কাজে লাগে না কেন?
এই সব কলকব্জার ঘড়িতে কী আমাদের হয়? আমাদের দরকার বালি ঘড়ি কিংবা সূর্যঘড়ি। সেই সব ঘড়িতে পল অনুপল এই সব হিসাবও সূক্ষ্ম ভাবে করা যায়। পল বুঝা তো? পল হচ্ছে এক দণ্ডের ষাট ভাগের এক ভাগ।
সফিক নিস্পৃহ ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে। জ্যোতির্ষিণব হাসি মুখে বলে চলেন– তাই ভাবলাম কাজে যখন লাগে না তখন আর ঘড়ি রেখে লাভ কী? রোজ চাবি দেয়া যন্ত্রণার এক শেষ। সফিক তুমি ঘড়িটা নিয়ে বিক্রি করে ফেল। সফিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।
বিক্রি করে ফেলব?
হ্যাঁ। সাধু সন্ন্যাসী মানুষ আমি, এই সব বিলাস সামগ্ৰী দুই চোখে দেখতে পারি না। তান্ত্রিক সাধনাতে মোহ মুক্তির প্রয়োজন সবচে বেশি। তোমরা এই সব বুঝবে না। বিষয়ী লোকদের বোঝা খুব মুশকিল।
জ্যোতির্ষিণব পকেট থেকে ভেলভেটের বাক্সে সযত্নে রাখা হাত ঘড়িটি বের করে টেবিলে রেখেই দ্রুত চলে গেলেন। বেশ ভাল ঘড়ি সেটি। সফিক ঘড়ির বাক্স হাতে নিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, ব্যাটার তো খুবই খারাপ অবস্থা রঞ্জু। ঘড়িটা তার খুব সখের। সফিক চিন্তিত মুখে ঘড়ি হাতে বেরিয়ে গেল।
জ্যোতির্ষিণবের ভাগ্য বদলাল দুপুরের একটু পর। সম্ভবত মঙ্গল হোরায় প্রবেশ করেছে, রবির ক্ষেত্র আবার ঠিকঠাক হয়ে গেছে। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম প্রকাণ্ড একটি সাদা রঙের গাড়ি এসে থামল পান্থনিবাসের সামনে। গাঢ় নীল রঙ্গের শাড়ি পরা একটি মেয়ে সেই গাড়ি থেকে নেমে সোজা উঠে এসেছে পান্থনিবাসের দোতলায়। সাধুজী নিশানাথ জ্যোতির্ষিণবের খোঁজ করছে সেই মেয়ে। আমাদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। রশীদ মিয়া পর্যন্ত একবার উঁকি দিয়ে দেখে গেল। অনেকদিন পর জ্যোতির্ষিণবের ভারী গলা পাওয়া গেল, অতি সুলক্ষণা মেয়ে মা তুমি, অতি সুলক্ষণা। চন্দ্র ও রবির মিলিত প্রভাব, কেতুর মঙ্গলে অবস্থান। এরকম হয় না, খুব কম দেখা যায়। হুঁ হুঁ। বিদ্যা ও ধান। লক্ষ্মী-স্বরস্বতী এক মালায় গাঁথা। বড় ভাগ্যবতী তুমি।
যাবার সময় সেই মেয়ে একশ টাকার দুটি নোট দিয়ে জ্যোতির্ষাণবের কণ্ঠরোধ করে দিল। নিশানাথ বাবু দুমাসের সিট রেন্ট মিটিয়ে দিলেন। সন্ধ্যাবেলা আমাকে সঙ্গে নিয়ে ধূপ কিনে আনলেন। অনেক দিন পর তাঁর ঘরে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বললো, ধূপ পুড়তে লাগল। করিম সাহেব একবার অবাক হয়ে বললেন, এককথায় দুশো টাকা দিয়ে দিল। পাগল নাকি মেয়েটা?
নিশানাথ গম্ভীর হয়ে বললেন, দুশো টাকা খুব বেশি লাগল। আপনার কাছে? হাজার টাকা নিয়েও মানুষ একদিন আমাদের সাধা সাধি করেছে। টাকা অতি তুচ্ছ জিনিস মশাই আমাদের কাছে।
অনেক দিন পর জ্যোতির্ষিণব মেসের এক তলায় সবার সঙ্গে খেতে গেলেন। মাছের তরকারীতে নুন কম হয়েছে কেন তাই নিয়ে তুমুল ঝগড়া শুরু করলেন কাদেরের সঙ্গে।
সফিক সন্ধ্যাবেলা এসে জিজ্ঞেস করল, আভাকে আসতে বলেছিলাম–এসেছিল?
আমি অবাক হয়ে বললাম, আভা কে?
ঐ যে মেয়েটির কথা বলেছিলাম, চাকরি দিয়েছিল আমাকে। আসে নাই?
এসেছিল।
বলেছিলাম আজকেই আসতে। টাকা পয়সা কত দিয়েছে জানিস নাকি? একশো টাকা দিতে বলেছিলাম।
দুশো টাকা দিয়েছে।
মেয়েটার নজর খুব উঁচু। সাধু ব্যাটা কিছু বুঝতে পারে নাই নিশ্চয়ই।
আমি কিছু বললাম না। সফিক হাসি মুখে বলল, যাক ঘড়িটি বিক্রি করতে হয় নাই। নিশানাথের খুব সখের ঘড়ি। সফিক ঘড়ি ফিরিয়ে দিতে গিয়ে প্রচণ্ড ঝগড়া বাঁধিয়ে বসল। অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া। নিশানাথ বাবু সফিককে হাসতে হাসতে বলছেন, আমার কেতু এবং মঙ্গলের যে দোষটা ছিল সেটা কেটে গেছে। সফিক। হুঁড় হুঁড় করে টাকা আসা শুরু হয়েছে। তোমার দরকার হলে বলবে লজ্জার কিছু নাই।
সফিক বলেছে, এইসব ধান্ধাবাজী এখন ছাড়েন নিশানাথ বাবু। অনেক তো করলেন।
নিশানাথ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, পুত্রবৎ জ্ঞান করি তোমাকে আর তোমার মুখে এত বড় কথা। রাগের মাথায় ব্রহ্মশাপ দিয়ে ফেলব সফিক।
এ আমার দুর্বাশা মুণি! ব্রহ্মশাপ দেবেন।
খবরদার বলছি। জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাবে।
হাতাহাতি হয়ে যাবার মত অবস্থা।
গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙে শুনি চুক চুক শব্দ হচ্ছে। অন্ধকারে বসে তিনমূর্তি চা খাচ্ছে। সফিক, জ্যোতির্ষিণব আর আমার বাবা। ফিসফিস করে তাদের কি সব কথাবার্তাও হচ্ছে। বাবা এখানেই আছেন, কিছুতেই ফিরে যেতে চাচ্ছেন না। রাত্রে জ্যোতির্ষাণবের ঘরে গিয়ে ঘুমান। দিনের বেলাটা কাটান সফিকের ঘরে। আমি দেশে ফেরানোর কথা বলে বলে হার মেনেছি। সফিক অবিশ্য বলছে, থাকুক না। তিনি। মেডিকেলে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থাটা করি আগে।
মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ডাক্তাররা অনেক কথাবার্তা বলেও কোনো অসুখ-বিসুখ ধরতে পারলেন না। রাগী চেহারার একজন বুড়ো মত ডাক্তার শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন,
অসুবিধাটা কি আপনার বুঝতে পারছিনা তো।
বাবা বললেন, অসুবিধা তো কিছু নাই ডাক্তার সাহেব।
রাত্রে ঘুম হয়?
ঘুম হবে না কেন?
বাবা মহাসুখেই আছেন। পান্থ নিবাসের সবার সঙ্গেই তার খাতির। আজীজ সাহেব সকাল বেলা ব্যায়াম করেন। তিনি বসে থাকেন পাশে। আমাকে প্রায়ই বলেন, রঞ্জু স্বাস্থ্য হচ্ছে সমস্ত সুখের মূল। স্বাস্থ্যটা ঠিক রাখা দরকার। তুই বেলের শরবত খাবি। খুব উপকারী। আজীজ বলেছে আমাকে।
বাবার সবচেয়ে বেশি খাতির সিরাজ সাহেবের সঙ্গে। সিরাজ সাহেব কোনো এক বিচিত্র কারণে বাবাকে পছন্দ করেন। অফিস থেকে এসেই তিনি বাবাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে যাবেন। তারপর দরজা বন্ধ করে গুজ গুজি করে আলাপ। এক শনিবারে বাবা সিরাজ সাহেবের সঙ্গে তার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলেন। আমি কিছু বললাম না। পরের শনিবারে দেখি আবার যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন। আমার বিরক্তির সীমা রইল না। বাবা শান্ত স্বরে বললেন, আমার জন্যে বৌটা কৈ মাছ জোগাড় করে রাখবে বলেছে।–না গেলে কেমন করে হয়?