- বইয়ের নামঃ অন্যদিন
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্বেষা প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
পান্থনিবাস বোর্ডিং হাউস
পান্থনিবাস বোর্ডিং হাউস
১১-বি কাঁঠাল বাগান লেন (দোতালা)
ঢাকা-৯
চিঠি লিখলে এই ঠিকানায় চিঠি আসে। খুঁজে বের করতে গেলেই মুশকিল। সফিক লিখেছিল অবশ্যি, তোর কষ্ট হবে খুঁজে পেতে। লোকজনদের জিজ্ঞেস কবতে পারিস কিন্তু লাভ হবে বলে মনে হয় না। একটা ম্যাপ একে দিলে ভাল হত। তা দিলাম না, দুর্লভ জিনিস পেতে কষ্ট করতেই হয়।
এই সেই দুর্লভ জিনিস? দু’জন মানুষ পাশাপাশি চলতে পারে না। এরকম একটা গলির পাশে ঘুপসি ধরনের দোতলা বাড়ি। কত দিনের পুরনো বাড়ি সেটি কে জানে। চিতি পরে সমস্ত বাড়ি কালচে সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে। দোতলায় একটি ভাঙা জানালায় ছেড়া চট ঝুলছে। বাড়িটির ডান পাশের দেয়ালের একটি অংশ সম্পূর্ণ ধসে গিয়েছে। সামনের নর্দমায় একটি মরা বেড়াল; দূষিত গন্ধ আসছে সেখান থেকে। মন ভেঙে গেল আমার। সুটকেস হাতে এদকি-ওদিক তাকাচ্ছি— দোতলায় যাবার পথ খুঁজছি, সিঁড়ি-ফিড়ি কিছুই দেখছি না। নিচ তলা তালাবন্ধ। নোটিশ ঝুলছে—
‘এই দোকান ভাড়া দেওয়া হবে।’
দোতলার জানালার চটের পর্দার ফাক দিয়ে কে যেন দেখছিল আমাকে। তার দিকে চোখ পরতেই সে বলল, জ্যোতিষী খুঁজছেন? হাত দেখবেন? উপরে যান, বাড়ির পেছন দিকে সিঁড়ি।
পান্থনিবাস বোর্ডিং হাউসের লোকজন আমার চেনা। সফিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লিখেছে আমাকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠবার মুখে যার সঙ্গে দেখা হল তিনি যে নিশানাথ জ্যোতিষণিব তা সফিকের চিঠি ছাড়াও বলে দিতে পারতাম। প্রায় ছফুটের মত লম্বা ঝাকড়া ঘন চুলের একজন মানুষ কপালে প্রকাণ্ড এক সিঁদুরের ফোঁটা, মুখ ভর্তি দাড়ি। গায়ে গেরুয়া রঙের একটি চাদর; পরনে খাটো করে পর একটি ধবধবে সাদা সিঙ্কের লুঙ্গি! পায়ে রুপোর বোলের খরম। প্রথম দশনেই হকচাকিয়ে যেতে হয়। জ্যোতির্ষিণব সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলেন, হস্ত গণনা করাতে এসেছেন? পরীক্ষণেই গম্ভীর হয়ে বললেন, উঁহু, সুটকেস হাতে কেউ জ্যোতিষীর কাছে আসে না। লক্ষণ বিচারে ভুল হয়েছে। তুমি সফিকের কাছে এসেছ?
জি।
সফিক সারা সকাল অপেক্ষা করেছিল। তোমার না ভোরবেলা আসার কথা?
ট্রেন ফেল করলাম। ঢাকা মেইলে আসা লাগল।
জ্যোতির্ষাণর মহা গম্ভীর হয়ে বললেন,
আমি জানতাম। সফিককে বললাম। আশাভঙ্গ হওয়ার কারণ ঘটবে। সে সারা সকাল রাস্তার মোড়ে তোমার জন্য দাঁড়িয়েছিল। আশাভঙ্গ তো হলই ঠিক কিনা তুমি বল?
হ্যাঁ তা ঠিক।
ঠিক তো হবেই। তিন পুরুষ ধরে গুহ্য বিদ্যার চাচা আমাদের হুঁ হুঁ।
জ্যোতির্ষিণব আমাকে নিয়ে গেলেন তার ঘরে। তার ঘরের বর্ণনা সফিকের চিঠিতে পড়েছি। বাড়িয়ে লিখেনি কিছুই–ঘরে ঢুকলে যে কোন সুস্থ লোকের মাথা গুলিয়ে যাবে। তিনি জানালা বন্ধ করে ঘরটা সব সময় অন্ধকার করে রাখেন। অন্ধকার ঘরে একটি ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলে। ধূপদানী আছে, কেউ হাত দেখাতে আসছে টের পেলেই ধূপদানীতে এক গাদা ধূপ ফেলে নিমিষের মধ্যে গা ছমছমানো আবহাওয়া তৈরি করে ফেলেন। কিন্তু এতসব করেও তাঁর পসার নেই মোটেও।
জ্যোতির্ষিণব আমাকে চৌকিতে বসিয়ে ধূপদানীতে ধূপ ঢেলে দিলেন। নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়। থমথমে গলায় বললেন, উদ্দেশ্য সফল হবে তোমার। বি.এ. পাস করবে। ঠিকমত। কপালে রাজানুগ্রহের যোগ আছে। গ্রহ শান্তির একটা কবচ নিও আমার কাছ থেকে। সফিকের বন্ধু তুমি। নামমাত্র মূল্যে পাবে। আমি বললাম, কোথায়ও একটু গোসল করা যাবে? আশপাশে চায়ের দোকান আছে? বড় চা খেতে ইচ্ছা হচ্ছে।
জ্যোতির্ষিণব আঁৎকে উঠলেন। যেন এমন অদ্ভুত কথা কখনো শুনেন নি। রাগী গলায় বললেন, স্বাস্থ্য বিধির কিছুই দেখি জান না। গায়ের ঘাম না। মরতেই গোসল চা। ঠাণ্ডা হয়ে বস দেখি।
তিনি একটি টেবিল ফ্যান চালু করলেন। ফ্যানটি নতুন। ভয়ানক গভীর স্বরে বললেন, আমার এক ভক্ত দিয়েছে। এই সব বিলাস সামগ্ৰী দুই চক্ষে দেখতে পারি না। তান্ত্রিক মানুষ আমরা –এসব কী আমাদের লাগে? শীত গ্রীষ্ম সব আমাদের কাছে সমান।
ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করবার পর জ্যোতির্ষিণব আমাকে গোসলখানা দেখিয়ে দিলেন।
খুব সাবধানে গোসল সারবে রঞ্জু। দারুণ পিছল মেঝে। মেসের অন্য বোর্ডাররা কেউ নেই। যতক্ষণ ইচ্ছা থাক গোসলখানায়। চা আমি বানিয়ে রাখব এসেই গরম পাবে। কয় চামচ চিনি খাও চায়ে?
গায়ে পানি ঢালতেই শরীর জুড়িয়ে গেল। বরফের মত ঠাণ্ডা পানি। পথের ক্লান্তি, নতুন জায়গায় আসার উদ্বেগ সব মুছে গিয়ে ভাল লাগতে শুরু করল। হঠাৎ করেই মনে হল নীলগঞ্জের পুকুরে যেন ভরদুপুরে সাতার কাটছি। আমি অনেকবার লক্ষ্য করেছি। সুখী হওয়ার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে মানুষের। অতি সামান্য জিনিসও মানুষকে অভিভূত করে ফেলতে পারে।
আমার বাবার কথাই ধরা যাক। তাঁর মত সুখী লোক এ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই বলেই আমার ধারণা! অথচ গত ছয় বছর ধরে তার কোন চাকরি-বাকরি নেই। তিনি ভোর বেলা উঠেই স্টেশনে যান। সেখানকার চায়ের স্টলটি নাকি ফ্যাস ক্লাস চা বানায়। খালি পেটে ঐ চা পর পর দুকাপ খাবার পর তিনি স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে গল্প-গুজব করেন। কি গল্প করেন তিনিই জানেন। নটার দিকে স্বরূলের ভাত রান্না হয় বাড়িতে। সে সময় তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। আনজু এবং পারুলের সঙ্গে অতি দ্রুত ভাত খেয়ে নেন। সময় তার হাতে খুব অল্প কারণ সাড়ে দশটার দিকে পোস্টাপিসে খবরের কাগজ আসে। কাগজটি পড়া তার কাছে ভাত খাওয়ার মতই জরুরি। সন্ধ্যাবেলা তিনি হারু গায়েনের ঘরে বেহালা বাজানো শিখেন। বর্তমানে এই দিকেই তার সমস্ত মন প্ৰাণ নিবেদিত। মহাসুখী লোক তিনি। মা যদি বলেন, পারুলের তো নাম কাটা গেছে স্কুলে। তিন মাসের বেতন বাকি।