হাসব?-কুসুম জিজ্ঞাসা করিল।
কেন, হাসবে কেন?
কুসুম হাসিয়া বলিল, আমার হাসি দেখলে আপনার মন নাকি জুড়িযে যায়? তাই শুধোচ্ছি।
শশী বলিল, তামাশা করার জন্যে তোমায় এখানে ডাকিনি বউ।
আহা, তা তো জানি না তামাশাই করলেন চিরকাল, তাই ডাকলে মনে হয় তামাশা করার জন্যেই বুঝি ডেকেছেন। বসি তবে বসে শুনি কীজন্য ডাকলেন!
শশী বলিল, একথা কী করে বললে বউ, চিরকাল তোমার সঙ্গে তামাশা করেছি?
তামাশা নয়? তবে ঠাট্টা বুঝি?
শশী একটু রাগ করিয়া বলিল, তোমার কী হয়েছে বুঝতে পারছি না বউ।
কুসুম তবু হালকা সুর ভারী করে না। বলিল, কী করে বুঝবেন? মেয়েমানুষের কত কী হয়, সব বোঝা যায় না। হলেই বা ডাক্তার! এ তো জ্বরজ্বালা নয়।
শশী জ্বালা বোধ করে। এ কী আশ্চর্য যে কুসুমকে সে বুঝিতে পারে না, মৃদু স্নেহসিঞ্চিত অবজ্ঞায় সাতবছর যার পাগলামিকে সে প্রশ্রয় দিয়াছিল? শশীর একটা দুর্বোধ্য কষ্ট হয়। যা ছিল শুধু জীবনসীমায় বহিঃপ্রাচীর, হঠাৎ তার মধ্যে একটা চোরা দরজা আবিস্কৃত হইয়াছে, ওপাশে কত বিস্তৃত, কত সম্ভাবনা, কত বিস্ময়। কেন চোখ ছলছল করিল না কুসুমের? একবার বাপের বাড়ি যাওয়ার নামে আছাড় খাইয়া তার কোমর ভাঙিয়াছিল, যদিবা শেষপর্যন্ত গেল, ফিরিয়া আসিল পনেরো দিনের মধ্যে। এখানে এমনভাবে হয়তো এই তাদের শেষ দেখা, এ জীবনে হয়তো আর এত কাছাকাছি তারা আসিবে না; আর আজ একটু কাঁদিল না কুসুম, গাঢ় সজল সুরে একটি আবেগের কথা বলিল না? কুসুমের মুখে ব্যথার আবির্ভাব দেখিতে শশীর দুচোখ আকুল হইয়া ওঠে, অস্ফুট কান্না শুনিবার জন্য সে হইয়া থাকে উৎকর্ণ। কে জানিত কুসুমের দৈনন্দিন কথা ও ব্যবহার মেশানো অসংখ্য সংকেত, অসংখ্য নিবেদন এত প্রিয় ছিল শশীর, এত সে ভালোবাসিত কুসুমের জীবনধারায় মৃদু, এলোমেলো, অফুরন্ত কাতরতা? চিরদিনের জন্য চলিয়া যাইবে, আর আজ এই তালবনে তার এত কাছে বসিয়া খেলার ছলে কুসুম শুধু বাজাইবে চাবি কী অন্যায় কুসুমের, কী সৃষ্টিছাড়া পাগলামি।
পা দিয়া ছোট একটি আগাছা নাড়িয়া দিতে ঝরঝর করিয়া শিশির ঝরিয়া পড়িল। শশীর মনে হইল কুসুমকে ধরিয়া এমনি বাকুনি দেয় যাতে তার চোখের আটকানো জলের ফোঁটাগুলি এমনিভাবে ঝরিয়া পড়ে এবং দুচোখ মেলিয়া সে তা দেখিতে পায়।
কুসুম জিজ্ঞাসা করিল, কথা বলবেন বলে ডেকে এনে চুপচাপ কেন ছোটোবাবু?
শশী বলিল, শুনলাম তোমরা নাকি গাঁ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তাই শুধোতে ডাকলাম।
কুসুম অনায়াসে বলিল, পরশু যাব।
আমায় যে বলো নি কিছু?
কখন বলব? আপনি কি আসেন?
শশী রাগিয়া বলিল, নাই বা এলাম! জানো না কাজের ভিড়ে কত ব্যস্ত থাকি? মিথ্যা করে ভাঙা হাত দেখাতে বৃষ্টি মাথায় করে যেতে পারো, এতবড় একটা খবর দেবার জন্যে একবার যেতে পারলে না?
একথায় ক্রোধের কী অপূর্ব ভঙ্গিই কুসুম করিল দুহাতে মুখে দুপাশের আলগা চুলগুলি পিছনে ঠেলিয়া দিয়া এমন তীব্রভৃষ্টিতে শশীর দিকে চাহিল যে মনে হইল শশী যেন দুরন্ত অবাধ্য শিশু, এখুনি কুসুম তাকে একটা চড়ুচাপড় মারিয়া বসিবে। এমন তো ছিল না কুসুম! শশী কবে তাকে অপমান না করিয়াছে, কবে মান রাখিয়াছে তার অভিমানের, কবে এমন কথা বলিতে ছাড়িয়াছে যা শুনিলে গা জ্বলিয়া যায় না? কোনোদিন রাগ সে করে নাই, ভর্ৎসনার চোখে চাহে নাই। আজ এই সামান্য অপমানে সে একেবারে ফুঁসিয়া উঠিল বাঘিনীর মতো!
তবে কড়া কথা কিছু সে বলিল না, আত্মসম্বরণ করিল। তার রাগের ভঙ্গি দেখাইয়া শশী একেবারে নিভিয়া গিয়াছে দেখিয়া কে জানে কী আশ্চর্য কৌশলে, কথা বলার চিরন্তন রহস্যময় সুরটিও কুসুম ফিরাইয়া আনিল। বলিল, বাবা, কী ছেলেমানুষের পাল্লাতেই পড়েছি মিথ্যে করে ভাঙা হাত দেখাতে একবার ছেড়ে একশোবার যেতে পারি ঝড় বৃষ্টি ভূমিকম্প মাথায় করে, ওকথা বলবার জন্য যাব কেন?
শশী বলিল, পরানকে দিয়ে তো বলে পাঠাতে পারতে?
কুসুম বলিল, তাই বা কেন পাঠাব? যে খবর নেয় না তাকে খবর দেবার কী গরজ আমার? আমিই তো বারণ করলাম ওকে।
কাজের ভিড়ে আসতে পারিনি বলে আমি একেবারে পর হয়ে গেছি, না বউ?
পাগলাটে মানুষ আমি, তবু যাওয়ার দুদিন আগে আমাকে এখানে ডেকে আনা চাই, আজেবাজে কথা বলে কান ঝালাপালা করা চাই! দশ বছর খেলা করেও কি সাধ মেটেনি? আমরা মুখ্যু গেঁয়ো মেয়ে এ সব খেলার মর্ম বুঝি না, কষ্টে মরে যাই।
এ কথার কোনো প্রতিবাদ নাই বলিয়া শশীর মুখে কথা ফোটে না। জুতার ভিতর হইতে পা বাহির করিয়া পায়ে ঘাসের শিশির মাখিতে মাখিতে নতমুখে সে মূক হইয়া বসিয়া থাকে।
এদিকে কুসুমের চোখে এতক্ষণে জল আসিয়া পড়িয়াছে। শশীর কাছে মএন্র আবেগকে এমন স্পষ্টভাবে চোখের জলে কুসুম কোনোদিন স্বীকার করে নাই। তবে সে বড়ো শক্ত মেয়ে, দুবার জোরে জোরে শ্বাস টানিয়া আবার আঁচলে চোখ মুছিয়াই আবেগ সে আয়ত্তে আনিয়া ফেলিল।
বলিল, এমন হবে ভাবিনি ছোটোবাবু। তাহলে কোনকালে গাঁ ছেড়ে চলে যেতাম।
কুসুম আর কিছুক্ষণ চোখের জল ফেলিলে যে শশী হঠাৎ খ্যাপার মতো বিনা বাক্যব্যয়ে তাকে দুহাতে জড়াইয়া ধরিত তাতে সন্দেহ ছিল না, কিন্তু কুসুমের অনুযোগগুলি তাকে দমাইয়া রাখিল। একথা সে ভুলিতে পারিল না যে এতকাল পরে ওভাবে কুসুমের সমস্ত নালিশের জবাব দেওয়া আর চলে না। মুখখানা শশীর একটু পাংশু দেখাইতেছিল। কী বলা যায় কুসুমকে, কী করা যায়! কে জানিত মোটে দুদিনের নোটিশে কুসুম তাকে এমন বিপদে ফেলিবে, তার গুছানো সময়ের মধ্যে এমন ওলটপালট আনিয়া দিবে কুসুমের কাছে বসিয়া থাকিলে, দুদিন পরে সে যে চিরদিনের জন্য চলিয়া যাইবে, এই চিন্তার কষ্ট তরঙ্গের মতো পলকে পলকে অবিরাম উথলিয়া উঠিয়া তাকে এমন উতলা করিয়া তুলিবে, এ ধারণা শশীর ছিল না। কাল কথাটা শুনিয়া অবধি শশীর মনে নানা বিচিত্র ভাবধারা উঠিতেছিল, আজ সকালে সে-সমস্ত যেন শুধু একটা কটু ক্লেশে পরিণত হইয়া গিয়াছে।