- বইয়ের নামঃ অনিল বাগচির একদিন
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ শিখা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী, ইতিহাস
কেউ কি হাঁটছে বারান্দায়
কেউ কি হাঁটছে। বারান্দায়?
পা টিপে টিপে হাঁটছে? অনিল বাগচী শুয়েছিল, উঠে বসল। তার শরীর ঝিম ঝিম করছে, পানির পিপাসা লেগেছে। সামান্য শব্দেই তার এখন এমন হচ্ছে। শরীরের কলকজা সম্ভবত সবই নষ্ট হয়ে গেছে। মাথার ভেতরটা সারাক্ষণ ফাঁকা লাগে। তার নাক পরিষ্কার, সর্দি নেই, কিছু নেই, কিন্তু এই মুহুর্তে সে হা করে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
আবার পায়ের শব্দ। শব্দটা কি বারান্দায় হচ্ছে না। রাস্তায় হচ্ছে? অনিলের কান এখন খুব তীক্ষ্ণ। অনেক দূরের শব্দও সে এখন পরিষ্কার শুনতে পায়। হয়ত রাস্তায় কেউ হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু রাতের বেলা কে হাঁটবে রাস্তায়? এখনকার রাত অন্যরকম রাত। দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকার রাত। রাস্তায় হেঁটে বেড়াবার রাত না।
কা-কা শব্দে কাক ডাকল। অনিল ভয়ংকর চমকে উঠল। এমন চমকে উঠার কিছু না। একটা কাক তার জানালার বাইরে বাসা বেঁধেছে। সে তো ডাকবেই, কিন্তু কা-কা করে শব্দটা ঠিক যেন তার মাথার ভেতর হয়েছে। কাকটা যেন তার মগজে পা রেখে দাঁড়িয়েছিল। কা-কা ডেকে ঠোঁট দিয়ে অনিলের মাথার মগজ খানিকটা ঠোকরে নিল। ব্যথায় শরীর পাক খাচ্ছে। চোখে পানি এসে যাচ্ছে। পিপাসায় বুক শুকিয়ে কাঠ।
এতটা ভয় নিয়ে বেঁচে থাকা কি সম্ভব? এরচে মরে যাওয়া কি অনেক সহজ না? বাড়ির ছাদে উঠে রাস্তায় লাফিয়ে পড়লে কেমন হয়? ছাদে উঠার দরজাটা কি খোলা? মেসের মালিক কামাল মিয়া ভারি ভারি সব তালা লাগিয়েছেন। সদর দরজায় ভেতর থেকে দুটা তালা লাগানো হয়। ছাদে যাবার দরজাও নিশ্চয়ই বন্ধ। সেখানেও তালা।
অনিল হাত বাড়িয়ে পানির জগ নিল। তার গ্রাস ভেঙে গেছে, জগে৷ মুখ লাগিয়ে পানি খেতে হয়। শোবার সময় সে জগ ভর্তি করে পানি এনে রাখে। কিছুক্ষণ পর পর কয়েক ঢোক করে পানি খায়। ভোরের মধ্যে পানির জগ শেষ হয়ে যায়।
ভয়। তীব্র ভয়। সারাক্ষণ ভয়ে অনিলের শরীর কাপে। সে অবশ্যি জন্ম থেকেই ভীতু ধরনের। ছোটবেলায় অন্ধকারে কখনো ঘুমুতে পারত না। বাতি জ্বলিয়ে রাখতে হত। সে সময়টা আবার ফিরে এসেছে। এখন সে অন্ধকারে ঘুমুতে পারে না। রাত এগারোটার পর বাতি নিভিয়ে দিতে হয়। সে জেগে থাকে। মাঝে মাঝে অন্ধকার অসহ্য বোধ হলে বালিশের নিচে রাখা টর্চ জ্বালায়। তীরের মতো আলোর ফলা দেয়ালের নানান জায়গায় ফেলে। ঘরের অন্ধকার তাতে কমে না। খুব সামান্য অংশই আলোকিত হয়। বাকি ঘরে আগের মতোই অন্ধকার থাকে। অন্ধকার কমে না। অনিলের ভয়ও কমে না। অনিল বালিশের নিচ থেকে দু ব্যাটারীর টর্চটা বের করল। আলো ফেলল দেয়ালে। আলো তেমন জোরালো না। ব্যাটারি কিনতে হবে। কি কি কিনতে হবে তা দিনে মনে থাকে না। রাতে শুধু মনে হয়। টর্চের ব্যাটারি, একটা পানির গ্লাস, মোমবাতি, কাগজ, লেখার কাগজ। কাল রাতে চিঠি লেখার ইচ্ছা করছিল। কাগজের অভাবে চিঠি লেখা হয় নি।
অনিল টেবিলে রাখা টেবিল ঘড়িটিতে আলো ফেলল। রাত বেশি না, কিন্তু মনে হচ্ছে নিশুতি। সে এবার আলো ফেলল দেয়ালে। আলোটা পড়ল ঠিক ক্যালেন্ডারটার উপর। ওষুধ কোম্পানির চোখে বাংলাদেশ। পালতোলা নৌকা যাচ্ছে। মাঝি হাল ধরে বসে আছে। তার মুখভর্তি হাসি। তার হাসি মনে হতে পারে নৌকার হাল ধরে বসে থাকার মধ্যেই জীবনের পরম শান্তি।
ক্যালেন্ডারে পাশেই স্বামী বিবেকানন্দের বাধানো ছবি। অনিলের বাবা এই ছবি ছেলেকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন। ছবিটির নিচে বিবেকানন্দের। এটি বাণী লেখা। বাণীটি হচ্ছে- যে ঈশ্বর মানুষকে ইহকালে ক্ষুধার অন্ন দিতে পারেন। না। তিনি পরকালে তাদের পরম সুখে রাখবেন তা আমি বিশ্বাস করি না।
ছবির বিবেকানন্দ রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন। ঘরের যে দিকে যাওয়া যাক মনে হবে স্বামীজী সে দিকেই তাকিয়ে আছেন। রাগ ছাড়াও তার চোখের ভাষায় এক ধরনের ভৎসনা আছে। তিনি যেন বলছেন, রে মূৰ্থি, জীবনটা নষ্ট করছিস কেন?
অনিল টর্চ লাইটের আলো নিভিয়ে ফেলল। ছবিটা সরানো দরকার। নষ্ট করে ফেলা দরকার, কিংবা লুকিয়ে ফেলা দরকার। বিবেকানন্দের ছবি ঘরে রাখা এখন ভয়াবহ ব্যাপার। ছবিটা সরাতে হবে। এখনই কি সরাবে? আবার কাক ডাকল। অনিল ভয়ে একটা ঝাকুনি খেল। অনিলের বাবা রূপেশ্বর মডেল হাই স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক সুরেশ বাগচী, ছেলের চরিত্রে অস্বাভাবিক ভয়ের ব্যাপারটি লক্ষ্য করেই বোধহয় ছেলের খাতায় একদিন বড় বড় করে লিখে দিল–
Cowards die many times before their death.
গম্ভীর গলায় বললেন, রোজ সকালে এই লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকবি। ধ্যান করবি। লেখাটার মানে হল— ভীতুদের মৃত্যুর আগেও অনেকবার মৃত্যুবরণ করতে হয়। যে সে মানুষের লেখা না। শেকসপিয়ারের লেখা। দেখি শেকসপিয়ার বানান কর তো? সুরেশ বাগচীর অভ্যাসই হচ্ছে যে কোন কথা বলেই ফন্ট করে বানান জিজ্ঞেস করা। অনিল ক্লাস গ্ৰীতে যখন পড়ে তার পেটে তীব্র ব্যথা শুরু হল। সুরেশ বাবু ছেলেকে কোলে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন। পথে নেমেই বললেন, ব্যথা বেশি হচ্ছে বাবা?
অনিল কাঁদতে কাঁদতে বলল, হুঁ।
খুব বেশি?
হুঁ।
আচ্ছা বাবা বল তো ব্যথার ইংরেজি কি?
অনিল চোখ মুছতে মুছতে বল, পেইন।
এই তো হয়েছে। আচ্ছা বাবা, এখন পেইন বানান করতো। কোন কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকলে ব্যথা কম লাগবে। বানান করতো পেইন। আচ্ছা, আমি তোমাকে সাহায্য করছি। প্ৰথম অক্ষর হল পি।
সুরেশ বাগচীর প্রাণপণ চেষ্টাতেও অনিলের ইংরেজি বিদ্যা বেশিদূর অগ্রসর হয় নি। ইংরেজিতে আই. এ. পরীক্ষায় রেফার্ড পেয়ে গেল। সুরেশ বাগচী মনের দুঃখে পুরো দিন না খেয়ে রইলেন এবং সন্ধ্যাবেলা দরজা বন্ধ করে ছোট ছেলেমেয়েদের মতো শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। অনিল শুকনো মুখে বারান্দায় বসে রইল। অনিলের বড় বোন অতসী বাবার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলতে লাগল, দরজা খোল বাবা। দরজা খোল। সুরেশ বাগচী বললেন, এই কুলাঙ্গারকে বেরিয়ে যেতে বল অতসী। কুলাঙ্গারের মুখ দেখতে চাই না। অনিল ঘর থেকে বের হয়ে একা এক রূপেশ্বর নদীর ঘাটে বসে রইল।
অন্ধকার রাত। জনমানব শূন্য নদীর ঘাট। ওপারে শ্মশান, মড়া পুড়ানো হয়। কয়দিন আগেই মড়া পুড়িয়ে গেছে। ভাঙা কলসী, পোড়া কাঠ আবছা করে হলেও নজরে পড়ে। অনিলের গা ছমছম করতে লাগল। মনে হতে লাগল অশরীরী মানুষজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। নিঃশব্দে চলাফেরা করছে তাকে ঘিরে। এই তো কে যেন হাসল। শিয়াল ডাকছে। শিয়ালের ডাক এমন ভয়ংকর লাগছে কেন? অনিল ভয়ে কাপতে লাগল। সে যে দৌড়ে বাড়ি চলে যাবে সেই সাহসও রইল না।
গভীর রাতে হারিকেন হাতে সুরেশ বাগচী ছেলেকে খুঁজতে এলেন। নদীর পাড়ে এসে কোমল গলায় বললেন, অনিল বাবা, আয় বাড়ি যাই। তিনি হাত ধরে ছেলেকে নিয়ে এগুতে লাগলেন। এক সময় বিস্মিত হয়ে বললেন, এমন কাপছিস কেন?
ভয় লাগছে। বাবা।
আরো বোকা, কিসের ভয়? শেকসপিয়ার কি বলেছিলেন, কাউয়ার্ডস ডাই মেনি টাইমস বিফোর দেয়ার ডেথ। ভীতুদের মরবার আগেও অনেকবার মরতে হয়। বলতো শেকসপিয়ারের কোন বইয়ে এই লেখাটা আছে। তোকে আগে একবার বলেছি। কি, পারবি না?
ছেলেবেলার অন্ধ, তীব্র ভয় আবার ফিরে এসেছে। অনিল এখন ঘুমুতে পারে না। রাত জেগে জেগে নানান ধরনের শব্দ শুনে। আতংকে কোপে কেপে উঠে। সবচে বেশি ভয় পায় যখন কাক ডেকে উঠে। আচমকা এই কাকটা কাকা করে আত্মা কাঁপিয়ে দেয়।
পরিষ্কার চটি পায়ে হাঁটার শব্দ। কে হাঁটছে চটি পায়ে? রহিম সাহেব? রহিম সাহেবের মাঝে মাঝে গভীর রাতে হাঁটার অভ্যাস আছে। তাঁর তো আজ সকালে চলে যাবার কথা ছিল। যেতে পারেন নি? অনিল বলল, কে? কে হাঁটে?
কেউ জবাব দিল না। হুস করে একটা ট্রাক চলে গেল। কুকুর ডাকছে। ঢাকা শহরের কুকুরগুলি এখন খুব ডাকছে। মিলিটারী না-কি অনেক কুকুর মেরেছে। রাত দুপুরে কুকুরগুলি আচমকা ডেকে উঠছে- মিলিটারীরা ভয় পেয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে। কুকুর এখন মিলিটারী চিনে ফেলেছে। হঠাৎ কোন রাস্তা কুকুরশুন্য হলে বুঝতে হবে মিলিটারী সেখানে আছে। কিংবা তারা আসছে। বাঘের আগে ফেউ ডাকার মতো, মিলিটারীর আগে কুকুর ডাকে।
পায়ের শব্দটা আবার আসছে। ঠিক তার দরজার কাছে এসে শব্দ থেমে গেল। অনিল ক্ষীণ স্বরে বলল, কে? তার নিজের গলার শব্দ সে নিজেই শুনতে পেল না। তাকে ধরার জন্যে কি মিলিটারী চলে এসেছে? একটু আগে যে ট্রাকের শব্দ শোনা গেল, সেই ট্রাকে করেই কি তাকে অজানা কোন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে? সে দরজা খুলবে। আর তাকে নিয়ে ট্রাকে তুলবে। এরা কি গাড়িতে তোলার সময় চোখ বেঁধে তুলে? কেন তাকে শুধু শুধু তুলবে? সে তো কিছুই করে নি। সে কোন মিছিলে যায় নি। তার ভয় লাগে। সাতই মার্চের ভাষণ শোনার জন্যে রেসকোর্সের মাঠে যাবার ইচ্ছা ছিল, তবু যায় নি। তার মন বলছিল ঝামেলা হবে। লোকজন ছোটাছুটি শুরু করবে। মরতে হবে মানুষের পায়ের নিচে চাপা পড়ে।
জন্মাষ্টমীর রথযাত্ৰা উপলক্ষে বিরাট মেলা হয় নান্দিগ্রামে। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে সেই মেলা সে দেখতে গেল। কি প্ৰচণ্ড ভীড়া! যাতে হারিয়ে না। যায়। সে জন্যে সে দুহাতে শক্ত করে বাবার হাত ধরে রাখল। তারপরও সে হারিয়ে গেল। লোকজনের চাপে ছিটকে কোথায় চলে গেল। মেলার সবগুলো মানুষ যেন হঠাৎ পাগল হয়ে গেল। যে যে-দিকে পারছে ছুটছে। বেদেনীর সাপের ঝুড়ি থেকে দুটা কাল সাপ না-কি বের হয়ে পড়েছে। ছোটাছুটি এই কারণে। অনিল দৌড়াচ্ছিল চোখ বন্ধ করে। হঠাৎ কে যেন তাকে তাকে ধরে ফেলল। অনিল তাকাচ্ছে কিন্তু কিছু দেখছে না। তার চোখে সব দৃশ্য এলোমেলো হয়ে গেছে। শুধু সে শুনছে। বুড়ো এক ভদ্রলোক বলছেন, এই ছেলেটা এমন করছে কেন? এ কেমন যেন নীল হয়ে যাচ্ছে। এই ছেলেটাকে বাতাস কর। ছেলেটাকে বাতাস কর।
অনিল সারাজীবন সব রকম ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছে। আর আশ্চর্য! বেছে বেছে তাকেই একের পর এক ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। রূপেশ্বরে এক পাগলি আছে— মোক্তার পাগলি। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। তাকে মোক্তার বললেই বাঘিনীর মতো ছুটে যায়। বাচ্চ-কাচ্চারা তাকে দেখলেই ঢ়িল ছুড়ে। মোক্তার বলে চিৎকার করে ক্ষেপায়। পাগলি তাদের তাড়া করে। অনিল কোনদিন মোক্তার পাগলিকে দেখে হাসে নি। তার গায়ে ঢ়িল ছুড়ে নি কিংবা মোক্তার বলে চোঁচায় নি। তারপরেও এই পাগল শুধু তাকেই খুঁজে বেড়াত। দেখা হলেই তাড়া করত। হয়ত সে বই নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। বটগাছের আড়ালে থেকে মোক্তার পাগলি বের হয়ে এল। বই-খাতা ফেলে অনিল ছুটছে। পেছনে পেছনে লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুটছে মোক্তার পাগলি। রূপেশ্বরে এটা ছিল সাধারণ ঘটনা। কেউ অনিলকে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে আসত না। দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখত। কেউ কেউ হাততালি দিয়ে চেচাত- লাগ ভেলকি লাগ।
একদিন অনিল ধরা পড়ে গেল মোক্তার পাগলির হাতে। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। হাফইয়ার্লি পরীক্ষা শেষ করে বাড়ি ফিরছে। পোস্টাপিসের কাছে আসামাত্র মোক্তার পাগলি ছুটে এসে অনিলকে হাত চেপে ধরল। মেলায় যেমন হয়েছিল অনিলের সে রকম হল। মনে হল সে কিছু দেখতে পারছে না। তার হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে। এক্ষুণি বোধহয় হৃৎপিণ্ড ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। নাক দিয়ে সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। চারদিকে লোক জমে গেছে। সবাই মজা দেখছে। বড়ই মজাদার দৃশ্য।
মোক্তার পাগলি এক ঝটিকায় অনিলকে কোলে তুলে ফেলল। তার অনাবৃত স্তনে অনিলের মুখ চেপে বলল, খা দুধ খা। খা। কইলাম।
দর্শকরা বিপুল আনন্দে হেসে ফেলল। অনিলের নাম হয়ে গেল দুদু খাওয়া অনিল। দুটি অনিল ছিল ক্লাসে। একজন শুধু অনিল, অন্যজন দুদু খাওয়া অনিল।
অনিল ক্লাসে যাওয়া ছেড়ে দিল। স্কুলের সময় দরজা বন্ধ করে বসে থাকত। চেচিয়ে কাঁদত। অতসী বাবাকে গিয়ে বলত, থাক বাবা, আজ স্কুলে না গেল।
একদিন সুরেশ বাগচী ছেলেকে ডেকে বললেন, তোকে দুধ খাইয়েছে তো কি হয়েছে? মাতৃস্নেহে দুগ্ধপান করানোর চেষ্টায় দােষের কিছু না। মাতৃভাবে তাকে সম্মান করবি, তাহলেই হবে। আয় তোর ভয় ভাঙিয়ে দিয়ে আসি।
অনিল বলল, না।
না বলবি না। না বলা দুর্বল মানুষের লক্ষণ। আয় আমার সাথে। অতসী তোর মার একটা শাড়ি বের করে দে।
অতসী বলল, শাড়ি কি করবে?
মোক্তার পাগলিকে দেব। নগ্ন ঘুরে বেড়ায় দেখতে খারাপ লাগে।
মার শাড়ি কাউকে দিতে দিব না বাবা।
নতুন শাড়ি কেনার পয়সা নাইরে মা। দে, তোর মার একটা শাড়ি দে। মার স্মৃতি তো শাড়িতে থাকে না রে মা। মার স্মৃতি থাকে অন্তরে।
এক হাতে লাল পাড় শাড়ি নিয়ে অন্য হাতে শক্ত করে অনিলের হাত ধরে সুরেশ বাগচী নগ্ন পাগলিকে খুঁজে বের করলেন। পাগলি কঠিন চোখে তাকাল। সুরেশ বাগচী বললেন, আমার এই পুত্র আপনার ভয়ে অসম্ভব ভীত। আমি শুনেছি আপনি তাকে পুত্ৰস্নেহে দুগ্ধ পান করাবার চেষ্টা করেছেন। কাজেই সে আপনার পুত্ৰস্থানীয়। আপনি আপনার পুত্রের ভয় ভাঙিয়ে দিন।
পাগলি এইসব কঠিন কথার কি বুঝল কে জানে, তবে সে হাতে ইশারা করে অনিলকে কাছে ডাকল। অনিল ভয়াবহ আতঙ্কে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। সুরের বাগচী বললেন, ছেলে আপনার জন্যে একটা শাড়ি এনেছে, তার মায়ের ব্যবহারী শাড়ি। আপনি গ্ৰহণ করলে আমরা খুশি হব।
পাগলি হাত বাড়িয়ে শাড়ি নিল।
সুরেশ বাগচী বললেন, পুত্রের কাছে নগ্ন অবস্থায় উপস্থিত হওয়া শোভন নয়। আপনি শাড়িটা পরে আমার ছেলের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিন।
পাগলি বলল, দূর হ হারামজাদা।
আমি হাতজোড় করে মিনতি করছি। আপনি তাকে আর ভয় দেখাবেন। না। মা-মরা ছেলে, সে জন্ম থেকেই ভীতু। আপনি তার মাতৃস্থানীয়। আপনার ভয়ে সে স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।
পাগলি নিজের গায়ে শাড়ি মেলে ধরতে ধরতে হাসি মুখে বলল, দূর হ, দূর হ কইলাম।
আশ্চর্যের ব্যাপার! পাগলি আর কোনদিনই অনিলকে ভয় দেখায় নি। লালপেড়ে শাড়ি তাকে কখনো পরতে দেখা যায় নি। সে নগ্ন হয়েই ঘুরত। অনিলকে দেখলে থমকে দাঁড়িয়ে লাজুক গলায় বলতো, এই পুলা, মাথার চুল আচড়াও না ক্যান? একটা চিরুণি আনবা, চুল আঁচড়াইয়া দিমু। অনিল দৌড়ে পালিয়ে যেত। তার ভয় কাটে নি। শরীরের সমস্ত স্নায়ু অবশ করে দেয়া তীব্র ভয়।
দরজার কড়া নড়ে উঠল।
অনিলের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। কেউ একজন দরজার পাশে তাহলে দাড়িয়ে ছিল? কে সে? কে? অনিলের ঘাম হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে।
অনিল ঘুমোচ্ছ?
গফুর সাহেবের গলা। তবু অনিল বলল, কে কে?
আমি। ভয়ের কিছু নাই। আমি। দরজা খোল।
অনিল বিছানা ছেড়ে উঠেছে। সুইচ বোর্ড খুঁজে পাচ্ছে না। সমস্ত দেয়াল হাতড়ে বেড়াচ্ছে সুইচ বোর্ডের জন্যে। তার বালিশের নিচে টর্চ লাইট। একবারও টর্চ লাইটের কথা তার মনে আসছে না। তাকে ডাকছেন। গফুর সাহেব। সর্ব দক্ষিণের সিঙ্গেল রুমে থাকেন। এজি অপিসের সিনিয়ার অ্যাসিসটেন্ট। এই বছরেই রিটায়ার করার কথা। ঢাকায় বাসা করে থাকতেন। স্ত্রী মারা যাবার পর বাসা ছেড়ে মেসে এসে উঠেছেন। একা মানুষ। বাসা ভাড়া করে এতগুলি টাকা নষ্ট করতে ইচ্ছে করে নি। প্রয়োজনও নেই। দুটি মেয়ে। দুজনেরই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। একজন থাকে রাজশাহীতে, একজন খুলনায়। সুইচ বোর্ড খুঁজে পাওয়া গেল। অনিল বাতি জ্বালাল, দরজা খুলল। গফুর সাহেব বললেন, ঘুম আসছিল না, এ জন্যেই ডাকলাম। অন্য কিছু না।
এতক্ষণ ধরে আপনিই কি হাঁটাহাঁটি করছিলেন?
হুঁ। বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছে। আকাশে খুব মেঘ। তুমি কি চা খাবে অনিল? রাতে ঘুম ভালো হয় না। একটু পরে পরে চা খাই। খাবে?
না।
আস না, একটু চা খাও। সময় খারাপ। কথা-টথা বললে ভালো লাগে। গফুর সাহেব কথাগুলি বলার সময় একবারও অনিলের দিকে তাকালেন। না। অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বললেন। কারণ তিনি অনিলের দিকে সরাসরি তাকাতে পারছেন না। আজ দুপুরে একটা ছেলে অনিলের একটা চিঠি দিয়ে গেছে তার হাতে। চিঠিটা অনিলকে পৌঁছানোর দায়িত্ব তাঁর। সেই খোলা চিঠি তিনি কয়েকবার পড়েছেন। ভয়ংকর দুঃসংবাদের এই চিঠি তিনি অনিলকে দেয়ার মতো মনের জোর সংগ্রহ করতে পারেন নি। রূপেশ্বর স্কুলের হেড মাস্টার মনোয়ার উদ্দিন খাঁ লিখেছেন
বাবা অনিল,
তোমাকে একটি দুঃখের সংবাদ জানাইতেছি। এপ্রিল মাসের নয় তারিখে রূপেশ্বরে পাক মিলিটারী উপস্থিত হয়। তাঁহাদের আকস্মিক আগমনের জন্যে আমরা কেহই প্ৰস্তৃত ছিলাম না। তাহারা রূপেশ্বরে অবস্থান নেয়। এপ্রিল মাসের বার তারিখে আরো অনেকের সঙ্গে তাহারা তোমার বাবাকে হত্যা করে। আমরা তাহাকে বাচানোর সর্বরকম চেষ্টা করিয়াছি। এর বেশি। আমি আর কি বলিব? তোমার ভগ্নিকে আমি আমার বাড়িতে আনিয়া রাখিয়াছি। তাহার বিষয়ে তুমি চিন্তা করিবে না। আল্লাহ পাকের নামে শপথ নিয়া বলিতেছি, আমার জীবন থাকিতে আমি অতসী মায়ের কোন অনিষ্ট হইতে দিব না। তোমার পিতার মৃত্যুতে রূপেশ্বরের প্রতিটি মানুষ চোখের জল ফেলিয়াছে। এই কথা তোমাকে জানাইলাম। জানি না ইহাতে তুমি মনে কোন শান্তি পাইবে কি-না। আল্লাহ পাক তাঁহার আত্মার শান্তি দিন, এই প্রার্থনা করি। তুমি সাবধানে থাকিবে। ভুলেও রূপেশ্বরে আসিবার কথা চিন্তা করিবে না। একদল মুক্তিযোদ্ধা রূপেশ্বর থানা আক্রমণ করিবার চেষ্টা করায় ভয়াবহ ফল হইয়াছে। রূপেশ্বরে বর্তমানে কোন যুবক ছেলে নাই।…
গফুর সাহেব ভেবেছিলেন রাতে চিঠিটা দেবেন। এখন অনিলের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে চিঠি না দেয়াই ভালো। ছেলেটা ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। এই খবর পেলে কি করবে। কে জানে।
অনিল।
জ্বি।
আসি আমার ঘরে আস, চা খাও।
অনিল উঠে এল। গফুর সাহেব কেরোসিনের চুলায় কেতলি বসিয়ে দিলেন। দুজন মেঝেতে মুখোমুখি বসে আছে। কারো মুখেই কোন কথা নেই। অস্বস্তি কাটাবার জন্যে গফুর সাহেব বললেন, আজকের পূর্বদেশটা পড়েছ?
অনিল বলল, না। আমি এখন খবরের কাগজ পড়ি না। পড়তে ইচ্ছা করে না।
আমারো পড়তে ইচ্ছা করে না। অভ্যাসের বসে পড়ি। তবে আজকের পূৰ্বদেশটা তোমার পড়া উচিত। নাও, এই জায়গাটা পড়। মন দিয়ে পড়।
অনিল পড়ল।
পাকিস্তানের আজাদী দিবস উপলক্ষে গোলাম আযমের আহবান। আযাদী দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শান্তিকমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন এক বিশাল সভার আয়োজন করে। সেই সভায় জনাব আযম পাকিস্তানের দুশমনদের মহল্লায় মহল্লায়। তন্ন তন্ন করে খুঁজে তাদের অস্তিত্ব বিলোপ করার জন্য দেশপ্রেমিক নাগরিকদের শান্তি কমিটির সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য উদাত্ত আহবান জানান।
পড়েছ অনিল?
জি।
তোমার খুব সাবধানে থাকা দরকার। মেসে থাকাটা একেবারেই উচিত না। মিলিটারীর তিনটা টার্গেট— আওয়ামী লীগ, হিন্দু, যুবক ছেলে। তারপর আবার শুনলাম মেসে কারা কারা তাদের নাম-ধাম পরিচয় জানতে চেয়ে চিঠি এসেছে। কামাল মিয়া বলল।
কে চিঠি দিয়েছে?
স্থানীয় শান্তি রক্ষা কমিটির এক লোক- এস এম সোলায়মান। মজার ব্যাপার কি জান— আগে এই লোক ঘোর আওয়ামী লীগারে ছিল। শেখ সাহেবের ভাষণ ক্যাসেট করে নিয়ে এসেছিল। মাইক বাজিয়ে মহল্লায় শুনিয়েছে। এখন সে বিরাট পাকিস্তানপন্থি। মানুষের চরিত্র বোঝা খুব কঠিন। তবে আমি তাকে ঠিক দোষও দিচ্ছি না। সে হয়ত যা করছে প্ৰাণ বাচানোর জন্যে করছে। এসব না করলে আওয়ামী লীগার হিসেবে তাকে মেরে ফেলত। ঠিক না?
অনিল কিছু বলল না। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে নিঃশব্দে চুমুক দিতে লাগল। চা-টা খেতে ভালো লাগছে। বেশ ভালো লাগছে।
চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবে? চানাচুর আছে। দেব চানাচুর? টেনশনের সময় খুব ক্ষিধা পায়।
অনিল বলল, আমি আর কিছু খাব না। চা থাকলে আরেকটু নেব।
গফুর সাহেব। আবার কাপ। ভর্তি করে দিলেন। নিচু গলায় বললেন, তুমি বরং মেসটা ছেড়ে দাও।
মেস ছেড়ে যাব কোথায়? ঢাকা শহরে আমার পরিচিত কেউ নেই। ফতুল্লায় এক মামা থাকতেন। এখন আছেন কি-না তাও জানি না।
গফুর সাহেব হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবেই জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবার শেষ চিঠি কবে পেয়েছ?
কেন জিজ্ঞেস করছেন?
এম্নি জানতে চাচ্ছি। কোন কারণ নেই।
বাবার শেষ চিঠি পেয়েছি। চার মাস আগে। এখন কেমন আছেন কিছুই জানি না। আমি বেশ কয়েকটা চিঠি দিয়েছি। জবাব পাচ্ছি না।
গফুর সাহেব বলরেন, যাও শুয়ে পড়। রাত অনেক হয়েছে।
অনিল নিজের ঘরে চলে এল। বাতি নিভিয়ে বিছানায় যাওয়ামাত্র বৃষ্টি শুরু হল। ঝুম বৃষ্টি।
জানালা খুলে একটু বৃষ্টি দেখলে কেমন হয়? কত দিন জানালা খুলে ঘুমানো হয় না। আহা কেমন না জানি লাগে জানালা খোলা রেখে ঘুমুতে। দেশ স্বাধীন যদি সত্যি সত্যি হয় তাহলে সে কয়েক রাত রাস্তার পাশে পাটি পেতে ঘুমুবে। সে রাতগুলোতে ঘুম আসবে না। সে রাতগুলো কাটাবে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে।
ভাল বৃষ্টি হচ্ছে তো। ঝড় বৃষ্টির সময় মিলিটারীরা রাস্তায় থাকে না। এরা বৃষ্টি ভয় করে। হোক বৃষ্টি। দেশ ভাসিয়ে নিয়ে যাক। পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় বান ডাকুক। শো শো শব্দে ছুটে আসুক জলরাশি।
টকটক শব্দে টিকটিকি ডাকছে। এই ঘরে চারটা টিকটিকি আছে। একটার গা ধবল। কুষ্ঠের রুগীর মতো সাদা। একটা মাকড়সা আছে। সে সম্ভবত আয়নার পেছনে থাকে। ঠিক রাত আটটায় পেছন থেকে এসে আয়নার উপর বসে থাকে। এমন নিখুঁত সময়ে ব্যাপারটা ঘটে যে মনে হয় মাকড়সাটার নিজের কাছেও কোন ঘড়ি আছে। সম্ভবত টিকটিকিগুলো তাকে খেয়ে ফেলেছে। সারভাইভাল অব দি ফিটেষ্ট। যে ফিট সে টিকে থাকবে।
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নীল আলোয় ঘর ভেসে গিয়ে আবার সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। অল্প বৃষ্টি হলেই মেসের সামনের রাস্তাটায় এক হাঁটু পানি হয়। সারারাত বৃষ্টি হোক, রাস্তায় এক কোমর পানি জমে যাক। পানি ভেঙে মিলিটারী জীপ আসবে না। ওরা শুকনো দেশের মানুষ। পানিতে ওদের খুব ভয়।
ঝড় হচ্ছে না-কি? জানালায় শব্দ হচ্ছে। কাকটা তারস্বরে চেচাচ্ছে। সাধারণত একটা কাক ডাকলে দশটা কাক এসে উপস্থিত হয়। কিন্তু এই কাকটা নিঃসঙ্গ, বন্ধুহীন। এর ডাকে কখনো কাউকে সাড়া দিতে অনিল শুনে নি। সে থাকেও একা একা। তার পুরুষ বন্ধুও তাকে ছেড়ে গেছে। সে কি দরজা খুলে কাকটাকে ভেতরে আসতে বলবো?
ঘুমে অনিলের চোখ জড়িয়ে আসছে। সারাদিন অসহ্য গরম ছিল। এখন পৃথিবী শীতল হয়েছে। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ভয় কেটে যাচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে- এমন দুর্যোগে মিলিটারী পথে নামবে না। অন্তত আজকের রাতটা মানুষের শান্তিতে কাটবে। অনিল ঘুমিয়ে পড়ল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চমৎকার স্বপ্ন দেখল। অনিল যেন খুব ছোট। তারা নৌকায় করে মামার বাড়ি যাচ্ছে। রূপবতী একজন তরুণীর কোলে সে বসে আছে। তার খুব লজ্জা লাগছে। অনিলের বাবা বললেন, ছেলে দেখি লজ্জায় মারা যাচ্ছে। আরো বোকা, এটা তোর মা। মার কোলে বসায় আবার লজ্জা কি? রূপবতী তরুণীটি বলছে- আহা ও কি আমাকে চিনে। লজা তো পাবেই। এটাই তো স্বাভাবিক। রূপবতী তরুণীর মুখ তখন খানিকটা মোক্তার পাগলির মতো হয়ে গেল। এবং সে বলতে লাগল— চিরণিটা কই? দেখি অতসী চিরণিটা দে তো। আমি বাবুর চুল আঁচড়ে দেই। অতসী খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, ওকে বাবু ডাকছ কেন? ওর নাম আনিল। তখন কোথেকে যেন কাক ডাকতে লাগল- কা-কা-কা।
কা-কা-কা-কা
কা-কা-কা-কা। আসলেই কাক ডাকছে।
কাকের চিৎকারে অনিলের ঘুম ভাঙল। জানালা খোলা। গত রাতের ঝড়ে এক সময় ছিটিকিনি খুলে গেছে। বৃষ্টির ছাটে বিছানার এক অংশ ভেজা। অনিলের পাও ভিজে আছে। তার ঘুম ভাঙে নি। এখন ঘুম ভাঙল কাকের ডাকে। নিঃসঙ্গ কাকটা জানালায় বসে অনিলের দিকে তাকিয়েই ডাকছে। অনিল বিছানা ছেড়ে নামল। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। জানালার পাশে চলে গেল। সামান্য আলো হয়েছে। ভোর হচ্ছে। ভোর, নতুন আরেকটি দিনের শুরু।
রাস্তা-ঘাট ফাঁকা। এখানে-ওখানে পানি জমে আছে। পানির উপর দিয়ে ছপ ছপা করতে করতে একটা কুকুর এগিয়ে গেল। শুকনো জায়গাও আছে। কুকুরটা সেদিকে গেল না। পানির উপর দিয়ে হাঁটতেই তার বোধহয় ভালো লাগছে। লাইটপোস্ট-এর ইলেকট্রিক তারে এক ঝাক শালিক বসে আছে। কয়টা শালিক সে কি গুনে দেখবে? সুরেশ বাগচী এই ভাবেই তাকে গুনতে শিখিয়েছেন। ট্রেনে করে যাচ্ছে, জানোলা দিয়ে মুখ বের করে দেখা গেল টেলিগ্রাফের তারে কয়েকটা ফিঙ্গে বসে আছে। সুরেশ বাবু বললেন, ও বাবু, ও অনিল গুনে ফেল তো বাবা কটা পাখি।
অনিল বলল, না। আমি গুনব না।
অতসী বলল, আমি গুনব বাবা?
সুরেশ বললেন, উহু উহু, অনিল শুনবে। কটা অনিল? কটা?
গোনার আগেই ট্রেন পাখি ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে গেল। সুরেশ বাগচীর মুখ দেখে তখন মনে হতে পারে— তাঁর খুব ইচ্ছা চেন টেনে ট্রেনটাকে তিনি থামান। পুত্রকে নিয়ে চলে যান হাঁটতে হাঁটতে যাতে সে ফিঙ্গে গুনে আসতে পারে।
শৈশবের অভ্যাসেই অনিল এখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শালিক পাখি গুনছে। পাখিগুলি স্থির হয়ে বসে আছে। পুরোপুরি ভোর না হওয়া পর্যন্ত এরা বোধহয় নড়বে না। কিংবা কে জানে এরা বোধহয় বুঝতে পারছে অনিল নামের ছাব্বিশ বছরের এক যুবক তাদের গুনছে। নড়াচড়া করলে যুবকের গুনতে অসুবিধা হবে।
রাস্তা এখনো ফাঁকা, রিকশা নেই, গাড়ি নেই, একটা মানুষ নেই। কাফুর্ঘ্য সকাল ছটা পর্যন্ত। কাজেই ছাঁটার আগে কাউকে দেখা যাবে না। এই সময় রাস্তার ঠিক মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে বললে কেমন হয়— আমি কাফুর্ঘ্য মানি না।
একটা জীপ চলে গেল।
মিলিটারী জীপ। ড্রাইভারের পাশে যে অফিসারটি বসে আছে তার চোখে সানগ্লাস। এই ভোর বেলা, যখন দিনের আলো পর্যন্ত স্পষ্ট হয় নি। তখন অফিসারটি চোখে সানগ্রাস পরে বের হল কেন? সে কি চারদিক অন্ধকার করে রাখতে চায়? আশেপাশের কিছু দেখতে চায় না? জানালাটা বন্ধ করে দেয়া উচিত। সব বাড়ির জানালা বন্ধ। তারটা খোলা। সহজেই চোখে পড়ে যাবে। কারো মনে হয়ে যেতে পারে– এই বাড়িতে কোন রহস্য আছে। অনিল জানালা বন্ধ করে ভেতরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। ভেতরের দিকে মেস ঘরের উঠানে বিশাল এক কাঁঠাল গাছ। মেসের মালিক কামাল মিয়া প্ৰতিবারই বলেন, গাছ কাটিয়ে ফেলবেন- কোনবারই কাটা হয় না।
সব গাছেরই কিছু নিজস্ব রহস্য আছে। এই গাছেরও আছে। এই গাছে কখনো পাখি বসে না, পাখি বাসা বাধে না। অনিল বারান্দায় দাঁড়িয়ে গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে। গাছের মাথায় রোদ এসে পড়েছে। কাল রাতে বৃষ্টিতে পাতাগুলি ভেজা। সেই ভেজা পাতা রোদে চিকমিক করছে। মনে হচ্ছে গাছটা মাথায় সোনার টােপর পরেছে। কি আশ্চর্য সুন্দর! কি অদ্ভুত সুন্দর! বাবা তার সঙ্গে থাকলে মুগ্ধ হয়ে দেখতেন। বিস্মিত হয়ে বলতেন- আহা রে, আহা রে, কি সুন্দর! কি সুন্দর! এই জিনিসের ছবি আঁকা যাবে না। বুঝলি অনিল, এই জিনিসের ছবি আঁকা খুব সমস্যা।
যে কোন সুন্দর জিনিস দেখলেই সুরেশ বাগচীর প্রথম চিন্তা এটার ছবি আঁকা যাবে কি-না। ভাবটা এ-রকম যেন ছবি আঁকা গেলে তিনি তৎক্ষণাৎ রং তুলি দিয়ে ছবি এঁকে ফেলতেন।
নিয়ে গেলেন। সেটা না-কি একটা দেখার মতো ব্যাপার। যার ছবি আঁকা অসম্ভব। অনিলের বয়স তখন ছয় কি সাত। হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যথা। সুরেশ বাগচী বললেন, কষ্ট হচ্ছে না-কি রে বাবু?
অনিল বলল, বাবু বলবে না।
আচ্ছা যা বলব না। কষ্ট হচ্ছে না-কি রে অনিল?
অনিল বলল, হুঁ।
যে কোন ভালো জিনিস দেখার জন্যে কষ্ট করতে হয়। আয় কাঁধে উঠে পড়া।
পাঁচ মাইল দূরে বিরামপুর দিঘি। মহারাজ কৃষ্ণকান্তর কাটা দিঘি। বীধানো ঘাট। সুরেশ তাঁর ছেলেকে নিয়ে ঘাটে উপস্থিত হলেন। লোকজন কাপড় কাচছে, গোসল করছে। তিনি বললেন, আপনাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, ঘণ্টা খানেকের জন্য দিঘির জল কেউ নাড়াবেন না। নিস্তরঙ্গ জলে আকাশের ছায়া দেখাবার জন্যে আমি আমার পুত্রকে নিয়ে এসেছি। অনেক দূর থেকে এসেছি।
আধাবুড়ো এক লোক বিরক্ত হয়ে বলল, আপনে কেডা?
আমার নাম সুরেশ বাগচী। আমি একজন শিক্ষক। দিঘির জল ঘণ্টা খানেকের জন্যে না নাড়ালে বড় ভালো হয়।
কাজকামের সময় চুপচাপ কে বসে থাকবে বলেন? বিকালে আসবেন।
আচ্ছা, আমরা বরং অপেক্ষা করি। অপেক্ষারও আনন্দ আছে। ক্ষিধে পেয়েছে না-কি রে অনিল?
না।
অতসীকে নিয়ে আসলে ভালো হত। বেচারীর এত শখ ছিল দেখার। ভাবলাম, মেয়ে মানুষ এত দূর হাঁটবে। মেয়ে হলে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হতে হয়। তোর ঘুম পাচ্ছে না-কি? ঝিামাচ্ছিস কেন?
দিঘির ঘাট আর জনশূন্য হয় না। লোকজন আসছেই। দুঘণ্টা বসে থাকার পরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বুম বৃষ্টি। সুরেশ বাগচী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আর হবে না, চল ফিরে যাই।
ছাতা নেই। ভিজতে ভিজতে ফেরা। রাস্তা হয়েছে। পিছল। সুরেশ বাগচীকে ছেলে কাঁধে নিয়ে এগুতে হচ্ছে। তিনি বিড় বিড় করে বলছেন, এ তো বড়ই যন্ত্রণা হয়ে গেল। নিৰ্ঘাৎ জ্বর-জুরি হবে।
তারা বাড়ি পৌঁছল সন্ধ্যা মিলিয়ে যাবার পর। সুরেশ বাগচী বাড়ি পৌঁছে শুনলেন তাঁর মেয়ে সারাদিন কিছু খায় নি। দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছে। সুরেশ বাগচী উদাস গলায় বললেন, ভুল হয়ে গেছে রে মা। তোকে সঙ্গে নেয়া উচিত ছিল। আমরাও কিছু দেখতে পারি নি। আবার যেতে হবে। তখন নিয়ে যাব। গায়ে হাত দিয়ে বলছি রে মা।
অতসী ফুপাতে ফুপাতে বলল, ভেজা হাত সরাও তো বাবা। নিজেরা সব ভালো ভালো জিনিস দেখবে।
ভুল হয়ে গেছে রে মা। বিরাট ভুল হয়ে গেছে। তবে আমরা ভালো জিনিস কিছু দেখতেও পাই নি। বিশ্বাস করা। এবার থেকে ভালো জিনিস যা দেখব, তোকে নিয়ে দেখব।
অনিল কাঁঠাল গাছের মাথার মুকুটের দিকে তাকিয়ে মন ঠিক করে ফেলল। দেশটা ঠিকঠাক হলে এই দেশে যা কিছু সুন্দর জিনিস আছে সে তার বাবাকে আর অতসীদিকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখবে। প্রথম ছয়মাস শুধু ঘুরে বেড়াবে। কোন একটু সুন্দর জিনিসের সামনে বাবাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সে বলবে— বাবা দেখ তো, এর ছবি আঁকা যাবে কি-না। বাবা মাথা নাড়তে নাড়তে বলবেন, অসম্ভব। অতসীদি খিলখিল করে হাসবে। বাবা বিরক্ত হয়ে বলবেন, হাসছিস কেন মা? সৌন্দর্যের একটা অংশ থাকে, কখনো যার ছবি আঁকা যায় না। এই জিনিসটা বুঝতে হবে…
গফুর সাহেবের ঘর থেকে কোরান তেলাওয়াতের সুর ভেসে আসছে। তিনি উঠেন। অন্ধকার থাকতে থাকতে। নামায পড়েন। নামায্যের পরে অনেকক্ষণ কোরান তেলাওয়াত করেন। তার গলার স্বর মিষ্টি। পড়েনও খুব সুন্দর করে। প্রায়ই ভোরে অনিল বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুনে। তার ভালো লাগে। শুধু ভালো লাগে বললে কম হয়, বেশ ভালো লাগে।
গফুর সাহেব দরজা খুলে অনিলকে দেখলেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, রাতে ঘুম হয়েছিল অনিল?
জ্বি।
আমার এক ফোটা ঘুম হয় নি। সারারাত জেগে কাটালাম। খুব খারাপ লাগছে। গত রাতেও ঘুমাতে পারি নি। এভাবে দিন কাটালে তো বাঁচব না। কিছু একটা করা উচিত?
কি করবেন?
তাই তো জানি না। করব কি?
গফুর সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিচু গলায় বললেন, তোমার একটা খবর আছে অনিল। কাল বিকেলে একটা ছেলে তোমার খোজে এসেছিল। অনেকক্ষণ তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আমাকে চিঠি দিয়ে গেছে। খুবই দুঃসংবাদ। তোমাকে দুঃসংবাদটা কীভাবে দেব বুঝতে পারছিলাম না। রাতে এই জন্যেই ঘুম হয় নি। সারারাত চিন্তা করেছি। এখন মনে হচ্ছে দুঃসংবাদটা দেয়া উচিত। সব মানুষেরই দুঃসংবাদ জানার অধিকার আছে। মন শক্ত কর অনিল।
অনিল তাকিয়ে আছে। গফুর সাহেব তার কাঁধে হাত রেখে প্ৰায় অস্পষ্ট গলায় বললেন, তোমার বাবা মারা গেছেন। অনিল। এটা সহজভাবে নেয়ার চেষ্টা কর। আরো অসংখ্য মৃত্যু ঘটবে। এগুলো নিয়ে আমরা এখন কোন কান্নাকাটি করব না। দেশ স্বাধীন হোক। দেশ স্বাধীন হবার পর আমরা চিৎকার করে কাঁদব। নাও চিঠিটা পড়া।
অনিল চিঠি পড়ল। তার চোখ শুকনো। মুখ ভাবলেশহীন। অনিলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গফুর সাহেবের চোখে পানি এসে গেছে। তিনি পাঞ্জাবির প্রান্ত দিয়ে চোখ মুছছেন। অনিল ছেলেটিকে তিনি খুবই পছন্দ করেন। ভদ্র, লাজুক এবং অতি বিনয়ী ছেলে। কোরান পাঠের পর বারান্দায় এলে রোজই এই ছেলেকে দেখেন। একদিন সে লাজুক গলায় বলল, আমি চিঠি পেয়েছি আমার বাবা খুব অসুস্থ। নতুন চাকরি, এরা ছুটি দিচ্ছে না। যেতে পারছি না। আপনি কি আমার বাবা জন্যে একটু প্রার্থনা করবেন?
গফুর সাহেব বললেন, অবশ্যই করব, অবশ্যই। আমি খাস দিলে উনার জন্য দোয়া করব। আলাদা নফল নামায পড়ব। তুমি মোটেও চিন্তা করবে না। দেখি আসি, আসা আমার ঘরে, চা খাও। অনিল তার ঘরে এসে কেঁদে ফেলল।
সেই ছেলে বাবার মৃত্যুসংবাদের চিঠি হাতে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চিঠিটা সে দ্বিতীয়বার পড়ে নি। তার চোখ শুকনো। সে তাকিয়ে আছে কাঁঠাল গাছটার দিকে। কে জানে ছেলেটার মনের ভেতর এখন কি হচ্ছে।
গফুর সাহেব নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। আজকের মতো কোরান পাঠ তিনি শেষ করেছিলেন। এখন আরো খানিকটা পড়তে ইচ্ছা করছে।
আলিফ লাম মীম। জালিকাল কিতাবু লা রাইবা ফীহা, হুদাল্লিল মুত্তাকীন।
ইহা সেই গ্ৰন্থ যাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। যাহা বিশ্বাসীদের পথ প্ৰদৰ্শক।
অনিল ঘরে ঢুকল। জানালা খুলে দিল। অন্ধকার ঘর ক্রমে আলো হয়ে উঠছে। আকাশ পরিষ্কার। ঝকঝকে নীল। বাতাস মধুর। শ্রাবণ মাসের অপূর্ব সুন্দর একটা সকাল।
অনিল কাপড় পরছে। সে রূপেশ্বর রওনা হবে। তার এখন কেন জানি মোটেই ভয় লাগছে না। চুল আঁচড়াবার জন্য চিরুণি খুঁজতে ড্রয়ারে টান দিতেই একগাদা চিঠি বেরিয়ে পড়ল। দুএকটা পড়েছে মেঝেতে। অনিলের কাছে লেখা তার বাবা এবং অতসীদির চিঠি। তার কাছে লেখা তার বাবার শেষ চিঠিটিই সে শুধু সঙ্গে নিয়ে যাবে। বাকিগুলো থাকুক। যেমন আছে শেষ চিঠিতে সুরেশ বাগচী লিখেছেন–
বাবা অনিল,
অত্যন্ত বিষণ্ণ মনে তোমাকে পত্র দিতেছি। চারিদিকের আবহাওয়া আমার ভালো বোধ হইতেছে না। শংকিত বোধ করিতেছি। মন বলিতেছে এই দেশ বড় ধনের কোন বিপর্যয়ের ভিতর দিয়া যাইবে। নিজের জন্যে এবং অতসীর জন্যে আমার কোন চিন্তা নাই। তোমাকে নিয়াই যত ভয়। রাজধানীতে আছ। বিপর্যয়ের প্রথম ধাক্কাটা তোমাদের উপর দিয়াই যাইবে। তুমি ভীতু ধরনের ছেলে, কি করিতে কি করিবে তাহাই আমার চিন্তা। বিপদে মাথা ঠাণ্ডা। রাখিও এবং ঈশ্বরকে স্মরণ রাখিও। তুলিও না- মঙ্গলময় ঈশ্বর তাহার বিরাট জগতের প্রতিটি জীবের কথা ভাবেন। আমাদেরও উচিত তাহার কথা ভাবা।
অতসী ভালো আছে তাহাকে সুপাত্রে সম্প্রদান করা আমার বড় দায়িত্বের একটি। তেমন সন্ধান পাইতেছি না। তাহার বড় মামা কলিকাতা হইতে পত্ৰ দিয়াছেন যেন আমি অতসীকে কলিকাতা নিয়া যাই। সেইখানে পাত্রের সন্ধান করিয়া বিবাহ দিবেন। আমি তাহাতে সম্মত হই নাই। অতসী এই দেশের মেয়ে। এই দেশে তাহার বিবাহ হইবে। এই বিষয়ে তোমার ভিন্ন মত থাকিলে আমাকে জানাইবে।
মোক্তার পাগলি মাঝে মধ্যে তোমার সন্ধানে আসে। কিছু দিন পূর্বে কয়েকটা পাকা কামরাঙ্গা নিয়া আসিয়াছিল। তোমাকে দিতে চায়। একজন পাগল মানুষের ভালবাসার এই প্ৰকাশ দেখিয়া আমার চোখে জল আসিয়া পড়িল। আমি অতসীকে বলিলাম যত্ন করিয়া সে যেন মোক্তার পাগলিকে চারটা ভাত খাওয়াইয়া দেয়। তাহাকে বারান্দায় পাটি বিছাইয়া খাইতে দেওয়া হইল। সে অনেকক্ষণ ভাত মাখাইয়া কিছু মুখে না দিয়া উঠিয়া চলিয়া গেল।
এই পাগল মানুষটি তোমার প্রতি যে ভালবাসা দেখাইল তাহা তুমি স্মরণ রাখিও। আরেকজন মানুষের কথা স্মরণ রাখিও যিনি তোমার প্রতি কোন ভালবাসা দেখাইবার সুযোগ পান নাই। তিনি তোমার মা। তোমার জন্মমুহূর্তেই তাহার মৃত্যু হইয়াছে। মায়েরা সন্তানের জন্যে অসীম ভালবাসা নিয়া আসেন। এই মা সেই অসীম ভালবাসার কিছুই ব্যবহার করিতে পারেন নাই। তাই বলিয়া মনে করিও না সেই ভালবাসা নষ্ট হইয়াছে। এই পৃথিবীতে সবই নশ্বর, কিছুই টিকিয়া থাকে না, কেবল ভালবাসা টিকিয়া থাকে।
যদি কখনো বড় বিপদে পড় ঈশ্বরকে স্মরণ করবে। সেই সঙ্গে তোমার মাকেও স্মরণ করবে। ইহাই আমার উপদেশ। পরম করুণাময় তোমার মঙ্গল করুন।
বাংলা রেস্টুরেন্ট
রেস্টুরেন্টের নাম কিছুদিন আগেও ছিল বাংলা রেস্টুরেন্ট।
এখন নতুন নাম। কায়দে আযম রেস্টুরেন্ট। সাইন বোর্ড ইংরেজি, উর্দু এবং বাংলায় লেখা। সবচে ছোট হরফ বাংলায়। বাঙালিরা এসব দেখছে। কিছু বলছে না। চুপ করে আছে। ছাবিবশে মার্চের পর সবাই অতিরিক্ত রকমের চুপ। রেস্টুরেন্টে ফ্রেমে বাধাই করা আছে বড় বড় অক্ষরে লেখা রাজনৈতিক আলোচনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তার প্রয়োজন ছিল না। রাজনৈতিক আলোচনা কেউ করছে না। মনে হচ্ছে, এ বিষয়ে এখন কারো কোন আগ্রহ নেই।
অনিল কায়দে আযম রেস্টুরেন্টে নাশতা খেতে এসেছে। ভালোমতো খেয়ে নেবে, তারপর রওনা হবে টাঙ্গাইলের দিকে। বাস আছে নিশ্চয়ই। পত্রিকায় বার বার লেখা হচ্ছে- দেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুষ্কৃতকারীর খবরও কিছু আছে, তা ভেতরের পাতায়। নিতান্ত অবহেলায় এক কোণে ছাপা। তবু কি করে জানি এই সব খবরের দিকেই চোখ চলে যায়। অনিল চা খেতে খেতে কাগজ পড়ছে।
প্রথম পাতার খবর হল হাজির হওয়ার নির্দেশ। চোখে কালো চশমা, বগলে ব্যাটিনসহ টিক্কা খানের হাসি হাসি মুখের এক ছবির নিচে লেখা-খ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক কর্নেল ওসমানীকে হাজির হওয়ার নির্দেশ প্ৰদান করেন। সরকারি নির্দেশে বলা হয়–
৪০ নম্বর সামরিক আইন বিধি অনুযায়ী প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে আমি খ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জে. টিক্কা খান এম. পি. কে. পি এসসি- আপনি কর্নেল এম. এ. জি. ওসমানীকে (অবসরপ্রাপ্ত) আপনার বিরুদ্ধে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২১, ১২৩, ১৩১ ও ১৩২ নম্বর ধারা এবং ১০ ও ১৪ নম্বর সামরিক আইনবিধি অনুযায়ী আনীত অভিযোগের জবাব দেয়ার জন্যে ১৯৭১ সালের ২০ শে আগস্ট সকাল আটটার সময় ঢাকার দ্বিতীয় রাজধানীস্থ ১ নম্বর সেক্টরের উপসামরিক আইন প্ৰশাসকের সামনে হাজির হাজির হতে আদেশ দিচ্ছি।
যদি আপনি হাজিরে ব্যর্থ হন তাহলে আপনার অনুপস্থিতিতেই ৪০ নম্বর সামরিক আইন বিধি অনুযায়ী আপনার বিচার হবে।
বাণিজ্য, শিল্প ও আইন মন্ত্রী আখতার উদ্দিন আহমেদ সাহেবেরও একটি ছবি ছাপা হয়েছে টিক্কা খানের ছবির নিচে। মন্ত্রী জনসভায় বলেছেন
আল্লাহ না করুক, পাকিস্তান যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে মুসলমানরা তাদের আলাদা বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলবে এবং হিন্দুদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়বে।
বক্স করে ছাপা হয়েছে- সাবধান, গুজব ছড়াবেন না। আপনার গুজব শক্ৰকেই সাহায্য করে।
দু পৃষ্ঠার খবরের কাগজ এইটুকুতেই শেষ। শেষের পাতায় সামরিক নির্দেশাবলি যা কিছুদিন পর পর ছাপা হচ্ছে। ভেতরের দুপাতার সবটাই বিজ্ঞাপন। এক কোণায় ছোট করে একটা সংবাদ- শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে অস্ত্রশস্ত্ৰ উদ্ধার : কয়েকজন গ্রেপ্তার।
গত রোববার রাতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন অংশে কয়েকটি সফল অভিযান চালিয়ে বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অন্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কয়েক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দেশপ্রেমিক নাগরিকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই অভিযানগুলো চালানো হয়।
গ্রেফতার করা দুটি ছেলের ছবি ছাপা হয়েছে। ছেলে দুটির বয়স কিছুতেই আঠারো উনিশের বেশি হবে না। দুজনেরই হাত পেছন দিকে বাধা। কিন্তু এদের মুখ হাসি হাসি। ছবি তোলার সময় এরা কি সত্যি হাসছিল না। অনিল কল্পনা করছে, এরা হাসছে? এদের নাম দেয় নি, নাম দেয়া উচিত ছিল।
ভাইজান, খবরের কাগজটা দেখি।
অনিল তার সামনে বসা মানুষটির দিকে কাগজ এগিয়ে দিল। সেও সব খবর ফেলে এই খবরটিই পড়ছে। একটা খবর পড়তে এতক্ষণ লাগে না। নিশ্চয়ই বার বার পড়ছে। মানুষটার চোখে-মুখে আনন্দের আভা। পত্রিকা বন্ধ করার পরেও সে আরেকবার খুলল, তাকিয়ে আছে। ছবিটার দিকে। অনিল বলল, কাগজটা আপনি রেখে দেন।
জ্বি-না, দরকার নেই।
রেখে দেন। অন্যকে দেখবেন।
লোকটা হেসে ফেলে চাপা গলায় বলল, দুই বাঘের বাচ্চা, কি বলেন ভাইজান?
অনিল বলল, বাঘের বাচ্চা তো নিশ্চয়ই।
খাটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার। দেখেন চোখ দেখেন। চোখ দেখলেই বোঝা যায়।
অনিল আরেকবার তাকাল। ছেলে দুটির চোখ দেখা যাচ্ছে না। মারের জন্যেই মুখ ফুলে চোখ ভেতরে ঢুকে গেছে। তবু এর মধ্যেই তেজি চোখ এই মানুষটা দেখতে পাচ্ছে। তাই তো স্বাভাবিক। চায়ের দাম দিয়ে অনিল উঠে পড়ল। সে অফিসে যাবে। বড় সাহেবের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে রওনা হবে দেশের দিকে। পৌঁছতে পারবে কি-না তা সে জানে না। চেষ্টা করবে।
কি সুন্দর দিন! কি চমৎকার রোদ! শ্রাবণ মাসের মেঘশূন্য আকাশের মতো সুন্দর কিছু কি আছে? এই রোদের নাম মেঘভাঙা রোদ। রিকশা নিতে ইচ্ছা করছে না। হাঁটতে ইচ্ছা করছে। রাস্তা এখনো ফাকা। তারচেয়েও বড় কথা রাস্তায় কোন শিশু নেই। এখনকার এই নগরী শিশুশূন্য। বাবা-মারা তাদের সন্তানদের ঘরের ভেতরে আগলে রাখছেন। শহর এখন দানবের হাতে। শিশুদের দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।
বড় রাস্তার মোড়ে মেশিনগান বসানো একটি ট্রাক। পাশেই জীপ গাড়ি। বিশাল ট্রাকের পাশে জীপটোকে খেলনার মতো লাগছে। একজন অফিসার কথা বলছেন একজন বিদেশির সঙ্গে। বিদেশির কাঁধে কয়েক ধরনের ক্যামেরা। দুজনের মুখই খুব হাসি হাসি। এই বিদেশি কি একজন সাংবাদিক? কয়েকদিন আগে অনিল পত্রিকায় পড়েছিল, বিদেশি সাংবাদিকদের আহবান করা হয়েছে তারা যেন নিজেদের চোখে দেখে যায় কি সুন্দর পরিবেশ পূর্ব পাকিস্তানে।
এই লোকটি তাই দেখতে আসছে? সুন্দর পরিবেশ দেখে মোহিত হচ্ছে? কিছুটা মোহিত হতেও পারে। রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন। বস্তি নেই। ২৫ শে মার্চেই বস্তি উজাড় হয়েছে। ভিখিরীও নেই। ভিখিরীরা ভিক্ষা চাইতে কেন বেরুচ্ছে না কে জানে? এরা সম্ভবত ভিখিরীদেরও গুলি করে মারছে।
বিদেশি ভদ্রলোক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন অনিলের দিকে। হাত ইশারা করে তিনি অনিলকে ডাকলেন। শুধু অনিল না, আরো কয়েকজনকে তিনি ডেকেছেন। তারা ভয়ে ভয়ে এগুচ্ছে। অনিল এগিয়ে গেল।
সেনাবাহিনীর অফিসারটি ইংরেজি-বাংলা-উর্দু মিশিয়ে যে কথা বলল, তা হচ্ছে ইনি ইউনাইটেড প্রেসের একজন সাংবাদিক। খবর সংগ্ৰহ করতে এসেছেন। তোমাদের যা বলার ইনাকে বল। ভয়ের কিছু নাই। Whatever you want to say, say it. কোই ফিকির নেই। সাংবাদিক ভদ্রলোক একজন দোভাষী নিয়ে এসেছেন। বিহারী মুসলমান। সে কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিচ্ছে। নীল হাওয়াই সার্ট পরে একজন মানুষকে প্রথমে জিজ্ঞাসা করা হল—। প্রশ্নোত্তরের পুরো সময় মুখের সামনে মাইক্রোফোন ধরা থাকল।
আপনার নাম?
আমার নাম মোহাম্মদ জলিল মিয়া।
কি করেন?
আমি একজন ব্যবসায়ী আমার বাসাবোয় ফার্নিচারের দোকান আছে।
দেশের অবস্থা কি?
জনাব অবস্থা খুবই ভালো।
মুক্তিবাহিনী শহরে গেরিলা অপারেশন চালাচ্ছে, এটা কি সত্য?
মোটেই সত্য না।
একটা পেট্রল পাম্প তো উড়িয়ে দিয়েছে।
এগুলো হল আপনার দুষ্কৃতকারী।
আপনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর সন্তুষ্ট?
জ্বি জনাব। এরা দেশ রক্ষা করেছে। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে আপনার কি অভিমত?
তিনি আমাদের ভুল পথে পরিচালনা করেছেন। ইহা উচিত হয় নাই।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
মাইক্রোফোন এবার অনিলের কাছে এগিয়ে আনা হল।
আপনার নাম?
আমার নাম অনিল। অনিল বাগচী।
আপনি কি করেন?
আমি একটা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করি। আলফা ইসুরেন্স।
দেশের অবস্থা কি?
দেশের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ।
কেন বলছেন দেশের অবস্থা খারাপ?
স্যার, আপনি নিজে বুঝতে পাছেন না? আপনি কি রাস্তায় কোন শিশু দেখেছেন? আপনার কি চোখে পড়েছে হাসতে হাসতে, গল্প করতে করতে কেউ যাচ্ছে? শহরে কিছু সুন্দর সুন্দর পার্ক আছে। গিয়ে দেখেছেন পার্কগুলোতে কেউ আছে কি-না? বিকাল চারটার পর রাস্তায় কোন মানুষ থাকে না। কেন থাকে না? স্যার, আমার বাবা মারা গেছেন মিলিটারীর হাতে।
কি করতেন। আপনার বাবা?
তিনি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন।
আপনি কি আওয়ামী লীগের কর্মী?
না, আমি আওয়ামী লীগের কর্মী না।
আপনাকে ধন্যবাদ।
সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে অনিলের দিকে। সবচে বেশি অবাক হয়েছে ফানিৰ্চার দোকানের মালিক। অনিল একবারও মিলিটারী অফিসারের দিকে তাকাল না। তাকে চলে যেতে বলা হয়েছে। সে চলে যাচ্ছে। ভুলেও পিছনে ফিরে তাকাচ্ছে না। সারাক্ষণই মনে হচ্ছে এই বুঝি এক ঝাঁক গুলি এসে পিঠে বিঁধল।
ফানিৰ্চার দোকানের মালিক অনিলের সঙ্গে সঙ্গে আসছে। সে ফিসফিস করে বলল, জানে বাঁচার জন্যে মিথ্যা কথা বলতে হয়। ভাই সাহেব। এতে দোষ নাই। আপনি গলির ভিতর ঢুকে পড়েন। গলির ভিতর ঢুকে দৌড় দিয়া বের হয়ে যান।
অনিল গলির ভিতর ঢুকে পড়ল। ভদ্রলোক রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে লজ্জিত ও বিব্রত মনে হচ্ছে।
অনিল এগুচ্ছে দ্রুত পায়ে। তার মাথায় ঝন ঝন করে বাজছে- বিপদে মিথ্যা বলার নিয়ম আছে। বিপদে মিথ্যার বলার নিয়ম আছে।
সুরেশ বাগচী মিথ্যা বলা বিষয়ে তাঁর ছেলেমেয়েদের একটি গল্প বলেছিলেন। মহাভারতের গল্প। অশোক বনে শৰ্মিষ্ঠা নামের অতি রূপবতী এক রমণী কিছুকালের জন্যে বাস করেছিলেন। একদিন মহারাজ যযাতি বেড়াতে বেড়াতে চলে এলেন অশোক বনে। শৰ্মিষ্ঠা তাকে দেখে ছুটে গিয়ে বললেন, মহারাজ, আমার স্বামী নেই, আমি যৌবনবতী, আপনি আমার সঙ্গে রাত্রিযাপন করুন। আমার ঋতু রক্ষা করুন। যযাতি বললেন, তা সম্ভব না। তোমার সঙ্গে শয্যায় গেলে আমাকে মিথ্যা কথা বলতে হবে। মহা পাপ হবে। শৰ্মিষ্ঠা বললেন,
নন নর্মযুক্তং বচনং হিনস্তি
ন স্তীষু রাজন ন বিবাহকালে
প্ৰাণাত্যয়ে সর্বধনাপাথরে
পঞ্চান্তান্যাহুর পাতকানি
তার মানে হল, পাঁচ অবস্থায় মিথ্যা বললে পাপ হয় না। পরিহাসে, মেয়েমানুষকে খুশি করায়, বিবাহকালে, প্ৰাণ সংশয়ে এবং সর্বস্ব নাশের সম্ভাবনায়। আপনি আমার সঙ্গে রাত্রিযাপন করলে আমাকে খুশি করবেন। কাজেই আপনার পাপ হবে না। এই কথায় মহারাজ যযাতি শৰ্মিষ্ঠার সঙ্গে রাত্রিযাপনে রাজি হলেন।
সুরেশ বাগচী বললেন, গল্পটা কেমন লাগল?
অনিল, অতসী কেউ কিছু বলল না। মহারাজ যযাতির কাজটা কি ঠিক হয়েছে?
অতসী বলল, ঠিক হয় নাই।
হ্যাঁ, ঠিক হয় নাই। ধর্মগ্রন্থে যাই থাকুক কোন অবস্থাতেই মিথ্যা বলা যায় না। বাবারা, এটা যেন মনে থাকে।
অনিল অসম্ভব ভীতু। কিন্তু বাবার চিঠি বুকে নিয়ে সে মিথ্যা বলতে পারছে না। তাকে সত্যি কথাই বলতে হবে। চিঠিটা কি ফেলে দেয়া ভালো না?
আলফা ইসুরেন্স কোম্পানি
আলফা ইসুরেন্স কোম্পানির হেড অফিস মতিঝিলে।
তাদের অফিস ছোট কিন্তু ব্যবসা ভালো। জাহাজের মালামাল ইন্সুরেন্স করাই এই কোম্পানির ব্যবসা। এই ধরনের ব্যবসায় বিশাল অফিস লাগে না। একটা টেলিপ্রিন্টার, আন্তর্জাতিক টেলিফোন লাইন, উপরের মহলের সঙ্গে ভালো যোগাযোগই যথেষ্ট। অল্পকিছু কাজ জানা লোকই যথেষ্ট। কোম্পানির মালিক জোবায়েদ সাহেব। অবাঙালি। ১৯৫০ সনে বিহার থেকে মোহাজের হয়ে বাবামার সঙ্গে ঢাকা এসেছিলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র একুশ বছর। সেই সময় তাঁদের পরিবারের সম্বল ছিল মায়ের আঠারো ভরি সোনার গয়না। মাত্র কুড়ি বছরের ব্যবধানে সেই বিত্ত ফুলে ফেঁপে একাকার হয়েছে। জোবায়েদ সাহেব আলফা ইসুরেন্সের একটা শাখা অফিস খুলেছেন করাচিতে। খুব সম্প্রতি লন্ডনেও একটা অফিস নেয়া হয়েছে। অফিস চালু হবার আগেই ঝামেলা লেগে গেল। তিনি ঠাণ্ডা মাথায় ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ্য রাখছেন। এমনিতেই তার মাথা ঠাণ্ডা। এখন তা আরো অনেক ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
অফিসের কাজকর্ম নেই বললেই হয়। টেলিপ্রিন্টারে খাট খাট বেশ কিছুদিন হল শোনা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক লাইন সব সময় ব্যস্ত। লাইন চাইলেই পাওয়া যায় না। গতকাল সারাদিন অপেক্ষা করে করাচীর লাইন পেলেন। তাও কথাবার্তা পরিষ্কার না। করাচী অফিসের নবী বখশ বলল, বাঙালি কুত্তাগুলোর খবর কি? কুত্তাগুলোর ল্যাজ সোজা হয়েছে?
জোবায়েদ সাহেব প্রসঙ্গ পাল্টে ব্যবসার কথা তুললেন। জানা গেল ব্যবসা মোটামুটি। খুব খারাপ না, আবার ভালোও না। নবী বখশ আবার বাঙালি প্রসঙ্গ তুলল, ইংরেজিতে যা বলল তার বঙ্গানুবাদ হচ্ছে— সব বাঙালি পুরুষগুলোর বিচি অপারেশন করে ফেলে দেয়া দরকার। বিচি ফেলে দিলেই এরা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। বিচি গরম হওয়ায় এরকম করছে। গরম দেশে গরম বিচি ভালো না।
জোবায়েদ সাহেব চিন্তিত বোধ করছেন। পশ্চিমাদের মনোভাব এই হলে ঝামেলা মিটবে না। তারা বাঙালিদের যতটা তুচ্ছ করছে তত তুচ্ছ করার কিছুই নেই। বরং এরা জাতি হিসেবে ভয়ংকর। ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এই বাঙালিগুলোই শুরু করেছিল। যাদের রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না তারা যে পালিয়ে বাঁচল তা গান্ধিজীর জন্যে না। চরকা কাটা, দেশি লবণ খাওয়া এগুলো ফালতু ব্যাপার। ব্রিটিশ সিংহ চরকা ভয় পায় না। ব্রিটিশ সিংহ ভয় পেয়েছিল–ক্ষুদিরাম মার্কা ছেলেগুলোকে।
বাঙালিগুলো মহাঅলস, একটু ভালো-মন্দ খেতে পারলে মহাখুশি, গল্প করার সুযোগ পেলে খুশি, রাজনীতি নিয়ে দুএকটা কথা বলতে পারলে আনন্দে আত্মহারা, নিজের বউ নিয়ে বেড়াতে যাবার সময় আড়চোখে অন্যের স্ত্রীকে একটু দেখতে পারলে মহা আনন্দিত। তবে এদের রক্তের মধ্যে কিছু একটা আছে। বড় কোন গণ্ডগোল আছে। মাঝে মাঝে এরা ক্ষেপে যায়। কিছু বুঝতে চায় না, শুনতে চায় না। সাহস বলে এক বস্তু যে এদের চরিত্রে নেই সেই জিনিস কোথেকে চলে আসে।
জোবায়েদ বুঝতে পারছে সামনের দিন পাকিস্তানিদের জন্যে ভালো না। শুধু ভালো না বললে কম বলা হবে, সামনের দিনগুলো ভয়ংকর। আশ্চর্যের ব্যাপার, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কেউ তা ধরতে পারছে না। এরা এখন মোটামুটি সুপ্ত। দেশ দখলে নিয়ে এসেছে। থানা পর্যায়ে সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। চলে এসেছে মিলিশিয়া, রেঞ্জার পুলিশ। ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে কমান্ডো গ্রুপের সুশিক্ষিত সৈন্য। আরো আসছে। জাহাজ আসছে।
সিগন্যাল কোরের কর্নেল এলাহীর সঙ্গে জোবায়েদ সাহেবের সুসম্পর্ক। কর্নেল এলাহীর এক শালাকে তিনি লন্ডন ব্রাঞ্চের অফিসের দায়িত্ব দিয়েছেন। এলাহী সাহেব মাঝে মাঝে জোবায়েদ সাহেবের অফিসে কফি খেতে আসেন। গল্প-গুজব করে বিদেয় হন। ব্যাপারটা জোবায়েদের পছন্দ না, কারণ শহরের মুক্তিবাহিনী নামক গেরিলারা তৎপর হচ্ছে। কর্নেল এলাহী এখানে আগমন তাদের চোখে পড়তে পারে। অফিসে বোমা মেরে দেয়া বিচিত্র কিছু না। অবশ্যি জোবায়েদ সাহেব জানেন- গেরিলা তৎপরতা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনার এখনো কোন কারণ ঘটে নি। অল্পবয়েসী কিছু ছেলে-পুলে এই কাজটা করছে। গেরিলা জীবনের রোমান্টিক অংশটাই তাদের আকৃষ্ট করছে। তবে এটাকে হেলাফেলা করাও ঠিক না। যুদ্ধে অতি তুচ্ছ ব্যাপারও অবেহলা করতে নেই। ঘোড়ার নালের জন্যে পেরেক ছিল না বলে রাজত্ব চলে গেল। গল্পের রূপক অংশটি অগ্রাহ্য করা ঠিক না।
জোবায়েদ সাহেব ঠিক নটার সময় অফিসে আসেন। তাঁর ঘরে চুপচাপ বসে থাকেন। এক ঘণ্টা পর পর কফি খান। এক কাপ কফি, একটা সিগারেট। বেলা একটার মধ্যে পাঁচটা সিগারেট এবং পাঁচ কাপ কফি খাওয়া হয়। একটা বাজার পাঁচ মিনিট পর তিনি অফিস থেকে বের হন। বাড়ি চলে যান। বাকি সময়টা বাড়িতেই থাকেন। বাড়ি থেকে বের হন না। গত দুমাস ধরে এই তাঁর রুটিন। এক মাস আগে পরিবারের সবাইকে করাচি পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার ধারণা এক সময় হঠাৎ করে পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার চাপ সৃষ্টি হবে। বিমানের টিকিট পাওয়া যাবে না। তাঁর ধারণা সচরাচর ভুল হয় না। তিনি নিজে যাবার কথা ভাবতে পারছেন না। কারণ তাঁর সম্পদ চারদিকে ছড়ানো। সিলেটে চা বাগানে ত্ৰিশ পার্সেন্ট শেয়ার কেনা আছে। দিলখুশা এলাকায় কিনেছেন পাঁচ বিঘা জমি। এই জমি সোনার খনির মতো। বিশ বিঘা জমি নারায়ণগঞ্জে কেনা আছে। একটা ফ্যাক্টরি দেবার কথা ভাবছিলেন। দুটি বাড়িও ঢাকা শহরে তাঁর আছে। সেই তুলনায় করাচিতে কিছুই নেই। তিনি অতি বিচক্ষণ লোক হয়েও এই বড় ভুলটি করেছেন। সম্পদ এই অংশে তৈরি করে যাচ্ছেন।
দেশ যদি সত্যি সত্যি স্বাধীন হয়ে যায় তাহলে কি হবে? ইন্ডিয়া দখল করে নেবে? সেই সম্ভাবনা কতটুকু? এখনো বুঝতে পারছেন না। ইন্ডিয়া কি এত বড় ভুল করবে? মনে হয় না। এই দেশের মানুষগুলোর ইন্ডিয়া প্রসঙ্গে কোন মোহ নেই। যারা ইন্ডিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে, তাদের উপর দেশের মানুষ খানিকটা বিরক্ত বলেই মনে হয়।
বড় সাহেবের দরজার পর্দা ফাঁক করে মোবারক ঢুকল। হাসিমুখে বলল, কর্নেল সাব আয়া।
জোবায়েদ সাহেব বিরক্ত হলেন। তাঁর বিরক্তির কারণ দুটি। এক, কর্নেল সাহেবের সঙ্গে তিনি কথা বলতে চাচ্ছেন না। দুই, মোবারক এখন আর বাংলা বলছে না। মোবারক অবাঙালি কিন্তু কথা বলত বাংলায়। নিখুঁত ঢাকাইয়া বাংলায়। কিছুদিন হল সে আর বাংলা বলছে না। দাঁত বের করে যখন-তখন হাসছে। মনে হচ্ছে পুরো দেশটা সে তার চকচকে গোলাপি শার্টের পকেটে ঢুকিয়ে বসে আছে। এখন নিশ্চিন্ত মনে জর্দা দিয়ে পান খেয়ে ঠোঁট লাল করা যায়।
জোবায়েদ সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, আমাদের কফি দাও।
মোবারক পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে বলল, কফি তুরন্ত আ যায়ে গি।
কর্নেল এলাহী শুধু খালি হাতে আসেন নি। একটা চকলেটের টিন নিয়ে এসেছেন। বিদেশি চকলেট, বেশ দামি জিনিস। তিনি কখনো খালি হাতে আসেন না। এর আগের বার এসেছিলেন আন্তর নিয়ে। তাদের ভেতর কথাবার্তা ইংরেজিতে হল।
এলাহী ঃ তোমার মুখ এমন গম্ভীর কেন? ব্যবসার হাল কি ভালো না?
জোবায়েদ ঃ না। ব্যবসা মন্দা।
এলাহী ঃ খুব সাময়িক ব্যাপার। কয়েকটা দিন যাক, দেখবে ব্যবসা হু হু করে বাড়বে।
জোবায়েদ ঃ কয়েকটা দিন মানে কত দিন?
এলাহী ঃ এই ধর তিন মাস।
জোবায়েদ ঃ তিন মাসে সব ঠিক হয়ে যাবে?
এলাহী ঃ ঠিক তো এখনই হয়ে গেছে। থানায় থানায় আমাদের লোক আছে। এখন হচ্ছে কম্বিং অপারেশন। প্রতিটি মানুষকে এক এক করে দেখা হচ্ছে।
জোবায়েদ ঃ কম্বিং অপারেশনের পর কি হবে?
এলাহী ঃ কি হবে তা কর্তা ব্যক্তিরা ঠিক করবেন। আমি অতি ক্ষুদ্র মৎস্য। তবে আমার যা অনুমান ওদের শায়েস্তা করার পর একটা রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যাওয়া হবে। এক ধরনের আই ওয়াশ আর কি। হা-হা-হা। তখন ওদের যা বলা হবে তাতেই তারা রাজি হবে। দুদু খাবে?— বললে ওরা বলবে, খাব। তোমাক খাবে?- বললেও ওরা বলবে, খাব।
জোবায়েদ ঃ তোমাদের অবস্থা তাহলে ভালো।
এলাহী ঃ ভালো মানে? একসেলেন্ট! Can no be better.
জোবায়েদ ঃ শুনছি। তোমরা মেয়েদের উপর অত্যাচার করছ- এটা কি ঠিক?
এলাহী ঃ কোথেকে শুনিছ? ইন্ডিয়া বেতার?
জোবায়েদ ঃ হ্যাঁ, বিবিসিও বলছে।
এলাহী ঃ তুমি কি আজকাল প্রপাগাণ্ডা। নিউজ শোনা ধরেছ? সবচে বড় ক্ষতি করছে এই সব প্রপাগাণ্ডা। নিউজ।
জোবায়েদ ঃ তাহলে তোমরা মেয়েদের উপর কোন অত্যাচার করছ না?
এলাহী ঃ কিছু কিছু হয়ত হচ্ছে। ওয়ার ফেয়ারে এগুলো হয়। আমরা তো হাড়ুড়ু খেলছি না। যুদ্ধ করছি। এরা আমাদের শত্রুপক্ষ। এই দেশের মেয়েরা তো আমার শ্যালিকা নয়। শ্যালিকাদের সঙ্গেও যেখানে ফষ্টি-নষ্টি করার সুযোগ আছে সেখানে এদের সঙ্গে কেন করা হবে না। তুমি আমাকে বল।
কফি চলে এসেছে। কর্নেল এলাহী কফিতে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির ভঙ্গি করল। জোবায়েদ সিগারেট ধরাল। এই সিগারেটটা বাড়তি। আজ একটার ভেতর ছয়টা সিগারেট খাওয়া হয়ে যাবে। কফিও এক কাপ বেশি খাওয়া হবে। জোবায়েদের বিরক্তি-ভাব বাড়ছে। তিনি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, কর্নেল এলাহী!
বলে ফেল।
তুমি নিজে কি কোন বাঙালি মেয়েকে রেপ করেছ? ঠিকঠাক জবাব দাও। তোমার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। আগুন হাতে নিয়ে মিথ্যা বলাটা ঠিক হবে না।
মিথ্যা বলতে চাচ্ছি। এই ধারণা তোমার হল কেন? মিথ্যা বলার তো তেমন প্রয়োজন দেখছি না। মেয়েদের সঙ্গ পেয়েছি। এবং পাচ্ছি। তবে আমি বাড়ি থেকে মেয়ে ধরে এনে রোপ করি না। উপহার হিসেবে আমার কাছে পাঠানো হচ্ছে।
কারা পাঠাচ্ছে?
এই দেশের মানুষই পাঠাচ্ছে। হা-হা-হা। হিন্দু মেয়েদের সম্পর্কে আমার খানিকটা আগ্রহ ছিল। কামাসূত্রার দেশের কন্যা, না-জানি কি। মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। এরা হচ্ছে মোস্ট অর্ডিনারী। আরেক কাপ কফি দিতে বল। তোমার এখানে দেখি অসাধারণ কফি তৈরি হয়।
জোবায়েদ আরেক দফা কফি দিতে বল। আজ সাত কাপ কফি খাওয়া হবে। সাত কাপ কপি, সাতটা সিগারেট। খুব খারাপ একটা দিনের শুরু হচ্ছে। খুব খারাপ দিন। কর্নেল এলাহী কতক্ষণ এখানে থাকবে বোঝা যাচ্ছে না। মানুষটাকে এই মুহূর্তে অসহ্য বোধ হচ্ছে।
কর্নেল এলাহী!
ইয়েস মাই ফ্রেন্ড।
তুমি কফি খেয়েই বিদেয় হবে। আমার অতি জরুরি কিছু কাজ আছে। তুমি না গেলে তা করতে পারছি না।
অফকোর্স বিদেয় হব। রাতে কি তুমি ফ্রি আছ?
কেন বল তো?
অফিসার্স মেসে ছোট্ট একটা পার্টি হবে। খুব এক্সকুসিভ।
পার্টিতে যেতে বলছ? হ্যাঁ। তোমার মন মরা ভাব কাটানো দরকার। পার্টিতে সেই চেষ্টা সাধ্যমতো করা হবে। সন্ধ্যায় বাসায় থাকবে। আমি নিজে এসে নিয়ে যাব। চমৎকার কফি।
অনিল বড় সাহেবের জন্যে অনেকক্ষণ ধরেই অপেক্ষা করছে। কর্নেল সাহেব বসে আছেন বলে যেতে পারছে না। কয়েকটি কারণে বড় সাহেবের সঙ্গে তার দেখা প্রয়োজন। হাতে টাকা-পয়সা নেই। কিছু যদি পাওয়া যায়। তাছাড়া বড় সাহেবকে সে পছন্দ করে। নিজেও জানে না। চাকরির ইন্টারভ্যু দিতে এসে সে খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। প্রায় কুড়ি জনের মধ্যে তার বিদ্যাই সবচে কম।
ইন্টারভ্যু বোর্ডে জোবায়েদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সঙ্গে কি কোন প্ৰশংসাপত্ৰ আছে?
অনিল প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, একটা আছে কিন্তু আমি স্যার দিতে চাচ্ছি না।
কোন দিতে চাচ্ছেন না?
প্ৰশংসাপত্রটা আমার বাবার দেয়া। আমি কারো কাছ থেকে প্ৰশংসাপত্ৰ জোগাড় করতে পারি নি, কাজেই বাবাই একটা লিখে দিলেন।
কি করেন আপনার বাবা?
স্কুল শিক্ষক।
প্ৰশংসাপত্রটা দেখি।
অনিল খুবই অস্বস্তির সঙ্গে হাতে লেখা কাগজটা এগিয়ে দিল। তার ধারণা ছিল, প্ৰশংসাপত্রটা পড়ে তিনি হেসে ফেলবেন এবং বোর্ডের অন্য মেম্বারদের দেখাবেন। কারণ প্ৰশংসাপত্রে লেখা–
যাহার জন্যে প্ৰযোজ্য
একজন পিতাই তাহার পুত্রকে সঠিক চিনিতে পারেন। মা ভাল চিনিতে পারেন না, কারণ সন্তান নয় মাস গৰ্ভে ধারণ করিবার কারণে মায়ের চিন্তা ভালবাসায় আচ্ছান্ন হইয়া থাকে। ইহাই স্বাভাবিক। একজন পিতা সেই ক্ৰটি হইতে মুক্ত। আমি অনিল বাগচীর পিতা। সে যোগ্যতায় বলিতেছি- আমার পুত্রের ভেতর সততার মতো বড় একটি গুণ পূর্ণ মাত্রায় আছে। সে তেমন মেধাবী নহে। তাহার মেধা সাধারণ মানের। ঈশ্বর মানুষকে পরিপূরক গুণাবলি দিয়ে পাঠান। সেই কারণেই আমার পুত্রের মেধার অভাব পূরণ করিয়াছে তাহার সততা। অন্য কোন গুণ আমি আমার পুত্রের ভিতর লক্ষ্য করি নাই। যাহা লক্ষ্য করিয়াছি তাহাই বলিলাম।
বড় সাহেব প্ৰশংসাপত্ৰ ফিরিয়ে শুকনো গলায় বললেন, আচ্ছা। আপনি যেতে পারেন।
অনিল বাড়ি চলে এল। দশদিনের মাথায় রেজিস্ট্রি ডাকে চিঠি দিয়ে তাকে জানানো হল যে চাকরি দেয়া হয়েছে। তার পোস্টিং হবে লন্ডন ব্ৰাঞ্চে। তবে কাজ শেখার জন্যে তাকে এক বছর ঢাকা অফিসে থাকতে হবে।
অনিল মুখ শুকনো করে বলল, লন্ডনে আমি গিয়ে থাকব কি করে? অসম্ভব। আমি এই চাকরি করব না। মরে গেলেও না।
এই সংসারে না বলে সহজে পার পাওয়া যাবে যায় না। সুরেশ বাগচী স্কুল থেকে রিটায়ার করেছেন। সংসার অচল। অনিলকে ঢাকায় আসতে হল।
মোবারক এসে অনিলকে বলল, কর্নেল সাহেব চলা গিয়া।
অনিল উঠল। বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করবে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। দিনের আলো থাকতে থাকতে টাঙ্গাইল পৌঁছানো দরকার। রাস্তাঘাট কেমন কিছুই জানে না।
জোবায়েদ সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। অনিল বলল, স্যার আসব?
আস।
স্যার, আমি একটু দেশে যাব। ছুটি চাচ্ছি।
দেশে যাবার মতো রাস্তাঘাট কি এখন নিরাপদ?
নিরাপদ না হলেও যেতে হবে। আমার বাবাকে স্যার মিলিটারীরা মেরে ফেলেছে। বোনটা আছে। অন্য এক বাড়িতে।
বস।
অনিল বসল। জোবায়েদ সাহেব নিয়ম ভঙ্গ করে আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমি শুনেছি। রাস্তাঘাট এখন মোটেই নিরাপদ না। আমি শুনেছি বাস থেকে যাত্রীদের নামানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যাদের কথাবার্তায় এরা সন্তুষ্ট হয় না তাদের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় না।
আমিও শুনেছি স্যার।
এই অবস্থায় রিস্ক নেয়া কি ঠিক? বেঁচে থাকাটা জরুরি। ইচ্ছে করে রিস্ক নেয়া বোকামি।
অনিল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার জায়গায় আপনি হলে কি করতেন স্যার? ঢাকায় বসে থাকতেন?
বড় সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, না। আমি রওনা হয়ে যেতাম।
আমি তাহলে স্যার উঠি?
আগামীকাল গেলে কি তোমার চলে? তুমি যদি আগামীকাল যাও তাহলে মিলিটারীর কাছ থেকে আমি একটা পাশ জোগাড় করে দিতে পারি। কর্নেল এলাহী আমার বিশেষ বন্ধু।
মিলিটারীর কাছ থেকে কোন পাশ নেব না স্যার।
ঠিক আছে। তাহলে দেরি কর না, রওনা হয়ে যাও। মে গড বি উইথ ইউ। এক প্যাকেট চকলেট আমার কাছে আছে, এটা নিয়ে যাও।
অনিল হাত বাড়িয়ে চকলেটের টিন নিল।
তোমার নিশ্চয়ই কিছু টাকা পয়সা দরকার। ক্যাশিয়ারকে বলে দিচ্ছি, এক হাজার টাকা নিয়ে যাও। যদি আমরা দুজন বেঁচে থাকি আবার দেখা হবে।
যাই স্যার।
অনিল দরজা পর্যন্ত গিয়ে থমকে দাঁড়াল। জোবায়েদ সাহেব বললেন, কিছু বলবে?
অনিল না সূচক মাথা নাড়ল। জোবায়েদ সাহেব লক্ষ্য করলেন ছেলেটি নিঃশব্দে কাঁদছে। কাঁদুক। কিছুক্ষণ কাঁদুক। তিনি আনিলের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। সান্ত্বনার কিছু বলা দরকার। একটি বাক্যও মনে আসছে না। তিনি আরেকটি সিগারেট ধরালেন। আজ সব গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। তিনি একের পর এক সিগারেট টেনে যাচ্ছেন। মাথা ধরেছে। প্ৰচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।
মোবারক।
ইয়েস স্যার।
কফি।
কফি কামিং স্যার।
ভালো লাগছে না। কিছু ভালো লাগছে না।
বাস শেষ পর্যন্ত ছাড়বে
বাস শেষ পর্যন্ত ছাড়বে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। এগারোটায় এই বাস ছাড়বে এমন কথা ছিল। যাত্রী উঠে বসে আছে। বাস ছাড়ছে না। এখন বাজছে একটা। সমস্যা কি তাও বোঝা যাচ্ছে না। ভূয়াপুর থেকে একটা বাস এসে পৌঁছেছে বারটায়। তার ড্রাইভার কানে কানে অন্য ড্রাইভারকে কি সব বলেছে। ড্রাইভাররা বাস ছাড়ছে না।
অনিল জায়গা পেয়েছে একবারে পেছনের সিটে। এক কোণায় সে, বাকি সবটা জুড়ে এক পরিবার বসে আছেন। বোরকা পরা এক মহিলা, তাঁর স্বামী, এগারো-বারো বছরের একটি মেয়ে। আট বছর বয়েসী দুটি ছেলে, জমজ। অবিকল এক রকম দেখতে। এরা নিঃশব্দ, তবে খুব চালু। নিঃশব্দে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে চলছে। চার বছর বয়েসী একটি বাচ্চা মেয়ে। ভাইদের মারামারি সে আগ্রহ নিয়ে দেখছে এবং খুব মজা পাচ্ছে বলে মনে হয়।
পরিবারের কর্তা বসেছেন অনিলের পাশে। ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশের উপর। তিরিক্ষি মেজারের মানুষ। প্রচুর কথা বলেন। মারামারিরত দুই পুত্রের দিকে তাকিয়ে তিনি হুংকার দিয়ে বললেন, কর মারামারি কর। খামচোখামচি কর। খামচি দিয়ে একজন আরেকজনের চোখ তুলে ফেল। কিন্তু খবরদার, টু শব্দ করতে পারবি না। শব্দ করলে কচুকাটা করে ফেলব। আমার নাম আয়ুব আলি। আমার এক কথা। গলা দিয়ে শব্দ বের করেছিস কি মরেছিস।
বড় মেয়েটি বাবার পাশে বসেছে। সে নিচু গলায় বলল, মা বলছে তার গরম লাগছে। বোরকা খুলে ফেলতে চায়।
খবরদার, বোরকা যেমন আছে তেমন থাকবে। যখনকার যে নিয়ম। এখনকার নিয়ম বোরকা। গরমে সিদ্ধ হলে উপায় কিছু নাই। মিলিটারীকে বলতে বলিস যে গরম লাগছে। মিলিটারী পাংখা দিয়ে হাওয়া করবে।
গাড়ি ছাড়বে কি ছাড়বে না কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। গাড়ির হেল্পার এসে বলে গেলা— নাও যাইতে পারে। সামনে অসুবিধা আছে। মালিক আসন্তাছে। মালিক আসলে উনি যা বলবেন তাই হবে। উনি যাইতে বললে যাব। যাইতে না বললে নাই।
যাত্রীরা সবাই বসে আছে। কেউ নড়ছে না। বোঝাই যাচ্ছে সবারই যাওয়া প্রয়োজন। ড্রাইভারের সিটের ঠিক পেছনে বোরকা পরা দুজন মহিলা যাত্রী যাচ্ছেন। বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক তাদের নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বোরকা পরা মহিলা একজনকে তাল পাখায় ক্রমাগত হাওয়া করছেন। মহিলাটি কাঁদছেন ফুঁপিয়ে। এক সেকেন্ডের জন্যেও থামছেন না। বোরকা পরা অন্য মহিলা গাড়ির জানালায় মাথা রেখে চুপচাপ বসে আছেন। কৌতূহলী যাত্রীরা বেশ কবার জিজ্ঞেস করেছে কি হয়েছে। বৃদ্ধ কঠিন গলায় বলেছেন, কিছু হয় নাই।
পুরো গাড়িতে অনিল ছাড়া যুবক কেউ নেই। যুবকরা বাসে ট্রেনে চলাচল করে না। প্ৰায় স্টেশনেই ট্রেনের কামরা চেক করা হয়। যুবকদের নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। হাতের মাসল টিপে দেখা হয়। হাত শক্ত কি-না। শক্ত হলে অস্ত্ৰ-ট্রেনিং নিয়েছে। সামান্যতম সন্দেহ হলে যুবকরা ফিরে আসে না।
বাসের জন্যেও চেক পোস্ট আছে। মিলিশিয়া নামের এক বস্তুর সম্প্রতি আমদানি হয়েছে। কালো কুর্তা পরে, কোমরে বাধা থাকে গুলির বেল্ট। এরা ইংরেজিও জানে না, উর্দুও জানে না। বিচিত্ৰ ভাষায় কথা বলে। এরা ভয়ংকর চরিত্রের মানুষ এই জাতীয় কথা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কালো পোশাকের মিলিশিয়া চোখে পড়লে মানুষের বুকে ধ্বক করে ধাক্কা লাগে।
আয়ুব আলি বিড়ি ধরালেন। মেয়েটি বলল, বাবা, মা বিড়ি ফেলতে বলছে। বিড়ির গন্ধে মার বমি আসতেছে।
আয়ুব আলি মুখ বিকৃত করে বললেন, বমি আসলে বমি করতে বল। তোর মায়ের হুকুমে এখন দুনিয়া চলবে না। সে জেনারেল টিক্কা খান না।
আয়ুব আলি অনিলের দিকে ফিরে বললেন, ব্রাদার, আপনার কি অসুবিধা হচ্ছে?
না।
আপনার অসুবিধা হলে ফেলে দিতাম। কিন্তু পরিবারের কথায় আমি পয়সায় কেনা বিড়ি ফেলে দিব, তা হয় না। আপনি যাবেন কই?
রূপেশ্বর।
কোন রূপেশ্বর?
অনিল পুরো ঠিকানা বলল।
টাঙ্গাইল পৌঁছতে পৌঁছতেই তো রাত হয়ে যাবে। রূপেশ্বর যাবেন কীভাবে?
রাতে রাতে যাব। হেঁটে চলে যাব।
এইটাই ভালো। রাতে রাতে যাওয়া ভালো। মিলিটারী বলেন আর মিলিশিয়া বলেন সন্ধ্যার পর তারার পাতলা পায়খানা শুরু হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর গলায় গামছা দিয়ে টেনেও এদের বের করতে পারবেন না।
মেয়েটি বলল, বাবা, মা এসব কথা বলতে নিষেধ করতেছে।
তোর মারে চুপ থাকতে বল। কি বলব কি বলব না সেটা আমার বিষয়। ভাই সাহেব, বিড়ি খাবেন?
জ্বি-না।
খেলে খেতে পারেন। এক সুটকেস ভর্তি বিড়ি নিয়ে নিয়েছি। এই যে যাচ্ছি। যদি আটকা পড়ে যাই! কিছুই তো বলা যায় না?
যাচ্ছেন কোথায়?
শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি। আমার এক শ্যালক বিয়ে করবে। আমি বড় জামাই। না গেলে বিয়ে হয় না। তা ভাই বলেন, এটা কি বিয়ের সময়? মাছির মতো মানুষ মরতেছে আর তুই ব্যাটা বউয়ের সাথে…আচ্ছা যা, বিয়ে করবি কর। তা আমি এমন কি রসগোল্লা দুলাভাই যে আমি ছাড়া বিবাহ হবে না। আরো ব্যাটা, আমরা যে তোর কারণে এতগুলা মানুষ যাচ্ছি। যদি পথে ভালো-মন্দ কিছু হয়! ধরা যদি তোর বোনরে মিলিটারী পথে নামায়ে রেখে দেয় তখন কি অবস্থােটা হবে? আমার শ্বশুরবাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ গাধা। একবারে গ আকারে গা, ধ আকারে ধা।
মেয়েটি বলল, বাবা, মা বলছে নিচে গিয়া চা খেয়ে আসতে।
স্ত্রীর এই পরামর্শ আয়ুব আলির মনে ধরল। তিনি তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন। অনিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ব্রাদার, আসেন চা খাবেন। অনিলও উঠে দাঁড়াল। ছেলে দুটির একটি অন্যটির কান কামড়ে ধরেছে। ছেলেদের মা, কান ছাড়াবার চেষ্টা করছেন। আয়ুব আলি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, খেয়ে ফেল। কামড় দিয়ে কান খেয়ে ফেল। যন্ত্রণা কমুক।
আয়ুব আলি নামার সময় সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে কৌতূহলী চোখে তাকে দেখল। ভদ্রলোক ইতোমধ্যেই সবার কৌতূহল আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছেন। ক্ৰন্দনরত বোরকা পরা মহিলার কাছে এসে তিনি থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, মা, কান্নাকাটি যা করার এখন করে নেন। মিলিটারী চেকিংয়ের সময় গলা দিয়ে টু শব্দ বের করবেন না। এরা অনেক কিছু সন্দেহ করে বসতে পারে। শেষে বিপদে পড়ে যাবেন। আর মা যদি কিছু মনে না করেন- ফর্সা পা দেখা যাচ্ছে। যদি মোজা থাকে মোজা পরে নেন। সুন্দরী মেয়ে দেখলে হারামজাদাগুলোর ইস থাকে না। যদি বেয়াদবী কিছু করে থাকি নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন।
বাস স্ট্যান্ডের লাগোয়া দুটি স্টল। দুটিই ফাঁকা। একটিতে রেডিও বাজছে, খবর হচ্ছে খুব চিকণ গলায় একজন মহিলা খবর পড়ছেন ; আয়ুব আলি সেটিতেই ঢুকলেন। অনিল পেছনে পেছনে গেল। রেডিওর প্রধান খবর হল, নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। কোনটিতে কত পানি বাড়ছে তা বলা হল। বন্যার সম্ভাবনা সম্পর্কে বলা হল। উরুগুয়েতে মৃদু ভূমিকম্প হয়েছে। রেক্টর স্কেলে যার মাত্রা ৩.৪, এই তথ্যও জানা গেল। তারপর বলা হতে লাগল নিউ মেক্সিকোতে সড়ক দুঘর্টনায় এগারো ব্যক্তির নিহত হবার সংবাদ।
আয়ুব আলি মুখ বিকৃত করে বললেন, শালা।
অনিল বলল, কাকে বলছেন?
রেডিওটারে বললাম, নিজের দেশের খোঁজ নাই, অন্য দেশে এগারো জন নিহত। আরে শালা, তোর দেশে কয়টা নিহত সেইটা বল।
অনিল হেসে ফেলল এবং খুবই আশ্চর্য হল যে এই অবস্থাতেও সে হাসতে পারছে। তার মধ্যে এই মুহুর্তে কোন দুঃখবোধ আছে বলে মনে হচ্ছে না। পথের বিপদ নিয়েও সে ভাবছে না। কিছুই ভাবছে না। আয়ুব আলি স্টলের মালিকের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলেন, রেডিও বন করেন।
দোকানের মালিক ঠাণ্ডা গলায় বলল, রেডিও খোলা রাখা লাগে। কোন সময় কি বলে জানা দরকার। ধরেন, হঠাৎ কাফুর্ঘ্য দিল তখন কি করবেন? খাইবেন কি চা-নাশতা?
চা দাও। কাপ গরম পানি দিয়া ধুইয়া দিবা। চিনি কম।
যাইবেন কই আপনারা?
তা দিয়া আপনার প্রয়োজন নাই। চা দিতে বলছি চা দেন। চা দিয়া দাম নেন। অধিক কথা বলার সময় এখন না।
রেডিওতে নজরুল গীতি হচ্ছে। নজরুলের প্রেমের গান, নয়ন ভরা জল গো…
বিপ্লবী গানগুলো বাজানো হচ্ছে না। স্বাধীন বাংলা বেতার বাজাচ্ছে বিপ্লবী গান।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নজরুলের প্ৰেম বিষয়ক সংগীতে এমন খুব উৎসাহী। হামদ এবং নাতে উৎসাহী, উচ্চাঙ্গ সংগীতে উৎসাহী।
আয়ুব আলি চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, ভাইসাব, আপনার নামটা তো জানা হল না। নাম জানা দরকার।
আমার নাম অনিল।
কি বললেন, অনিল?
জ্বি, অনিল বাগচী।
খাইছে আমারে। হিন্দু না-কি?
জ্বি।
সাহস তো কম না। হিন্দু হয়ে বাসে করে রওনা দিলেন? চেকিং-এ ধরা পড়বেন। এরা চার কলমা জিজ্ঞেস করে। প্যান্ট খুলে দেখে খৎনা হয়েছে কি-না। জানেন না?
শুনেছি।
আপনার কোন দিকে যাওয়ার দরকার না— যেখানে ছিলেন সেখানে চলে যান। আর যদি ট্রেনে-বাসে যেতে হয় তবে আগে গোপনে খৎনা করায়ে ফেলেন। এর মধ্যে লজ্জা-শরমের কিছু নাই। জান বাঁচান ফরজ। আমি অনেক হিন্দু ছেলের কথা জানি খৎনা করায়ে ফেলেছে। চার কলমা মুখস্থ করেছে। আপনার কলমা কয়টা মুখস্থ?
একটা শুধু জানি।
আমি জানি মোট দুটা। চাপে পড়ে তিন নম্বরটা মুখস্থ শুরু করলামখালি বেড়াছেরা লাগে। তবে দুটা জানলেও চলে, এরাও দুটার বেশি জানে না। একটু সুর দিয়ে, দরদ-টারদ মাখায়ে কেরাতের মতো পড়লেই এরা খুশি। বেকুবের জাত তো। বেকুবের জাত অল্পে খুশি হয়, অল্পে বেজার হয়। ঠিক বললাম না?
জ্বি।
শুধু বেকুব না। এরা হল হায়ওয়ানের জাত। হায়ওয়ান কি জানেন? হায়ওয়ান হল পশু। এরা পশুর জাত। পশু না হলে প্যান্ট খুলে খৎনা কেউ দেখে? বলেন। আপনি, দেখে? এটা কি মানুষের কাজ না পশুর কাজ? আমি তো ঠিক করে রেখেছি। কেউ যদি আমার প্যান্ট খুলতে বলে প্যান্ট খুলব, তারপর হিস করে হারামজাদার মুখে পেশাব করে দেব। এরপর যা হয় হবে। মৃত্যু কপালে থাকলে হবে। কি বলেন?
অনিল কিছু বলল না। আয়ুব আলি বিড়ির প্যাকেট বের করে বললেন, নিন, বিড়ি ধরান। বিড়িতে একটা টান দেন। মাথা পরিষ্কার হোক। হিন্দু মানুষ, সময়মতো হিন্দুস্থানে চলে গেলে ঝামেলা হত না। এতক্ষণ বাড়িতে বসে আরাম করে কচ্ছপের কোরমা খেতেন। ভালো কথা অনিল বাবু, কচ্ছপের কোরমা হয়?
জানি না হয় কি-না।
গভীর আগ্রহ নিয়ে আয়ুব আলি জিজ্ঞেস করলেন, কচ্ছপের মাংস খেতে কেমন? গোসতের মতো না মাছের মতো?
অনিল নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। কথা বলতে ভালো লাগছে না।
সময়টাই খারাপ রে ভাই, সময়টাই খারাপ। কারোর কথা বলতে ভালো লাগে না। আমি তো বলতে গেলে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। চুপচাপ ঘরে থাকি। এর মধ্যে বড় শালার বিয়ে লেগে গেল। আরো ব্যাটা বলদ, এটা বিয়ে করার সময়? বড় শালি আবার একটা বাচ্চা দিয়ে ফেলল। মেয়ে বাচ্চা। নাম রেখেছে পি। আমাকে বলল, দুলাভাই, নামটা সুন্দর না? আমি বললাম, পি আবার কেমন নাম? পিসাব হলেও একটা কথা ছিল। বুঝতাম। ঘন ঘন পিসাব হয় বলে নাম পিসাব। এই শুনে সে আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। মেয়ের আকিকা করেছে আমাকে বলে নাই। কত বড় ছোটলোকের জাত চিন্তা করে দেখেন।
গাড়ি হর্ন দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে। আয়ুব আলি উঠে দাঁড়ালেন। চায়ের দাম অনিল দিতে গেল। তিনি এমনভাবে তাকালেন যেন অত্যন্ত আহত হয়েছেন।
চায়ের দাম দিবেন মানে? আমার কি টাকার শর্ট না-কি? ভাই শুনেন, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আপনিও দেখলাম। আমার মতো কম কথার মানুষ। পথে যদি চেকিং হয়— অনিল বাগচী নাম বলার কোন প্রয়োজন নাই। নাম জিজ্ঞেস করলে বলবেন— মহসিন। মহসিন হল আমার বড় শ্যালকের নাম। যে গাধাটার বিয়ে করছে। ঐ গাধাটার নাম। বলবেন যে আপনি বিবাহ করতে দেশে যাচ্ছেন। কেউ বিয়ে-শাদী করতে যাচ্ছে শুনলে এদের মন একটু নরম হয়। মারধোর করলেও গুলি করে মারে না। নাম মনে থাকবে তো? মহসিন। বিপদের সময় মানুষ আসল নামই ভুলে যায়, আর নকল নাম! গাড়িতে বসে কয়েকবার মনে মনে বলেন- মহসিন, মহসিন, মহসিন। দানবীর হাজি মোহাম্মদ মহসিনের নাম ইয়াদ রাখবেন, তাহলেই হবে।
বাসে উঠে নিজের জায়গায় বসতে বসতে আয়ুব আলি ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ইনি তোমার বড় মামা। ইনার নাম মহসিন।
আয়ুব আলি সাহেবের স্ত্রী বোরকার পর্দা তুলে অবাক হয়ে তাকালেন অনিলের দিকে। আয়ুব আলি বললেন, ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছ কেন? ড্যাব ড্যাব করে তাকানোর কিছু নাই। বোরকার পর্দা ফেল।
আয়ুব আলি সাহেবের যমজ বাচ্চা দুটি এখন মারামারি করছে না। দুজনেরই মুখ এবং হাত ভর্তি চকলেট। ছোট মেয়েটারও মুখ ভর্তি চকলেট। চকলেটের রস গড়িয়ে তার জামা মাখামাখি হয়ে গেছে। বড় মেয়েটা অনিলের দিকে তাকিয়ে বলল, এরা আপনার চকলেটের টিন খুলে ফেলেছে।
অনিল বলল, ভালো করেছে। তুমি চকলেট খাওয়া না? খাও, তুমিও খাও। তোমার নাম কি?
পাপিয়া।
কোন ক্লাসে পড়?
সিক্সে।
খুব ভালো।
পাপিয়া ভয়ে ভয়ে বলল, আমি ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছি।
বল কি? কি কর বৃত্তির টাকা দিয়ে?
কিছু করি না। বাবা টাকা নিয়ে যায়।
খুবই অনুচিত। তোমার নিজের টাকা অন্যে নিয়ে যাবে কেন?
আয়ুব আলি কোন কথা বলছেন না, কারণ কথা বলার মতো অবস্থা তার নেই। তিনি ঘুমিয়ে পড়ছেন। তাঁর নাক ডাকছে।
বাসের ড্রাইভার বলল, সবাই বিসমিল্লাহ বলেন। গাড়ি ছাড়তেছি।
সবাই শব্দ করে বলল, বিসমিল্লাহ।
গাড়ি ছেড়ে দিল।
ছোট্ট একটা শিশু কাঁদছে। দুমাস বয়স। সেই তুলনায় গলার শক্তি প্ৰশংসনীয়। শিশুটির কান্নার আওয়াজ ছাপিয়ে উঠেছে। বাবা এবং মা দুজনেই তাকে নিয়ে খুব বিব্রত বোধ করছে। এটিই তাদের প্রথম সন্তান। কপালে বড় করে কাজলের ফোটা দেয়া। সেই কাজলে সমস্ত মুখ মাখামাখি হয়ে গেছে। বাচ্চাটির বাবা তাকে কিছুক্ষণ কোলে রেখে শান্ত করার চেষ্টা করছে, কিছুক্ষণ করছে মা। লাভ হচ্ছে না।
একজন বলল, ছোট শিশু সঙ্গে থাকা ভালো। শিশুর উপর আল্লাহপাকের খাস রহমত থাকে। এই শিশুর কারণে ইনশাআল্লাহ কারো কিছু হবে না। আমরা জায়গামতো নিরাপদে পৌঁছাব।
বাবার মুখে আনন্দের আভা দেখা গেল। মার মুখেও নিশ্চয়ই আনন্দের হাসি। বোরকার কারণে সে হাসি দেখা যাচ্ছে না। বাচ্চার কান্না এখন আর কারো খারাপ লাগছে না, বরং ভাল লাগছে। কাঁদুক সে, কাদুকা। গলা ফাটিয়ে কাঁদুক।
একজন জিজ্ঞেস করল, ছেলে না মেয়ে?
বাবা লাজুক গলায় বলল, মেয়ে?
কি নাম রেখেছেন মেয়ের?
বাবা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, মুক্তি। বলেই অস্বস্তি নিয়ে চারদিকে তাকালেন। সেই অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ল যাত্রীদের সবার চোখে-মুখে।
ভালো নাম কি?
ভালো নাম ফারজানা ইয়াসমিন।
মিলিটারী নাম জিজ্ঞেস করলে ভালো নামটা বলবেন। ডাক নাম বলার প্রয়োজন নাই।
বাচ্চাটা কান্না থামিয়েছে।
বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গের বোরকা পরা মহিলার কান্না শোনা যাচ্ছে। বৃদ্ধ তাকে এখন আর পাখার হাওয়া করছেন না। গাড়ির ভেতর প্রচুর হাওয়া। বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। মনে হচ্ছে তিনিও ঘুমিয়ে পড়েছেন। আকাশে মেঘ দেখা যাচ্ছে। রোদে তেজ নেই। বাতাস আর্দ্র, বৃষ্টি আসবে বলে মনে হচ্ছে। রাস্তা ভালো না, গাড়ি খুব ঝাঁকুনি দিচ্ছে। ঝাঁকুনিতে অনেকেরই ঘুম পেয়ে যাচ্ছে।
যাত্রীদের প্রায় সবার হাতেই কিছু না কিছু বই। বেশ কয়েকজনের হাতে কোরান শরীফ। অনেকের হাতে প্রচ্ছদে কায়দে আযমের ছবিওয়ালা বই। এ সব বই এখন খুব বিক্রি হচ্ছে। এসব বই হাতে থাকলে একধরনের ভরসা। পাওয়া যায়। মনে হয়, বিপদ হয়ত বা কাটবে।
প্ৰচণ্ড গরমে সুৰ্যটে পরা একজন বাসযাত্রী যাচ্ছেন। লাল রঙের টাই, থ্রি পিস সুট। কোটের পকেটে লাল গোলাপের কলি। তেকোনা লাল রুমাল। সঙ্গে একটা ব্রিফকেস। তিনি ব্রিফকেস কোলে নিয়ে বসেছেন। এক মুহুর্তের জন্যেও হাতছাড়া করছেন না। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতে গেলেন বখশি হাট বাজারের কাছে তাকে নামিয়ে দেয়া যাবে কি-না। তখনো ব্রিফকেস হাতে ধরা। ভদ্রলোককে খুব নার্ভাস মনে হচ্ছে, খুব ঘামছেন। একটু পর পর রুমাল দিয়ে মুখ মুছছেন, ঘাড় মুছছেন। জানোলা দিয়ে ঘন ঘন থুথু ফেরছেন। তাঁর সঙ্গে পানির বোতল আছে। মাঝে মাঝে বোতল থেকে পানি খাচ্ছেন।
এই প্ৰচণ্ড গরমে সুট পরে আসার রহস্য হল তিনি শুনছেন মিলিটারীরা ভদ্রলোকদের তেমন কিছু করে না। সুট পরা থাকলে খাতির করে। তারপরেও তিনি ঢাকা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে এসেছেন। চিঠিতে লেখা–
— মোহাম্মদ সিরাজুল করিম, পিতা মৃত বদরুল করিম, গ্রাম বখশি হাট, আমার পরিচিত। সে পাকিস্তানের এজন খাদেম। দেশ ভক্ত এক ব্যক্তি। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় সে জীবন কোরবান করতে সর্বদা প্ৰস্তৃত। আমি তাহার সর্বাঙ্গিণ মঙ্গল কামনা করি। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
এত কিছু পরেও ভদ্রলোক স্বস্তি পাচ্ছেন না। এক সময় দেখা গেল। গাড়ির জানোলা দিয়ে মুখ বের করে তিনি বিকট শব্দে বমি করছেন।
ঝাঁকুনি খেতে খেতে গাড়ি এগুচ্ছে। গাড়ির গতি বেশি না। এত খারাপ রাস্তায় গতি বেশি দেবার প্রশ্ন উঠে না।
ঢাকা থেকে বেরুবার মুখেই একটা চেকপোস্ট। চেকপোষ্টে মিলিশিয়ার কিছু লোকজন। ড্রাইভার গাড়ির গতি কমিয়ে দিল। যাত্রীরা শক্ত হয়ে বসে আছে। কেউ জানালা দিয়ে তাকাচ্ছে না। গাড়ির ভেতর কোন রকম শব্দ নেই। শুধুমাত্র ঘুমন্ত আয়ুব আলির নাক ডাকার শব্দ আসছে। বোরকা পরা মহিলাও কান্না থামিয়েছেন।
মিলিশিয়াদের একজন হাত ইশারা করে গাড়ি চালিয়ে যেতে বলল। কেউ এসে গাড়ির ভেতর উঁকি পর্যন্ত দিল না। কি অসীম সৌভাগ্য! গাড়ি চলতে শুরু করেছে। ছোট বাচ্চাটি কাঁদতে শুরু করেছে। কাঁদুক। ছোট বাচ্চারা তো কাঁদবেই।
রাস্তা এখন কিছুটা ভালো। ড্রাইভার গাড়িতে স্পীড দিতে শুরু করেছে। তাকে দ্রুত যেতে হবে। সন্ধ্যার আগে আগে টাঙ্গাইল পৌঁছতে হবে।
মুক্তি কাঁদছে। হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদছে। মুক্তি যার নাম, অবরুদ্ধ নগরীতে যার জন্ম, সে তো কাঁদবেই। কাদাটাই তো স্বাভাবিক।
আয়ুব আলি
আয়ুব আলি অনিলের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছেন। তাঁর ছোট মেয়েটি অনিলের কোলে, সেও ঘুমুচ্ছে। আয়ুব আলি সাহেবের স্ত্রী বোরকার পর্দা তুলে ফেলে কৌতূহলী হয়ে চারপাশে দেখছেন। তাঁর মুখভর্তি পান। এরা বেশ সুখে আছে বলেই অনিলের মনে হল।
এই দেশ ছেড়ে সময়মতো চলে যেতে পারলে অনিলরাও কি সুখে থাকত? ১৯৬৫ সনে ইন্ডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধ লেগে গেল। তখন অনেকেই চলে গেল। অনিলের ছোট কাকা বরুণ বাগচী তাদের একজন। রূপেশ্বরে তিনি পাকা বাড়ি তুলেছিলেন, দোতলা বাড়ি। বাড়ির পেছনে পুকুর। চুপি চুপি সব বিক্রি করলেন। কেউ কিছুই জানল না। যে কিনল সেও কোন শব্দ করল না।
ছোট কাকার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খুব ভালো ছিল না। টুকটাক ব্যবসা করেই কি করে যেন ধাই করে একদিন তিনি বড়লোক হয়ে গেলেন। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক কমে গেল। তবু যাওয়া-আসা ছিল। কিন্তু তারা যে সব বিক্রি করে কোলকাতায় চলে যাচ্ছে এই সম্পর্কে কিছুই বলে নি। যে-রাতে যাবে সে-রাতে বরুণ বাগচী একা তাদের বাড়িতে বেড়াতে এল। তেমন শীত না, তবু সারা শরীর চাদরে ঢাকা।
সুরেশ বাবু বাংলা ঘরে বসে ছাত্র পড়াচ্ছিলেন, সেখান থেকেই বললেনকি খবর বরুণ?
তোমার সাথে একটু কথা আছে দাদা। ভেতরে আস।
ছাত্র পড়াচ্ছি তো।
একদিন ছাত্র না পড়ালে তেমন ক্ষতি হবে না। জরুরি কথা।
সুরেশ বাগচী অপ্ৰসন্ন মুখে উঠে এলেন। বরুণ গম্ভীর গলায় বলল, তোমার পুত্ৰ-কন্যাদেরও ডাক। কথাবার্তা সবার সামনেই হোক। এরা ছোট হলেও এদেরও শোনা দরকার। নয়ত বড় হয়ে আমাকে দোষ দিবে।
তোর ব্যাপার তো কিছুই বুঝতেছি না।
বরুণ বসল খাটে পা তুলে। তার গলার স্বর এমনিতেই ভারী। সে রাতে আরো বেশি ভারী শোনাল।
তোমরা ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার কথা কিছু ভাবছ? সুরেশ বাবু অবাক হয়ে বললেন, শুধু শুধু ইন্ডিয়া চলে যাবার কথা ভাবব কেন?
অনেকেই তো যাচ্ছে।
অনেকেই কেন যাচ্ছে তাও তো বুঝি না।
কেন বুঝছ না? বেশিদিন মাস্টারি করলে মানুষের বুদ্ধি লোপ পায় জানি, এতটা পায় তা জানতাম না।
মাস্টারির দোষ দেয়ার প্রয়োজন নাই। তুই কি বলতে চাস বল।
বরুণ চাপা গলায় বলল, এই দেশ আমাদের থাকার জন্য না।
কেন না? তুই তো ভালোই আছিস। ব্যবসা-বাণিজ্য করছিস। দোতলা দালান দিয়েছিস।
তা দিয়েছি মনের শান্তির বিনিময়ের দিয়েছি। মনে শান্তি নাই।
শান্তি না থাকার মতো কি হল?
দাদা, তুমি বুঝতে পারছ না, এই দেশে আমরা সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন।
সুরেশ বাগচী হাসতে হাসতে বললেন, নিজেকে সেকেন্ড ক্লাস ভাবলেই সেকেন্ড ক্লাস। তুই এ রকম ভাবছিস কেন? আমাকে দেখ। আমি তো ভাবি না।
দাদা, সত্যি করে বল তো— তুমি কোন রকম অনিশ্চয়তা বোধ করা না?
না করি না। কেন করব?
কি আশ্চর্য কথা! একটা প্রশ্ন করলেই তুমি উল্টা প্রশ্ন করছ। আমি তো তোমার ছাত্র না।
তোর হয়েছে কি সেটা বল।
দাদা, তোমাকে সত্যি কথা বলি, এই দেশে মনটা ছোট করে থাকতে হয়।
যার মন ছোট, সে যে দেশেই যাক তার মন ছোটই থাকবে।
খবরের কাগজে দেখেছি। আরতীবালা নামের এক মেয়েকে কিছু প্রভাবশালী লোক ধরে নিয়ে গেছে, সাতদিন পর ছেড়েছে?
শুধু হিন্দু মেয়েদের এ রকম হচ্ছে তা তো না, মুসলমান মেয়েদের বেলায়ও হচ্ছে। হচ্ছে না? এমন যদি হত শুধু হিন্দু মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঘটছে তাহলে ভিন্ন কথা হত। তা ঘটছে না। আরতীবালাকে নিয়ে খবরের কাগজে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। ব্যাপারটা সবার খারাপ লেগেছে বলেই হয়েছে।
এটা একটা জঘন্য দেশ দাদা।
তুই যেখানে যাচ্ছিস সেটা কি খুব উন্নত কিছু? সেখানে এমন হচ্ছে না? সমস্যা তো দেশের না, সমস্যা মানুষের। দেশ মন্দ হয় না। মাটি কি কখনো মন্দ হয়?
বরুণ রাগী গলায় বলল, আমাকে এসব বড় বড় কথা বলবে না। দাদা। আমার এসব বড় বড় কথা শুনতে বিরক্তি লাগে।
আচ্ছা ঠিক আছে, আর বড় বড় কথা বলব না। তুই একটু সহজ হয়ে বসতো। তোর মাথা গরম হয়েছে। গা থেকে গরম চাদরটা খোল। লেবুর সরবত খাবি? অতসী তোর কাকাকে লেবুর সরবত করে দে।
আমি কিছু খাব না।
তুই কি অকারণে রাগোরাগি করার জন্যে এসেছিস?
বরুণ কঠিন গলায় বলল, দাদা, আমি ঠিক করেছি- কোলকাতা চলে যাব।
কি বললি?
শুনলেতো কি বললাম। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কোলকাতা চলে যাব।
সুরেশ বাবু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। আমি কিছু বললে তো সিদ্ধান্ত পাল্টাবি না। আমাকে বলা অর্থহীন।
তোমাকে বলছি, কারণ তোমাকে খবরটা জানানো দরকার।
আচ্ছা যা, আমি জানলাম।
তোমাকে সবাই স্যার স্যার করে, খাতির করে, কাজেই তুমি আছ একটা ঘোরের মধ্যে। আসল সত্য তোমার অজানা। এই দেশের সেনাবাহিনীতে কোন হিন্দু নেয়া হয় না, এটা তুমি জান?
না, জানতাম না।
এখন তো জানলে। এখন বল কি বলবে?
এরা যে নিচ্ছে না। এটা এ-দেশের মানুষদের বোকামি। দেশের সব সন্তানের সমান অধিকার। অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এক ধরনের ভুল। সেই ভুলের জন্য দেশকে কেন দায়ী করব?
কাকে দায়ী করবে?
যেসব মানুষ এই ভুল করছে তাদের দায়ী করব।
শুধু দায়ী করবে, আর কিছু না?
ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব যেন তারা ভুল বুঝতে পারে।
ঈশ্বর সঙ্গে সঙ্গে তোমার প্রার্থনা শুনবেন?
শোন বরুণ, আমি বুঝতেই পারছি না কেন তুই এত রেগে আচ্ছিস কেউ কি তোকে কিছু বলেছে?
না। দাদা, আমি চলে যাচ্ছি।
সেটা তো শুনলাম। কবে যাচ্ছিস?
আজই যাচ্ছি। আজ রাত এগারোটায়।
সুরেশ বাগচী দীর্ঘসময় চুপ করে থেকে বললেন, আজ রাত এগারোটায় তুই চলে যাচ্ছিস আর আমাকে সে-খবর দিতে এখন এসেছিস? বাড়িঘর কি করবি?
বাড়িঘর বিক্রি করে দিয়েছি।
কখন বিক্রি করলি?
মাস খানিক হল। সব চুপি চুপি করতে হল। জানাজানি হলে সমস্যা হবে।
আমাকেও জানালি না!
একজন জানলে সবাই জানবে।
সুরেশ বাগচী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, এই দেশের কাউকেই তুই বিশ্বাস করিস না। শ্রীরামকৃষ্ণের একটা কথা আছে না? কচ্ছপের মতো মানুষ। তুই হচ্ছিস সে রকম। কচ্ছপ থাকে জলে কিন্তু ডিম পাড়ে ডাঙ্গায়। তুই থাকিস এক দেশে আর মন পড়ে থাকে অন্য দেশে। কাজেই তোর চলে যাওয়াই ভালো। তবে তুই যে শেষ সময়ে আমাকে খবরটা দিতে এলি তাতে মনে দুঃখ পেয়েছি।
তোমাকে আগে বললে লাভটা কি হত?
সুরেশ বাগচী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কোন লাভ হত না। যাচ্ছিস যা। ঐখানে মন টিকবে না। মানুষ গাছের মতো। মানুষের শিকড় থাকে। শিকড় ছিড়ে যাওয়া ভয়ংকর ব্যাপার। গাছ ছিড়লে যেমন মারা যায়, মানুষও মারা যায়। গাছের মৃত্যু দেখা যায়। মানুষেরটা দেখা যায় না। তুই দুঃখ পাবি।
দুঃখ তুমিও পাবে দাদা। দুদিন পর বুঝবে কি বোকামি করেছ। হিন্দুমুসলমান দাঙ্গা লাগবে, ঘরে আগুন দিবে।
এইটা কখনো হবে না। বরুণ। আমি কোনদিন এদের অবিশ্বাস করি নি। এরাও করবে না। তুই এখন যা, তোর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না।
বরুণ তারপরেও চুপ করে খানিকক্ষণ বসে রইল। তাকাল অতসীর দিকে। নিচু গলায় বলল, অতসী, আমি কি অতসীকে নিয়ে যাব?
ওকে নিতে চাস কেন?
ওরা ভালো বিয়ে দেব। এই দেশে ওর জন্যে ছেলে পাবে না।
তুই চলে যা বরুণ। এগারোটার সময় যাবি দশটা প্ৰায় বাজে।
তুমি আজ বুঝতে পারছ না। দাদা। একদিন বুঝবে। মর্মে মর্মে বুঝবে।
বরুণ চলে গেল। সুরেশ বাবু বারান্দায় সারা রাত বসে রইলেন। সেই রাতে তিনি উপবাস দিলেন। বিগড়ে গেলে শরীরকে কষ্ট দিয়ে মন ঠিক করতে হয়। সুরেশ বাগচী ঠিক করলেন আগামী দিনও তিনি নিরন্তু উপবাস দেবেন।
বাসের ঝাঁকুনিতে অনিলেরও ঘুম পেয়ে গেল। ঘুমের মধ্যেই মনে হল, সে দিন ছোট কাকার সঙ্গে দেশ ছেড়ে চলে গেলে তার এই বিপদ হত না। বাবা বেঁচে থাকতেন। তবে অনিল এও জানে, কোন উপায়ে সে যদি বাবাকে জিজ্ঞেস করতে পারত- বাবা, তোমার কি মনে হচ্ছে দেশ ছেড়ে গেলে তোমার জন্যে ভালো হত? থেকে যাওয়াটা বোকামি হয়েছে। তাহলে তিনি জবাব দিতেন— অনিল, এই বিপদ কোন ব্যক্তিবিশেষের উপর আসে কি, সারা দেশের উপর এসেছে। আমার মৃত্যু এমন কোন বড় ব্যাপার না বাবা। তাছাড়া তোমার হেড স্যার কি তোমাকে লেখেন নি আমার মৃত্যু সংবাদে রূপেশ্বরের হাজার হাজার মানুষ চোখের জল ফেলেছে। মানুষের ভালবাসায় আমার মৃত্যু। এই দুর্লভ সৌভাগ্য কজনের হয়?
সবাই এক সঙ্গে হৈ হৈ করে উঠল
সবাই এক সঙ্গে হৈ হৈ করে উঠল। বাস প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি খেয়ে বাম দিকে খানিকটা হেলে টাল মাটাল অবস্থা এগুচ্ছে। ড্রাইভার প্রাণপণে ব্রেক করতে করতে বলল, হারামির পুত তোর মারে আমি…
বাসের একটা টায়ার ফেটে গেছে, দুর্ঘটনা পারত ঘটে নি। ফাঁকা রাস্তা বলেই সামলোনো গেছে। হেল্পার বলল, সব নামেন, গাড়ি খালি করেন। যার যার পিসাব করার দরকার পিসাব করেন।
অনিল নামল। আয়ুব আলি সাহেবের কনিষ্ঠ কন্যাকে কোলে বসানোয় অনিলের পায়ে ঝি ঝি ধরে গেছে। একটু হাঁটাহাঁটি করা দরকার। এত ঝাঁকুনিতেও আয়ুব আলির নেমে পড়েছে। শুধু মহিলারা গাড়িতে বসা। অনিলের সঙ্গে পাপিয়ার নামার ইচ্ছা ছিল। বাবার ভয়ে নামতে পারে নি।
অনিল ঘাসের উপর বসে সিগারেট ধরিয়েছে। সিগারেটে টান দিয়ে সে টের পেল আজ। সারা দিনে দুকাপ চা ছাড়া খায় নি। সিগারেটের ধোঁয়া পেটে পাক দিচ্ছে, বমি ভাব হচ্ছে। ভয়ংকর সময়েও ক্ষুধা নামক বিষয়টি মানুষের সঙ্গ ছাড়ে না। ফাঁসির আসামী ফাঁসির তিন ঘণ্টা আগে খেতে চায়। ফাঁসির আসামীকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়— শেষ ইচ্ছা কি? বেশির ভাগই না-কি খাবারের কথা বলে।
সুট পরা ভদ্রলোক হাতে ব্রিফকেস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। ভদ্রলোক তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে। একটা ট্রাক হর্ন দিল। তিনি ভয়ানক চমকে উঠলেন। অনিল তাঁর দিকে তাকাতেই তিনি সরে গেলেন। মনে হচ্ছে তিনি কারো সঙ্গে কথা বলতে চান না।
মহসিন সাহেব। এই মহসিন।
অনিল তাকাল। আয়ুব আলি তাকেই ডাকছেন। অনিলের মনে ছিল না তার নতুন নামকরণ হয়েছে। আয়ুব আলি বাস থেকে নেমেছেন। এখন তার চোখের সান গ্ৰাস। এই সানগ্রাস আগে ছিল না।
মহসিন।
আমাকে বলছেন?
আপনাকে ছাড়া কাকে বলব? এর মধ্যে ভুলে গেছেন? শুনে যান। এদিকে, আর্জেন্ট কথা আছে।
অনিল এগিয়ে গেল। আয়ুব আলি গলার স্বর অনেকখানি নামিয়ে বললেন, অবস্থা খুব খারাপ।
কেন?
দুই বোরকাওয়ালীর সঙ্গে এক বুড়ো আছে না? এরা বিহারী!
কে বলল আপনাকে?
আপনারা সব নেমে গেলেন। হঠাৎ শুনি এই দুই বোরকাওয়ালী বেহারী ভাষায় কথা বলছে। শুনেই বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। আমি তো সহজ পাত্র না, কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- আপনারা কি বিহারী? কথা বলে না। অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। এখন কি করা যায় বলেন তো?
করার কি আছে?
বোকার মতো কথা বলবেন না। স্পাই যাচ্ছে বুঝতে পারছেন না। আমি কান্না দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম— এটা বাঙালির কান্না না। একেক জাতির কান্না একেক রকম। বাঙালির কান্না বিহারী কাঁদতে পারে না। কিছু একটাতো করা দরকার।
আপনি চুপচাপ থাকুন। কিছুই করার নেই।
আমিও তাই ভাবছিলাম। পথে মিলিটারী, কিছু করা ঠিক হবে না। টাঙ্গাইলে নেমে না হয় বুড়োকে কানে ধরে উঠ-বোস করাবো। ঘরের শত্রু বিভীষণ।
অনিল কিছু বলল না। শরীরটা খারাপ লাগছে। এতক্ষণ বমি-বমি ভাব ছিল, এখন সত্যি বমি আসছে। বমি করে ফেলতে পারলে শরীরটা বোধ হয় ভালো লাগত। বমি হওয়ার জন্যেই অনিল আরেকটা সিগারেট ধরাল।
মহসিন সাহেব।
জ্বি।
ট্রিকস করে বুড়ো কাছ বুড়োর কাছ থেকে জানিব না-কি ব্যাপারটা কি?
কি দরকার?
তাও ঠিক। কি দরকার? তার উপর আবার বুড়ো মানুষ। জোয়ান হলে পাছায় লাথি দিয়ে নালায় ফেলে দিতাম।
বাসের চাকা বদল করা হচ্ছে। জ্যাকে কি এক সমস্যা। জ্যাক উপরে উঠছে না। ড্রাইভার এবং হেল্লার দুজনেই অনেক কায়দা-কানুন করছে। লাভ হচ্ছে না। পাপিয়া জানোলা দিয়ে হাত ইশারা করে তার বাবাকে ডাকল। অপ্ৰসন্ন মুখে আয়ুব আলি এগিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন তার চেয়েও অপ্ৰসন্ন মুখে। থু করে একদলা থুথু ফেলে বললেন, মেয়েছেলে সঙ্গে নিয়ে কোথাও যাওয়াই উচিত না। কথায় আছে না- পথে নারী বিবর্জিতা। এসব কথাতো আর এমি এমি লোকজন বানায় না। দেখে শুনে বিচার বিবেচনা করে বানায়।
কি হয়েছে?
পাপিয়ার মা না-কি আসার সময় পানি বেশি খেয়েছিল, এখন বাথরুমে যাওয়া দরকার। তার জন্যে পাকিস্তানে গভর্নমেন্ট পথের মাঝখানে বাথরুম বানিয়ে বসে আছে। আমি পাপিয়ার মাকে বললাম- চুপ করে বসে থাক। একটা কথা না। বেশি কথা আমি নিজে বলি না, বেশি কথা শুনতেও পছন্দ করি না।
অনিল বলল, বাস এখানে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে বলে মনে হয়। কাছেই একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে সেখানে নিয়ে গেলে হয়।
কে নিয়ে যাবে, আমি?
আপনি যেতে না চাইলে আমি নিয়ে যাই।
মহসিন সাহেব, আপনার বয়স অল্প। আপনাকে একটা কথা বলি। মেয়েছেলের সব কথার গুরুত্ব দিবেন না। গুরুত্ব দিয়েছেন তো মরেছেন। এদের কথা এক কান দিয়ে শুনবেন, আরেক কান দিয়ে বের করে দেবেন। আচ্ছা এই শালারা একটা চাক্কা বদল বদল করতে গিয়ে ছয় মাস লাগিয়ে দিচ্ছে ব্যাপার কি?
অনিল, আয়ুব সাহেবের স্ত্রী, তাঁর দুই কন্যা এবং হাতাহাতি বিশারদ দুই পুত্রকে নিয়ে রাস্তার ওপারে বাড়িটার দিকে এগুচ্ছে। ভদ্রমহিলা পুরো ব্যাপারটায় খুব লজ্জা পাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর মেয়ে দুটি বাস থেকে বের হতে পেরে উল্লসিত। তারা ক্ৰমাগত কথা বলে যাচ্ছে। সেই সব কথা বোঝার উপায় নেই। অল্প বয়স্ক বালিকাদের যেসব কোড ল্যাংগুয়েজ আছে তাই ব্যবহার করা হচ্ছে। ছেলে দুটি নীরব।
ভদ্রমহিলা কিছুটা গ্ৰাম্য টানা টানা স্বরে বললেন, পাপিয়ার বাবা আপনারে বিরক্ত করতেছে?
অনিল বলল, না।
ভদ্রমহিলা নিচু গলায় বললেন, আপনে কিছু মনে নিয়েন না। মানুষটা পাগলা কিসিমের কিন্তু অন্তর খুব ভালো।
মনে করার কিছু নেই।
কথা বেশি বলে কিন্তু বিশ্বাস করেন। খুব ভালো মানুষ।
আমি বিশ্বাস করছি। কেন বিশ্বাস করব না।
পাপিয়া বলল, ছোট বেলায় বাবার টাইফয়েড হয়েছিল। তার পর থেকে বাবা কথা বেশি বলে।
পাপিয়ার মা, কড়া গলায় বললেন, চুপ কর।
সম্পন্ন গৃহস্তের টিনের বাড়ি। কিন্তু বাড়িতে কোন মানুষ জনের সাড়া নেই। অনেক ডাকাডাকি পর কমলা শ্রেণীর একজন লোক বের হয়ে এল। তার কাছ থেকে জানা গেল রাস্তার দুপাশে অনেক দূর পর্যন্ত বাড়ি ঘরে কোন মানুষ থাকে না। রাস্তা দিয়ে মিলিটারী যাতায়াত করে। বেশ কয়েকবার ট্রাক থামিয়ে তারা রাস্তার আশেপাশের বাড়ি-ঘরগুলিতে ঢুকেছে।
অনিল বলল, বাড়িতে ঢোকে কি চায়?
লোকটা কিছু বলল না। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল।
অনিল বলল, ওরা কি টাকা পয়সা চায়?
না। মেয়েছেলের সন্ধান করে।
সে কি?
অছিমদ্দিন মেম্বার সাহেবের বউ আর ছোট শালীরে ট্রাকে উঠায়ে নিয়া গেছে। তারার আর কোন সন্ধান নাই।
অছিমদিন মেম্বার সাহেবের বাড়ি কোনটা?
বাড়ি দূর আছে। এই খান থাইক্যা ধরেন চাইর মাইল।
মিলিটারী কি রোজই যাতায়াত করে?
হুঁ। যাতায়াত বাড়ছে।
বাসের চাকা লাগানো হয়ে গেছে। বাস হর্ন দিচ্ছে। বৃষ্টিও পড়তে শুরু করেছে। বাসে ফিরতে ফিরতে সবাই আধভেজা হয়ে গেল। বাস যখন ছাড়ল তখন মুষল ধারে বৃষ্টি। দুহাত দূরের জিনিস দেখা যায় না। এমন অবস্থা। আয়ুব আলি আনন্দিত গলায় বললেন, বৃষ্টিটা নেমেছে আল্লার রহমতের মতো। বৃষ্টিতে মিলিটারী বের হবে না। চেকিং ফেকিং কিছু হবে না। হুস করে পার হয়ে যাব।
বাস চলছে খুব ধীরে। উইন্ড শিল্ড দিয়ে কিছু দেখা যাচ্ছে না, ধীরে চলা ছাড়া উপায় নেই। আয়ুব আলি বললেন, আমি সামনে গিয়ে বসি, এইখানে খুব বাকুনি। মহসিন সাহেব। আপনি পা তুলে আরাম করে বসেনতো।
অনিল পা তুলে বসল। তেমন আরাম হল না। ক্ষুধা কষ্ট দিচ্ছে। শরীর ঝিম ঝিম করছে। আয়ুব আলি সাহেবের স্ত্রী, বোরকার পর্দা তুলে দিয়েছেন। স্বামী পাশে নেই এখন একটু সহজ হওয়া যায়। তিনি অনিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, পান খাইবেন?
না।
একটাখান। মিষ্টি পান। জর্দা দেওয়া নাই।
অনিল পান হাতে নিল। ভদ্রমহিলা সুখী সুখী গলায় বললেন, ভাইয়ের বিয়ায় যাইতেছি। শ্রাবণ মাসের দশ তারিখ বিবাহ।
আমি শুনেছি।
মেয়ে খুব সুন্দরী। ছবি আছে দেখবেন?
দেখি।
ও পাপিয়া তোর নতুন মামীর ছবি দেখা।
পাপিয়া ছবি দিল। পাপিয়ার মা হাসি মুখে বললেন, গায়ের রঙ খুব পরিষ্কার, ছবিতে তেমন আসে নাই।
পাপিয়া বলল, তুমিতো দেখ নাই মা। সব শোনা কথা।
ছোট চাচা দেখছেন। ছোট চাচা বলছেন- বক পাখির পাখনার মতো গায়ের রঙ। ছোট চাচা মিথ্যা বলার মানুষ?
অনিল ছবির দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। কি সুন্দর ছবি। গোলগাল মুখ। মাথাটা বা পাশে হেলানো। বেণী বাঁধা চুল। টানা টানা চোখে রাজ্যের বিস্ময় ও আনন্দ। সামান্য ছবি এত কিছু ধরতে পারে?
সুন্দর না?
হ্যাঁ সুন্দর। খুব সুন্দর।
আমার ভাইও সুন্দর। ও পাপিয়া তোর মামার ছবি দেখা।
পাপিয়া আগ্রহ করে মামার ছবি বের করল। অনিলের এই ছবিটি দেখতে ইচ্ছে করছে না। অসম্ভব রূপবতী তরুণীর পাশে কাউকে মানাবে না। পৃথিবীর সবচে রূপবান তরুণকেও তারপাশে কদাকার লাগবে। কি আশ্চর্য মেয়েটাকে এখন অতসীদির মতো দেখাচ্ছে। অবিকল অতসীদির হাসির মতো হাসি। অতসীদির চোখের মতো চোখ। অতসীদির মতোই গোল মুখ। কে জানে হয়ত এই মেয়েটার নামও অতসী। অনিল পাপিয়াকে বলল, তোমার নতুন মামীর নাম কি?
পাপিয়া হাসতে হাসতে বলল, অহনা।
কি নাম বললে, অহনা?
জ্বি। আমার আব্বা বলে— গহনা। হিহিহি…
অনিলের এই সুখী পরিবারটিকে ভালো লাগছে। অসম্ভব ভালো লাগছে।
সবচে দুঃখের সময় আনন্দময় কল্পনা করতে হয়। সুরেশ বাগচী বলতেন, বুঝলি অতসী মানুষ কি করে জানিস? সুখে সময় সে শুধু সুখের কল্পনা করে। একটা সুখ তাকে, দশটা সুখের কথা মনে করিয়ে দেয়। দুঃখের সময় সে শুধু দুঃখই কল্পনা করে। এটা ঠিক না। উল্টোটা করতে হবে।
অতসীদি বলতো, তুমি বুঝি তাই করা?
সব সময় পারি না। তবে চেষ্টা করি। খুব আনন্দের কিছু যখন ঘটে তখন তোর মার কথা ভাবি। ইস বেচারী এই আনন্দ দেখার জন্যে নেই.. তখন চোখে জলে এসে যায়।
খুব আনন্দের কিছু কি তোমার জীবনে ঘটে বাবা?
অবশ্যই ঘটে। কেন ঘটবে না।
আমিতো আনন্দের ঘটনা কিছু দেখি না। কবে ঘটল বলতো? একটা ঘটনা বল।
ঐতো সেদিনের কথাই ধর। তোরা দুই ভাই বোন খুব হাসাহাসি করছিস। দেখে আমার মনটা আনন্দে ভরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তোর মার কথা ভাবলাম। একা একা খানিকক্ষণ কাঁদলাম।
বাবা, তোমার কি কোন গোপন দুঃখ আছে?
সুরেশ বাগচী হাসতে হাসতে বললেন, না মা আমার সব প্রকাশ্য দুঃখ। তোর বুঝি সব গোপন দুঃখ?
অতসী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। তারপরেই খিলখিল করে হেসে ফেলল।
অনিল তার দিদির অনেক গোপন দুঃখের খবর জানা না। শুধু একটি জানে। সেই দুঃখটা ভয়াবহ ধরনের। এই দুঃখের কথা পৃথিবীর কাউকেই জানানো যাবে। না। কোনদিন এটা নিয়ে আলোচনাও করা যাবে না। এই দুঃখ দূর করারও কোন উপায় নেই। কিছু গোপন দুঃখ আছে যা চিরকাল গোপন থাকে।
অতসীদির বিয়ের কথা উঠলে সে বলবে, আমি কিন্তু বিয়ে করব না। শুধু শুধু তোমরা চেষ্টা করছ।
কেন করবে না দিদি?
কেন করব না সে কৈফিয়ত তোর কাছে দিতে হবে? তুই কে? তুই কি আমার গুরু মশাই? করব না করব না, ব্যাস।
বিয়ে যদি ঠিকঠাক হয়ে যায় তুই কি করবি?
আমি তখন ছেলেটাকে দশ লাইনের একটা চিঠি লিখব। বিয়ে ভেঙে যাবে।
অনিল ঠিক জানে না। তবে তার অনুমান অতসীদি এ রকম একটা চিঠি লিখেছে। নয়ত নেত্রকোনার উকিল সাহেবের ছেলের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে যেত না। সব ঠিক ঠাক। ওদের মেয়ে খুব পছন্দ। পণের কোন ব্যাপার নেই। উঁকিল সাহেব বিনা পণে ছেলের বিয়ে দেবেন। তাদের বংশের এরকম ধারা। ছেলের মা এবং বোনরা এসে আশীৰ্বাদ করে গেল। ছেলের মা অতসীকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন এবং বললেন, এই মেয়েটাতো মানুষ না। এতো দেবী দুৰ্গা। এখন থেকে আমরা এই মাকে আমি দুৰ্গা ডাকব।
সেই বিয়ে ভেঙে গেল। ছেলে সুরেশ বাগচীকে লোক মারফত একটি চিঠি পাঠাল। তাতে লেখা
প্ৰণাম নিবেন। বিশেষ কারণে আমার পক্ষে বর্তমানে বিবাহ করা সম্ভব হইতেছে না। আপনি কিছু মনে করিবেন না। আমি অত্যন্ত দুঃখিত।
সুরেশ বাগচী বিস্মিত হয়ে বললেন, ব্যাপারটা কি? আমিতো কিছুই বুঝলাম না। ব্যাপারটা কি?
বাস হর্ন দিচ্ছে। যাত্রীরা সচকিত হয়ে উঠেছে। সামনেই মিলিটারী চেক পোস্ট। দুজন মিলিটারী রেইন কোট গায়ে রাস্তায় দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। পরিষ্কার দিন।
মুক্তি চেঁচিয়ে কাঁদছে
মুক্তি চেঁচিয়ে কাঁদছে। তাকে কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না। মুক্তির বাবা মুক্তিকে কাঁধে নিয়ে দুলাচ্ছেন। কান্না কমার বদলে তাতে তার কান্না আরো বেড়ে যাচ্ছে।
সুট পরা ভদ্রলোক আবার বমি করছেন। এবার বমি করছেন গাড়ির ভেতর। তিনি গাড়ি প্ৰায় ভাসিয়ে দিয়েছেন। বিকট শব্দ হচ্ছে।
কালো পোশাক পরা একজন মিলিশিয়া উঁকি দিল। তার চেহারায় যথেষ্ট মায়া আছে। গলার স্বরও কোমল, অথচ সে কুৎসিত একটি বাক্য বলল, শোয়ার কি বাচ্চা, সব উতারো। ছব্বিশ জন্য যাত্রী এই বাসে। ছাব্বিশ জনের ভেতর একজনও বলতে পারল না- কেন অকারণে গালি দিচ্ছেন। সবাই এমন মুখ করে আছে যেন এই গালি তাদের প্রাপ্য। শুধু আয়ুব আলির চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। আয়ুব আলির স্ত্রী চাপা গলায় বললেন, তোমার পায়ে ধরি। তুমি উল্টাপাল্টা কিছু বলব না। আমি তোমার পায়ে ধরি। ভদ্র মহিলা সত্যি সত্যি স্বামীর পা চেপে ধরলেন। প্রায় কেঁদে ফেলে বললেন, পুলাপানের কসম লাগে, উল্টাপাল্টা কিছু বলব না।
মহিলা যাত্রী ছাড়া বাকি সবাইকে লাইন করে দাঁড় করানো হয়েছে। স্যুট পরা ভদ্রলোক শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। তিনি ঝকঝকে স্যুট নিয়ে কাদার উপর বসে আছেন। তার হেঁচকি উঠছে। ব্রিফকেস এখনো তার হাতে ধরা।
অনিল লক্ষ্য করল তল্লাশির পুরো ব্যাপারটা মিশিটারীরা এক ধরনের খেলার মতো নিয়েছে। মজার কোন খেলা, যেখানে থেকে আনন্দ পাওয়া যায়। অন্তত এরা সবাই যে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করছে তা বোঝা যাচ্ছে। সবার ঠোঁটের কোণেই হাসি কিংবা হাসির আভাস। এরা নিজেরা তীব্ৰ ভয়ের মধ্যে আছে। অন্যের ভয় থেকে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা তারা করবে, তা বলাই বাহুল্য। ভীত মানুষকে আরো বেশি ভয় পাইয়ে দেবার প্রবণতাও মানুষের মজ্জাগত।
মিলিটারী দলের প্রধান একজন অল্পবয়স্ক অফিসার। তিনি দূরে একটা টুলে বসে আছেন। এখানে কি হচ্ছে না হছে তা নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই, এরকম একটা ভাব। তল্লাশি দলের সঙ্গে একজন দোভাষী থাকে। এদের সঙ্গেও আছে। এই দোভাষী বিহারী নয়, বাঙালি। চল্লিশ পায়তাল্লিশ বছর বয়েসী একজন মানুষ। সার্ট প্যান্ট পরা। চোখে চশমা। তাকেও খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছে। সে খানিকটা দূরে বসে কলা খাচ্ছে। তার সামনে একটা মগ। মগভর্তি চা।
তল্লাশি দল সুট পরা মানুষটার কাছে চলে এল। তাকেই যে প্রথম জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তা বোঝাই যাচ্ছিল।
একজন সুবাদার শীতল গলায় বলল, ডরতা কেউ?
লোকটি সুন্দর উর্দুতে বলল, ভয় পাচ্ছি না। আমার শরীর খারাপ। কয়েকবার বমি হয়েছে। এই জন্যে দাড়াতে পারছি না।
কথাবার্তা সব উর্দুতে হল।
তুমি বাঙালি?
জ্বি জনাব বাঙালি।
না?
নাম।
আবু হোসেন।
কলেমা জান?
জি। চার কলমা জানি।
নামায পড়?
নামায পড়ি।
উর্দু কোথা শিখেছি?
আমরা ছোট বেলায় রাওয়ালপিন্ডি ছিলাম। বাবা রেলওয়েতে কাজ করতেন।
বাবার নাম কি?
ইসমাইল হোসেন।
তুমি পাকিস্তান ভালবাস?
জি বাসি।
ব্রিফকেসে কি আছে?
কিছু কাগজপত্ৰ আছে। জমির দলিল।
ব্রিফকেস খোল।
ব্রিফকেসের চাবি আনতে ভুলে গেছি জনাব।
সুবাদারের মুখ শক্ত হয়ে গেল। সে পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা একজনকে কি যেন বলল। উর্দু নয় অন্য কোন ভাষায়। সম্ভবত পশতু। সে ব্রিফকেস নিয়ে গেল। ব্রীফকেস ভাঙা হতে লাগল। পুরো দলটি গভীর আগ্রহে ব্রিফকেস ভাঙা দেখছে। তাদের সবার চোখে মুখে স্পষ্ট আনন্দের ছাপ। টুলে বসে থাকা অফিসারও আগ্রহ বোধ করছেন। তিনি উঠে এসেছেন ব্রীফকেস ভাঙা দেখতে। সুট পরা লোকটি আবার বমি করছে। হড় হড় করে বমি। তার বমির দৃশ্যেও মিলিটারীর দল আগ্রহ বোধ করছে। এতেও যেন তারা খানিকটা মজা পাচ্ছে।
ব্রিফকেস ভাঙা হয়েছে। একটা জমির দলিল, কিছু কাগজপত্র, দাড়ি সেভ করার যন্ত্রপাতি, একটা গায়ে মাখা সাবান। খামে ভরা কিছু টাকা। উল্লেখযোগ্য পরিমাণের নয়। ছয় সাত শ হবে। মিলিটারীর তল্লাশি দলটির আশা ভঙ্গ হল। অফিসারটিও বিরক্ত হয়েছেন। তিনি কঠিন গলায় বললেন, এ মুসলমান কি-না ভালোমতো জিজ্ঞেস কর। চেহারা হিন্দুর মতো।
অফিসারের কথায় দলটির মধ্যে আবার খানিকটা আগ্রহ দেখা গেল। সুবাদার বলল, কলেমায়ে শাহাদৎ বল।
আবু হোসেন গড় গড় করে কলেমায়ে শাহাদৎ বলল।
খাৎনা হয়েছে?
জি।
প্যান্ট খোল।
আবু হোসেন অতি দ্রুত খুলে ফেলল। যেন এর জন্যেই সে অপেক্ষা করছিল। প্যান্ট খুলে দেখাতে পেরে যেন খানিকটা আরাম পাচ্ছে। বিপদ বুঝি-বা কাটল। সুবাদার বলল, যাও ক্যাপ্টেন সাহেবকে দেখিয়ে আসা। আবু হোসেন প্যান্ট খোলা অবস্থাতেই ক্যাপ্টেন সাহেবের সামনে গেল। ক্যাপ্টেন সাহেব উদাস দৃষ্টিতে একবার তাকালেন, তারপর হাত ইশারায় চলে যেতে বললেন। আবু হোসেন তার ভাঙা ব্রিফকেস নিয়ে বাসে উঠল এবং তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। এমন শান্তির ঘুম সে অনেকদিন ঘুমায় নি।
জিজ্ঞাসাবাদ এখন বেশ তাড়াতাড়ি হচ্ছে। দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করেই ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। কারোর প্যান্ট খোলা হচ্ছে না। একজনকে শুধু বলা হল একশ বার কানে ধরে উঠ- বোস করতে। এবং যতবার উঠে দাঁড়াবে ততবার বলবে, জয় বাংলা।
শুধুমাত্র একজন যাত্রীর জন্যে এটা কেন করা হল তা বোঝা যাচ্ছে না। সম্ভবত মজা করার জন্যেই। উঠ-বোসের পর্ব সুষ্ঠুভাবে অগ্রসর হচ্ছে। যাকে উঠ-বোস করতে বলা হয়েছে, সে এই কাজটি বেশ আগ্রহ নিয়ে করছে বলে মনে হল।
ক্যাপ্টেন সাহেব তেমন আগ্রহ বোধ করছেন না। তার চোখ বিষণ্ণ।
অনিল এবং আয়ুব আলি লাইনের শেষ মাথায়। সুবাদার সাহেব অনিলের পাশে এসে দাঁড়াল। বাঙালি দোভাষীর চা খাওয়া শেষ হয়েছে। সে এসে সুবাদারের কাছে দাঁড়াল।
কি নাম?
অনিল। অনিল বাগচী।
হতভম্ব আয়ুব আলি বললেন, ঠিক নাম বলেন। ঠিক নামটা স্যারকে বলেন। স্যার ইনার আসল নাম মোহাম্মদ সাহসিন। বাপ মা আদর করে অনিল ডাকে।
তোমার নাম মোহাম্মদ মহসিন?
অনিল চুপ করে রইল। আয়ুব আলি বড়বড় করে বললেন, আমার খুবই পরিচিত স্যার। দূর সম্পর্কের রিলেটিভ হয়। খাঁটি মুসলমান।
বাঙালি দোভাষী বলল, অনিল হইল হিন্দু নাম।
আয়ুব আলি হাসি মুখে বললেন, একুশে ফেব্রুয়ারির জন্যে এটা হয়েছে ভাইসাহেব। বাপ মারা আদর করে ছেলেমেয়েদের বাংলা নাম রাখে। যেমন ধরেন- সাগর, পলাশ। ছেলেপুলের তো কোন দোষ নাই, বাপ মায়ের দোষ।
বাঙালি দোভাষী এবার যথেষ্ট আগ্ৰহ বোধ করছে বলে মনে হল। সে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে বলল, এই দুইটাই হিন্দু। মিথ্যা কথা বলতেছে।
অনিল বলল, ইয়েস স্যার।
তুমি মুক্তিবাহিনীর লোক?
না স্যার।
আওয়ামী লীগ?
না।
মুজিবের পা-চাটা কুকুর। মুজিবের পা কখনো চেটে দেখেছ? কেমন লাগে পা চাটতে?
অনিল চুপ করে রইল। ক্যাপ্টেন বললেন, একে ঘরে নিয়ে যাও।
আয়ুব আলি ব্যাকুল গলায় বললেন, স্যার আমার একটা কথা শুনেন স্যার। যে কেউ একবার কলেমা পড়লেও মুসলমান হয়ে যায়। এটা হাদিসের কথা। মহসিন কলেমা জানে। তারে জিজ্ঞেস করেন। সে বলবে।
ক্যাপ্টেম আয়ুব আলির দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন, তুমি নিজে মুসলমান?
জ্বি জনাব, মুসলমান। সুন্নি মুসলমান। আমরা পীর বংশ। আমার দাদা মরহুম মেরাজ উদ্দিন সরকার পীর ছিলেন।
বাঙালি দোভাষী বলল, এই হারামীও হিন্দু। বিরাট ধড়িবাজ।
আয়ুব আলির চোখ শক্ত হয়ে গেল। তিনি ঘাড় ফিরিয়ে বাসের দিকে তাকালেন। বাস থেকে এখানকার কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে না। তবে বাসের প্রতিটি মানুষ ভীত চোখে এই দিকেই তাকিয়ে আছে। আয়ুব আলি সাহেবের স্ত্রী এবং বড় মেয়েটি কাঁদতে শুরু করেছে। সবচে ছোট মেয়েটি জানালায় হাত বাড়িয়ে ভীত গলায় বলছে- আকবু আসি, আরু আস।
বাঙালি দোভাষী আয়ুব আলির দিকে তাকিয়ে বলল, প্যান্ট খোল। প্যান্ট খুলে দেখা খৎনা হয়েছে কিনা। স্যারকে দেখা।
আয়ুব আলি কঠিন গলায় বললেন, প্যান্ট যদি খুলতে হয় তাহলে আমি তোর মুখে পিসাব করে দেব। আল্লার কসম আমি পিসাব করব।
অনেকক্ষণ পর ক্যাপ্টেন মনে হয় কিছুটা মজা পেলেন। তিনি শব্দ করে হেসে ফেললেন। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে অন্যরাও হেসে ফেলল। শুধু বাঙালি দোভাষী হাসল না। সে অন্যদের হাসির কারণও ঠিক ধরতে পারছে না। সে বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ। ক্যাপ্টেন আয়ুব আলির দিকে তাকিয়ে বললেন, যাও, গাড়িতে গিয়ে উঠ।
আয়ুব আলি বললেন, স্যার মহসিন সাহেবকে নিয়ে যাই?
ও থাকুক। তোমাকে উঠতে বলেছি, তুমি উঠ।
আয়ুব আলি ব্যথিত চোখে অনিলের দিকে তাকালেন। অনিল শান্ত গলায় বলল, আমার বড় বোন আছেন রূপেশ্বর হাই স্কুলের হেডমাস্টার সাহেবের বাড়িতে…
আয়ুব আলি অনিলের কথা শেষ করতে দিলেন না। ছেলে মানুষের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন কসম খেয়ে বলতেছি, আপনার যদি কিছু হয় আমি আপনার বোনকে দেখব, যতদিন বাঁচব দেখব। বিশ্বাস করেন আমার কথা। বিশ্বাস করেন।
আমি আপনার কথা বিশ্বাস করছি। আপনি আমার বোনকে বলবেন, আমি ভয় পাই নাই। আর তাকে বলবেন আমি বলে দিয়েছি- সে যেন তার পছন্দের ছেলেটাকে বিয়ে করে। কে কি বলে এটা নিয়ে সে যেন চিন্তা না করে।
আয়ুব আলি গাড়িতে উঠলেন। তাঁর স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের কান্না আরো বেড়ে গেল। বড় মেয়েটি বাবাকে জড়িয়ে ধরে আছে। সে থর থর করে কাঁপছে।
বাস ছেড়ে যাবার আগ-মুহুর্তে ক্যাপ্টেন সুবাদারের দিকে তাকিয়ে বললেন, সুট পরা লোকটাকে রেখে দাও। ঐটাও বদমাশ। ওর কিছু একটা মতলব আছে- টের পাওয়া যাচ্ছে না।
আবু হোসেন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে বাসের হ্যান্ডেল ধরে আছে। কিছুতেই তাকে টেনে নামানো যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে তার গায়ে অসুরের শক্তি। জীবন থাকতে সে বাসের হ্যান্ডেল ছাড়বে না। আবু হোসেন হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে— ভাইসাহেব, আপনারা আমাকে বাঁচান। ভাইসাব, আপনারা সবে মিলে আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন।
আবু হোসেনকে নামানো হয়েছে। সে হাত পা ছড়িয়ে রাস্তার পাশে পড়ে আছে। বাস ছেড়ে দিয়েছে। ক্যাপ্টেন হাই তুললেন। সুবাদারকে বলল, এই দুজনকে নদীর পাড়ে নিয়ে যাও।
এখন নিব?
না রাতে। রাতই ভালো।
ক্যাপ্টেন আবার হাই তুললেন। তার ঘুম পাচ্ছে।
খুব জ্যোৎস্না হল সে রাতে
খুব জ্যোৎস্না হল সে রাতে। উথাল-পাথাল জ্যোৎস্নার ভেতর তারা অনিলকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আবু হোসেনকে নেয়া হচ্ছে না। কারণ তাকে নেয়ার প্রয়োজন নেই। মুগ্ধ হয়ে জ্যোৎস্না দেখতে দেখতে অনিল যাচ্ছে। দোভাষী বাঙালি যাচ্ছে তার পাশে পাশে। অনিল তাকে বলল, কি সুন্দর জ্যোৎস্না হয়েছে দেখেছেন? এই সৌন্দর্যের ছবি আঁকা সম্ভব নয়। সৌন্দর্যের একটি অংশ আছে যার ছবি আঁকা যায় না।
প্ৰচণ্ড জ্যোৎস্নার কারণেই বোধ হয় কাকদেয় ভেতরে এক ধরনের চাঞ্চল্য দেখা গেল। তারা ডাকতে লাগল- কা- কা- কা।