শশী বলিল, তুমি যাও। আমার এদিকে কাজ আছে!
কলিকাতা শহর! মোটরে চাপিয়া কলিকাতা শহর গাওদিয়ার দিকে চলিয়া গেল। করিয়া দিয়াছে। বিন্দুর বাড়ি যে-পাড়ায়, সে পাড়াটাও ভালো নয়। নন্দ কি পাগল? পাগল হোক আর যাই হোক, ওকে তো সে অনায়াসে মারিতে পারিত। বৃষ্টিধারার মতো কিল চড় ঘুসি। কতক্ষণ আর সহিতে পারিত? পাঁচ মিনিট। পাঁচ মিনিটের মধ্যে নন্দ পায়ের কাছে গড়াগড়ি দিত। অজ্ঞান অচৈতন্য নন্দ।
তবু, নন্দ হয়তো বিন্দুকে ভালোবাসে।
শীত জমিয়া আসে। পৌষ-পার্বণ আসিয়া পড়িতে আর দেরি নাই। গ্রামে অবিরত টেকি পাড় দিবার শব্দ শোনা যায়। আকাশে রবির তেজ কমিয়াছে। মাঠে রবিশস্য সতেজ। মানুষের গা ফাটিতে আরম্ভ করিয়াছে। গায়ে যাহার মাটি বেশি, ঘষা লাগিলেই খড়ি উঠিয়া যায়। লেপ-কাথা খোলা হইয়াছে, বেড়ার ফাঁক গুলিতে ন্যাকড়া ও কাগজ গোজা হইতেছে। মতি একবার জুরে পড়ি পড়ি করিয়া পড়ে নাই। কুসুমের আর একবার পেটব্যথা হইয়া গিয়াছে। পরাণ একদফা গুড় চালান দিয়াছে। এবার তাহার কিছু পাটালি গুড় করিবার ইচ্ছা। শশীর কাছে টাকা ধার করিয়া সে আরও প্রায় চল্লিশটা খেজুরগাছ লইয়াছে। লালীর বাছুরটা নিতাই একদিন যাচিয়া পরাণকে ফেরত দিয়া গিয়াছে।
ছোটোবাবুর জন্যে। নইলে বাছুর তুমি কখনও ফেরত পেতে না। এই কথা বলিয়াছে কুসুম। খেজুরগাছ কিনার জন্য শশীর কাছে পরাণকে টাকা ধার করিতে দিতে কুসুমের নিতান্ত অনিচ্ছা দেখা গিয়াছিল। সবসময় তাহার ইচ্ছা ও অনিচ্ছাকে মর্যাদা দিলে সংসার চলে না, এই যুক্তিতে পরাণ তাহার কথা গ্রাহ্য করে নাই। মোক্ষদার শরীরের অবস্থাটা কিছুদিন হইতে ভালো যাইতেছে না। শশীর বাড়িতে একটি আশ্রিতা মেয়ে, শশীর সে কী সম্পর্ক ভাই-কি হয়, ছেলে হওয়ার সময় ঠাণ্ডা লাগিয়া নিমুনিয়া হইয়া মরিয়া গিয়াছে।
এই ব্যাপারটিতে শশী বড় ধাক্কা খাইয়াছিল! বাড়ির উঠানে সাময়িকভাবে অতি কম খরচে কাঁচা বাঁশের সস্তা বেড়ার একটি ঘর তুলিয়া আতুড়ঘর করা হয় চাল টিনের। ব্যাপার চুকিলে টিনের চালটি ছাড়া ঘরটিকে বিসর্জন দেওয়া হয়। মৃতা মেয়েটির বেলাতেও এই ব্যবস্থাই হইয়াছিল।
এখন, শশীর বাড়িতে এ প্রথা চিরন্তন। শশী নিজেও এমনি একটি কুটিরে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, মনে নাই। শশী পৃথিবীতে আসিয়াছিল উলঙ্গ সন্ন্যাসী হইয়া, এখন সে ডাক্তার। পসারওয়ালা ডাক্তার, এমন ব্যাপারও সে ঘটিতে দিল কেন?
সে কি শুধু টাকার জন্য ডাক্তারি শিখিয়াছে? যেখানে যতটুকু কাজে লাগাইলে টাকা মেলে আপনার শিক্ষাকে সেখানে ঠিক ততটুকুই কাজে লাগাইবে? সমস্ত গ্রামকে স্বাস্থ্যতত্ত্ব শিখাইতে যাওয়া বৃহৎ ব্যাপার, ওটা নাহয় সে বাদ দিল, কিন্তু নিজের গৃহে?
না, সে ডাক্তার নয়। ব্যবসাদার। বাহিরে সে টাকা কুড়াইয়া বেড়ায়, বাহিরে সে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করিবার ভাড়া-করা সৈনিক গৃহে তাহার অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়া, মৃত্যুর আধিপত্য।
তারপর কয়েক দিন শশী বাড়িতে স্বাস্থ্যনীতি প্রবর্তনের চেষ্টায় সকলকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিল।
কী দিয়ে দাঁত মাজছিস?
কয়লা দিয়ে।
নিমের দাঁতন দিয়ে মাজ।
তেতো যে! কয়লায় দাঁত কত সাদা হয়!
যে কয়লা দিয়ে দাঁত মাজিত সে কিছুঁতেই নিমের দাতন ব্যবহার করিতে রাজি হইল না।
শশী কি খেপিয়া গিয়াছে? দাঁত মাজিবে, তার মধ্যে এত কাণ্ড কেন!
মাটিতে ওকে মুড়ি দিলে যে কুন্দ? বাটি নেই!
বাটতে দিলে এক খাবলায় সব খেয়ে ফেলবে যে! তখন ফের চেঁচাতে আরম্ভ করবে। ছড়িয়ে দিলাম, খুঁটে খুটে অনেকক্ষণ খাবে।
কুন্দ সগর্বে ছেলেকে নিরীক্ষণ করে। নধর শিশু শশীর চোখে লাগিয়াছে। একটু কোলে নিক না? শশী তাহাকে বোঝায়, বলে, মুড়ির সঙ্গে ছেলে তোর জার্ম খাচ্ছে জানিস? পেটে কৃমি হবে, আমাশা হবে, কলেরা হবে–
কী সব অমঙ্গুলে কথা! কুন্দ বলে, বালাই ষাট ভাবে, ওসব কিছু যদি হয় তো তোমার মুখের দোষে হয়েছে জানব। ডাক্তার হয়েছ বলেই তুমি যা-তা বলবে নাকি? বাছার তুমি গুরুজন, ওর কপালে কথা তোমার ফলেও যেতে পারে, এ খেয়াল তোমার নেই!
কুন্দর ছেলে হামা দিয়া মাটি হইতে খুঁটিয়া খুঁটিয়া মুড়ি খাইতে থাকে দুবেলা। শশীর কথা কুন্দ বিশ্বাস করে না। দু আঙুলে একটি একটি মুড়ি মুখে দিবার সময় ছেলেকে তাহার কী সুন্দর দেখায়।
শশী রাগ করিয়া ধমক দিলে কুন্দ বলে, চুপ করুন শশীদা। ছেলে আপনার নয়। মামা চোখ বুজলে আপনি বাড়ি থেকে খেদিয়ে দেবেন তা জানি।
বাড়ি হইতে তাড়াইয়া দিবার কথাটা কোথা হইতে আসে শশী বুঝিতে পারে না। তবে অবান্তর শোনায় না। কারণ, শশীর মতে বড়ি হইতে খেদাইয়া দেওয়ার উপযুক্ত কুন্দ ছাড়া আর কে আছে?
শশী বলে, পিসি কথা শোনো, ছেলেকে তোমার অত দুধ খাইও না। ওর সিকি দুধ হজম করবার ক্ষমতাও যে ওর নেই।
পিসি ভাবে, হায়রে কপাল! বাড়িতে এত দুধের ছড়াছড়ি, আমার ছেলে একটু দুধ খায়, এ কারো সয় না। কতটুকু দুধই বা ও খায়!
কী জানি কবে ছেলের দুধের বরাদ্দ কমিয়া যায় এই ভয়ে পিসি ছেলেকে আরও একটু বেশি দুধ খাওয়াইতে আরম্ভ করে। দুপুরবেলা শশী ঘরে ঘরে বলিয়া যায় ; ওঠো, উঠে পড়ো সবাই, ঘুমোতে হবে না। শীতকালের দুপুরে ঘুম কিসের?
সকলে একদিন দুইদিন সহ্য করে, হাসিমুখে উঠিয়া বসিয়া হাই তুলিয়া বলাবলি করে ; শশীর হয়েছে কী? এবার বাপু ওর বিয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তাহারা বিদ্রোহ করে। যাদের বয়স কম ও স্বামী আছে তারা ভাবে ; আমাদের মতো রাত জাগতে হলে দুপুরে ঘুমোই কেন বুঝতে! যাদের স্বামী নাই, তারা ভাবে : দুপুরবেলা না ঘুমিয়ে করব কী? সময় কাটবে কী করে? শশী বলে, পাগল, স্বাস্থ্য দিয়ে আমাদের কী হবে। গিনীরা, যাদের বয়স হইয়াছে, তারা ভাবে কথাটা বোধ হয় মিথ্যে নয়। দুপুরে না ঘুমুলে অম্বলের জ্বালা বোধ হয় একটু কমে। কিন্তু পেটে ভাতটি পড়লেই চোখ জড়িয়ে আসে, তার কী হবে?