ্রলোক দারুণ ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, মাস্টার সাহেবকে চা দেয়া হয়েছে? আফজাল আফজাল।
চা খেয়েছি আমি। ভূতে কী আরেকবারর খাবেন। আপনি নিজেও তো ছাত্র?
শেলী বলেছে আমাকে। একটিই টিউশনি আপনার?
আমার দারুণ লজ্জা লাগে। কান টান লাল করে বলি, বিকালেও একটা টিউশনি আছে।
আমি নিজেও খুব কষ্ট করে পড়েছি। তিন চারটা টিউশনি করতাম। একটুও ভাল লাগত না। সারাক্ষণ ভাবতাম। কখন তারা চা টা খেতে দেবে। আপনাকে চা, টা ঠিকমত দেয় তো?
হা হা করে হাসতে লাগলেন ভদ্রলোক! হাসি থামতেই গম্ভীর হয়ে বললেন, এক বাড়িতে পড়াতাম একটা ছেলেকে। মহা মুর্খ। তিনবার ফেল করেছে মেট্রিক–দেখেন অবস্থা। একেক বার ফেল করত। আর ছেলের বাবা এসে আমাকে ধমক ধামাক।–কেন ফেল করল, কেন ফেল করল।
আমার মধ্যে এক ধরনের হীনমন্যতা বোধ আছে। সব সময় নিজেকে ছোট মনে হয়। কলেজে সংকোঁচে থাকি। একেক দিন সফিকের সঙ্গে তার কাটা কাপড়ের স্তুপের কাছে যেতে হয়। টাকা পয়সা গুণে গুণে রাখতে আমার কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করে। সব সময় মনে হয় এই বুঝি ক্লাসের কোন ছেলে বলে বসবে কে রঞ্জুনা? কিন্তু এই বাড়িতে এসে সেই ভাবটা আমার থাকে না। শেলী যেদিন জিজ্ঞেস করল, স্যার আপনি ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করেন?