মতি বলিল, তোর কী আস্পর্ধা বউ!
বুঁচি নাই। বুঁচি অনেকদিন আগে শ্বশুরবাড়ি চলিয়া গিয়াছে। সে থাকিলে অন্য কিছু বলিত। আরও কড়া, আরও ঝাঁজালো কিছু।
কুসুম শান্তভাবে বলিল, মা একলা গোয়াল সাফ করছে, যা তো মতি লক্ষ্মটি, হাত লাগবি যা। সুদেবের সঙ্গে তোর বিয়ের পরামর্শটা ছোটোবাবুর সঙ্গে করে নি। মা যেন গোয়াল ফেলে ছুটে আসে না বাপু। কাজ সেরে একেবারে চান করে আসবি। ছোটোবাবু বসবে।
কুসুম হুকুম দিতেও জানে। কেন জানিবে না? সকলে মিলিয়া তোষামোদ করিয়া গোরু কেনার জন্য তাহার অনম্ভজোড়া বাগাইয়া লয় নাই? সেও ছাড়িবে কেন? মাঝে মাঝে ভয়ানক দরকারের সময়, শশীর সঙ্গে এখন সে যে কলহ করিবে এমনি দরকারের সময়, হুকুম তাহার সকলকে মানিতে হইবে।
মতি চলিয়া গেলে শশী বলিল, ওষুধ খেয়ে কাল তোমার পেটব্যথা কমেনি নাকি বউ?
ও ভারি ওষুধ! কটা এইটুকু-টুকু সাদা বড়ি-ওষুধ না ছাই। নিজে একবার আসতে পারেননি? বড়ি খেয়ে ব্যথা যদি না কমত!
এর নাম অকৃতজ্ঞতা। ব্যথা তাহা হইলে কমিয়াছিল? রাত্রে একবার উঠিয়া আসিয়া দেখিয়া গিয়া ওষুধ দিল,ওষুধ খাইয়া ব্যথাও কমিল, তবু কুসুমের মন ওঠে নাই। শশী বিরক্তি বোধ করিল। তোমার সব বিষয়েই একটু বাড়াবাড়ি আছে বউ।
কী আছে? বাড়াবাড়ি? হ্যাগো ছোটোবাবু, আছেই তো। তা যাই বলেন, এক ঘণ্টা ধরে বুক পরীক্ষা ম্যালেরিয়া জ্বর হলে, আমি করি না।
সে বুক পরীক্ষা করিবে, সে কি ডাক্তার? কুসুমের মনটা শশীর বোধগম্য হয় না। পেটব্যথার জন্য কাল এক ঘণ্টা স্টেথোস্কোপটা ওর বুকে লাগাইয়া হৃদস্পন্দন শুনিলে ও কি সুখী হইত? কুসুমের মাথাধরার চিকিৎসা বোধ হয় পাটেপা। সে ডাক্তার মানুষ, এসব পাগলামিকে প্রশ্রয় দিলে তাহার চলিবে কেন?
টাকা পেলে কোথায় পরাণের বউ?
যেখান থেকেই পাই, আপনার ভিজিট দিয়েছি, নিয়ে যান।
কোথা থেকে পেয়েছ না বললে নিতে পারি না, বউ।
কেন, চুরি করেছি ভাবেন নাকি?
শশী ভাবিল, এই বেশ সুযোগ পাওয়া গিয়াছে। কুসুমের এই কথাটাকে পরিহাসে দাঁড় করাইয়া দিলেই সে হাসিয়া ঠাণ্ডা হইয়া যাইবে।
তা আশ্চর্য কী? চুরি না করলে টাকা তুমি পাবে কোথায়? রোজগার করো?
কুসুম বলিল, আমার বাপ ঢের রোজগার করে। তাই বলে আমরা কি আপনার তুল্যি? লোকের গলায় ছুরি দেওয়া পয়সায় আমরা বড়লোক হইনি, তাই আপনারা গরিব বলেন গরিব, চোর বলেন চোর!
শশী মুখ কালো করিয়া বাড়ি ফিরিল।
সারাদিন তাহার মন খারাপ হইয়া রহিল। নিজের চারিদিকে সে যে শিক্ষা ও সভ্যতার খোলটি সযত্নে বজায় রাখিয়াছিল, কুসুম তাহাতে ফাটল ধরাইয়া দিয়াছে। কুসুমের কথা মিথ্যে নয়। হারু ঘোষের চেয়ে তাহার বাবা কি একদিন গরিব ছিল না? লোকের গলায় ছুরি দিয়াই গোপাল যে পয়সা করিয়াছে একথারও প্রতিবাদ চলিবে না। গোপালের চেয়ে কুসুমের বাবা ঢের বেশি ভদ্রলোক। কুসুমকে তাহার বাবা মধ্যে মধ্যে পত্র লেখে গোপালের সাধ্য নাই অমন সুন্দর হস্তাক্ষরে ওরকম চিঠি লিখিতে পারে। ঠিকানায় কুসুমের নামটা বাঙলায় লিখিয়া কুসুমের বাবা বাকিটা লেখে ইংরেজিতে। গোপাল এবিসিডি-ও চেনে না। অপমানটা করিবার সময় কুসুম হয়তো এইসব কথাও মনে রাখিয়াছিল।
গ্রামের লোকেরা তাহাকে যে ছোটোবাবু বলিয়া ডাকে ইহাতে শশীর গৌরব কিছু নাই। এটা উপাধি মাত্র, শুধু নাম। সম্মান নয়। গোপালের মক্কেলরা শিশুকালে আদর করিয়া তাহাকে ছোটোবাবু বলিয়া ডাকিত, ডাকটা কী করিয়া গ্রামে ছড়াইয়া পড়িয়াছে এবং টিকিয়া আছে। এসব ভুলিয়া গিয়া সে কি অহঙ্কারী হইয়া উঠিতেছিল? সকলের সঙ্গে ছোটোবাবুটির মতো ব্যবহার শুরু করিয়া দিয়াছিল?
শশীর আত্বসম্মান অত্যস্ত আহত হইয়া রহিল। সে ভাবিল, আমার রকমসকম দেখে কুসুম হয়তো মনে মনে হাসে। কুসুম হয়তো ভাবে, আঙুল ফুলে কলাগাছ হলে এমনই করে মানুষ বাপের চুরি-চামারির পয়সায় লেখাপড়া শিখে এত কেন?
কুসুম ক্ষমা চাহিতে আসিল দিন-চারেক পরে। দুপুরবেলা চুপিচুপি, চোরের মতো!
শশীর ঘরের পিছনে বাগান। বাগানে লিচু হয়, আম হয়, কাঠাল হয়, কপি হয়, নটেশাক হয়, তীব্রগন্ধী কাঁঠালি চাঁপা, লালবোঁটা শিউলিফুল ফোটে। বাগান দিয়া আসিয়া ঘরের জানালার ফাঁকে ফিসফিস করিয়া কুসুম ডাকিল, ছোটোবাবু শুনুন।
শশী ঘুরিয়া বাগানে গিয়া দ্যাখে জানালার নিচে তাহার অত সাধের গোলাপচারাটি কুসুম দুই পায়ে মাড়াইয়া মাটিতে পুতিয়া দিয়াছে।
গাছটা মাড়ালে কেন বউ? কিসে দাঁড়াচ্ছ দেখে দাঁড়াতে হয়!
শশীর সাধের ফুলের চারাকে হত্যা করিয়া শুরু করিলেও কুসুমের কাজ হইল। শশী তাহাকে ক্ষমা করিয়া ফেলিল; সমস্ত অপরাধ। আজ পর্যন্ত কুসুম তাহার কাছে যত অপরাধ করিয়াছে সব। কুসুম বলিল, চার রাত সে ভালো করিয়া ঘুমায় নাই। কথাটা শশী বিশ্বাস করিল। কুসুম মানবদনে মিথ্যা বলে জানিয়াও বিশ্বাস করিল। কারণ, কুসুমের মুখে কথাটার প্রমাণ ছিল এবং চোখে ছিল জল। কুসুম আরও বলিল, কয়েক দিনের মধ্যেই সে বাপের বাড়ি চলিয়া যাইবে। তার বাবা ভুবনেশ্বর পত্ৰ দিয়াছে। ছোটোবাবুকে রাগাইয়া চলিয়া যাইবার কথাটা ভাবিতে তাহার এমন খারাপ লাগিতেছিল! তাই ক্ষমা চাহিতে আসিয়াছে।
আমার এই স্বভাবের জন্য কেউ আমাকে দুচেখে দেখতে পারে না। মুখের আমার আটক নেই!
শশী জিজ্ঞাসা করিল, সেদিন রাত্রে তোমার কী হয়েছিল বলো তো? সত্যি বলো!