কুসুমের কথাগুলির অন্তরালে যত অর্থ ছিল ক্রমে ক্রমে শশী তা পরিষ্কার বুঝিতে পারে। একদিন দুদিন নয়, অনেকগুলি সুদীর্ঘ বৎসর ব্যাপিয়া তার জন্য কুসুম পাগল হইয়া ছিল, তারপর ক্রমে ক্রমে তার সে উন্মাদ ভালোবাসা নির্জীব হইয়া আসিয়াছে। হয়তো মরিয়াই গিয়াছে! কে বলিতে পারে? আজ এ ঘটনা শশীর কাছে যত ভয়ানক মনে হোক এই পরিণতিই তো স্বাভাবিক। গাঁয়ের মেয়ে ঘরের বউ কুসুম, মনোবাসনা কতদূর অদম্য হইয়া ওঠায় দিনের-পর-দিন নৈবেদ্যের মতো নিজেকে শশীর কাছে সে নিবেদন করিয়া চলিয়ছিল এখন শশী তা বুঝিতে পারে, কুসুমের অমন ভয়ানক উপবাসী ভালোবাসা যে এতকাল সতেজে বাঁচিয়া ছিল, তাই তো কল্পনাতীতরূপে বিস্ময়কর। আপনা হইতেই যে প্রেম জাগিয়াছিল, আপনা হইতে স্বাভাবিক নিয়মে আবার তা লয় পাইয়াছে। শশীকে না দেখিয়া এখন কুসুমের দিন কাটিবে, শশীকে বাদ দিয়া কাটিবে জীবন।
কুসুমের পরিবর্তনে আশ্চর্য শশী তাই হয় না। ঘরে আগুন লাগিলে আগুন নেভে- বাহিরের, মনেরও। কুসুমের মনের আগুন কেন চিরদিন জুলিবে? নিজের ব্যাকুলতা শশীকে অবাক করিয়া রাখে। যখনি মনে হয় তার আর কিছুই করিবার নাই, জীবনে যতো বড়ো অসম্ভবকে সম্ভব করিতে পারুক কুসুমকে আর কোনোদিন সে ভালোবাসাইতে পারিবে না, কষ্ট শশী ছটফট করে। ফুটিয়া ঝরিয়া গিয়াছে, কুসুম মরিয়া গিয়াছে,–তারই চোখের সামনে তারই অন্যমনস্ক মনের প্রান্তে। কী ছেলেখেলায় সে মাতিয়াছিল যে এমন ব্যাপার ঘটিতে দিল!
ছেলেখেলাগুলি সবই বর্তমান আছে। হাসপাতালে গেল শশী, নাড়ি টিপিয়া হৃৎস্পন্দন শুনিয়া ওষুধ লিখিয়া দিল-ফোঁড়াও কাটিল একটা। সাতগাঁয়ে রোগীও দেখিতে যাইতে হইল। কতকাল এসব কর্তব্য শশী করিতেছে, একদিন কি কলের মতো কাজগুলি করা যায় না? অন্যমনে কুসুমের কথা ভাবিতে ভাবিতে নাড়ি টিপিতে কেহ তো তাহাকে বারণ করে নাই! এত রাগ কেন শশীর, মরণাপন্ন রোগীকে এমন ধমক দেওয়া কেন? কী আপসোস আজ শশীর মনে, কী আত্মধিক্কার কারো তো বুঝিবার নয়। ধরিতে গেলে একদিক দিয়া এ তো ভালোই হইয়াছে শশী? ঘরের বউ শুদ্ধ ও পবিত্রভাবে ঘরেই রহিয়া গিয়াছে, রক্ষা পাইয়াছে নীতি ও ধর্ম। সত্য এদিক দিয়া একটু ভালোলাগা উচিত ছিল। ভালোমদের অনেক দিনের পুরানো এসব সংস্কার তার আছে বইকী, তবু, একবারও শশীর মনে হইল না একদিন অনেক ভণিতা করিয়া কুসুমকে যে-কথাগুলি বুঝাইয়া বলিতে গিয়াছিল আজ প্রকারান্তরে তাই ঘটিয়াছে—শান্ত মনে বুঝিয়া শুনিয়া চারিদিক বিবেচনা করিয়া কুসুমকে সে যে আত্মসংযম অভ্যাস করিতে বলিয়াছিল, কিছু না-বুঝিয়া শুনিয়াই কুসুম এখন অনায়াসে তা পালন করিতে পারবে।
পরদিন সকালে কুসুমকে এ বাড়িতে দেখা গেল। মেয়েদের কাছে বিদায় লইয়া আসিয়াছে। আর কেহ হইলে হয়তো ভাবিয়া বসিত এ তার শশীকে দেখিতে আসার ছল, শশী তা ভাবিল না। নিজের পক্ষে সুবিধাজনক ভাবনাগুলিকে শশী চিরকাল ভয়ানক সন্দেহের সঙ্গে বিচার করে। তবু সে করিল কী, বাহিরে দাঁড়াইয়া থাকার বদলে নিজের ঘরে গিয়া সকলে কী ভাবিবে না ভাবিবে একেবারে অগ্রাহ্য করিয়া ডাকিল, পরানের বউ, একবার শোনো।
কুসুম ঘরে আসিয়া বলল, বিদায় নিতে এলাম ছোটোবাবু। দোষটোষ যা করেছি মনে রাখবেন নাকি?
শশীর লিল, রাখব না? দোষগুণ, ভালোমন্দ, তোমার সম্বন্ধে খুঁটিনাটি তুচ্ছ কথাটি পর্যন্ত কোনোদিন ভুলতে পারব না বউ।
কালের চেয়ে শশীর আজকের প্রেম-বিনোদন ঢের বেশি স্পষ্ট। যেমন বলিল তেমনভাবে শশী যদি কুসুমকে মনে রাখে তবে সত্যসত্যই কি গভীরভাবে কুসুমকে সে ভালোবাসে?
কুসুম তাই কাঁদো-কাঁদো হইয়া বলিল, এমন করে বললে আমার যে পায়া ভারী হয়ে যায় ছোটোবাবু?
শশী বলিল, সত্যিকথা আমি সোজা ভাষাতেই বলি বউ-স্পষ্ট করে। ইশারাফিশারায় বলা আমার আসে না।
যাওয়ার সময় বিপদ করলেন।–কুসুম বলিল।
নাই বা গেলে?—বলিল শশী।
কুসুমকে গাঁয়ে রাখিবার জন্য আজও চেষ্টা করিতেছে শশী, এ শশীকে যেন চেনা যায় না। এমন দীনভাব সে কোথায় পাইল, কোথায় শিখিল এমন কাঙালপনা? জানে, কুসুম থাকিবে না, থাকিলে ভালোবাসিবে না, তবু উৎসুকভাবে শশী জবাবের প্রতীক্ষা করে। মানুষ যে মরিয়া বাঁচে না কী তার প্রমাণ আছে? শীতকালের বর্ষায় এখনো কি মরা নদীতে বান ডাকে না? নিজেকে হয়তো কুসুম বুঝিতে পারে নাই, কাল তালবনে মিথ্যা বলিয়াছিল!
কুসুম ভয়ে ভয়ে বলিল, থেকে কী করব ছোটোবাবু? তাতে আপনারও কষ্ট, আমারও কষ্ট। এ বয়সে আর কি কষ্ট সইতে পারব? গলায় দড়ি-টড়ি দিয়ে বসব হয়তো।
শশী না পারুক, ইশারায় মনের কথা কুসুম বেশ বলিতে পারে, অনেকদিন শশীকে ওভাবে মনের কথা বলিয়া তার দক্ষতা জনিয়াছে। শশী বিবর্ণ হইয়া গেল। সভয়ে বলিল, না বউ না, ওসব কখনও কোরো না! ওসব নাটুকেপনা করতে নেই। গোড়ায় যদি বলতে, থাকার কথা মুখেও আনতাম না। এত যদি বিগড়ে থাকে মন, বাপের বাড়ি গিয়েই থাকো। বুঝেশুনেই তো কাজ করতে বলেছি তোমাকে গোড়া থেকে, চারদিক বিবেচনা করে।
কুসুম বলিল, তা না করলে অনেক আগেই গলায় দড়ি দিতাম ছোটোবাবু। যাব এবার?
এ অনুমতি চাওয়ার কোনো কারণই শশী সেদিন খুঁজিয়া পাইল না।
এত কাণ্ড করিয়া কুসুম বাড়ি গেল। এইরকম স্বভাব কুসুমের। জীবনটা নাটকীয় করিয়া তুলিবার দিকে চিরদিন তার বিশেষ পক্ষপাতিত্ব ছিল।