শ্যামল মৃদুস্বরে বলিয়াছিল, তা বলি নি মালতী। সায়ানাইড খাওয়ার কথা বলিনি। আমি বলছিলাম, আর তোমায় জ্বালাতন করব না, দূরে সরে যাব।
শুধু দূরে সরে যাবে?
হ্যাঁ, তোমায় আর বিরক্ত করব না।
ও!
মালতী নিশ্চিন্ত হইয়াছিল সন্দেহ নাই। মুখ দেখিয়া কিন্তু মনে হইয়াছিল সে যেন আহত হইয়াছে, অপমানও বোধ করিয়াছে। যাকে ছেলেমানুষ মনে করিয়া রাখা যায় তার কাছে ছেলেমানুষি করিয়া ফেলার লজ্জায় রাগও কি কম হয় মানুষের!
আমি তোমাকে ঠিক বুঝতে পারি না মালতী!
মালতী চুপ করিয়া ছিল। শ্যামল তাকে বুঝিতে পারে না, রাজকুমার তাকে বুঝিতে পারে না, সে নারী, সে রহস্যময়ী। শ্যামল তাকে পূজা করে, রাজকুমার তাকে অবজ্ঞা করে, কারণ সে নারী, সে রহস্যময়ী, তাকে কেউ বুঝিতে পারে না।
আমার একটা কথা রাখবে মালতী?
অত ভূমিকা কোরো না। কি কথা?
একমাস বাইরে কোথাও ঘুরে আসবে?
তোমার সঙ্গে?
না। তুমি একা। কোনো আত্মীয়স্বজনের কাছে চলে যাও। পুণায় তোমার মাসিমার কাছে। অনায়াসে যেতে পার। যাবে?
তখন মালতীর মনে হইয়াছিল, শ্যামল যেন আর ছেলেমানুষ নাই, ছোট ছোট আবেগে নিজেকে সে খরচ করিয়া ফেলে না, কখন সে যেন পরিণত পুরুষ হইয়া গিয়াছে, ধীর সংযত আত্মপ্রতিষ্ঠ তেজী পুরুষ, বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ পুরুষ, হাসি কান্না আনন্দ বিষাদের রসজ্ঞ পাকা অভিনেতা। ঠিক কি অনুভূতি তখন তার জাগিয়াছিল আর আনুষঙ্গিক আরো কি সব কথা মনে হইয়াছিল পরে মালতী কোনোদিন স্মরণ করিতে পারে নাই। ওই কয়েক মুহূর্তের অভিজ্ঞতা শুধু তার মনে ছিল, নূতন চিন্তা আর অনুভূতির যেটা ফলাফল, পরবর্তী প্রক্রিয়া। সে অভিজ্ঞতা বড় অদ্ভুত। শ্যামল নিষ্ঠুর, রাজকুমারের চেয়ে নিষ্ঠুর। রাজকুমার কি নিষ্ঠুর? যাকে আপন করতে চাই সে ব্যথা দিবেই, প্রিয় নিষ্ঠুর হইবেই–কারণ জগতে কেউ আপন হয় না, কেউ প্রিয় থাকে না। চব্বিশ ঘণ্টা। একদিন রাজকুমার যখন শুধু তার চোখে চোখে চাহিয়াছিল, পলক না ফেলিয়া যতক্ষণ চাহিয়া থাকিবার ক্ষমতা মানুষের আছে ঠিক ততক্ষণ, মালতীর আর্তনাদ করিয়া ছুটিয়া পলাইয়া যাওয়ার ইচ্ছা হইয়াছিল। এ সহজ সুবোধ্য কথা। কোলের শিশুকেও তো মার মাঝে মাঝে নিষ্ঠুর মনে হয়। কিন্তু গুরুজনের মতো তাকে শহর ছাড়িয়া দূরে কোথাও গিয়া থাকিতে উপদেশ দেওয়ার সময় শ্যামলকে দেখিবার কয়েকটি মুহূর্তে এ কি অভিজ্ঞতা তার জন্মিয়া গেল যে রাজকুমারের চেয়ে শ্যামলের নিষ্ঠুরতা গভীর ও মর্মান্তিক? তার আঙুলে গোলাপের কাটা ফুটিলে যে শ্যামলের মনে হয়তো লক্ষ কাঁটা ফোটার যন্ত্রণা হয়।
আমার ভালোর জন্য বলছ, তোমার কোনো স্বাৰ্থ নেই কেমন?
এবার শ্যামল চুপ করিয়া ছিল।
তুমি যাও শ্যামল। আমি বেরুব।
আমার সঙ্গেই চল?
তোমার সঙ্গে যাব না।
কখন ফিরবে?
তুমি আমায় পাগল করে দেবে। যেতে বলছি, যাও না?
যাচ্ছি মালতী!
যাচ্ছি বলিয়াও শ্যামল মিনিট দুই দাঁড়াইয়া ছিল।
আর আসব না তো?
তার মানে?
তুমি যদি সত্যি বারণ কর, তা হলে আর আসব না।
মালতী হতাশভাবে এতক্ষণ পরে বসিয়া পড়িয়ছিল।
তোমার সঙ্গে সত্যি পারলাম না শ্যামল। কি যে করি তোমাকে নিয়ে আমি! আমি জানি তুমি একটা ছুতো খুঁজছ, নাটক করার মতো খুব উচ্ছ্বসিতভাবে আমি সত্যি সত্যি তোমাকে আসতে বারণ করব, তুমিও আমার হৃদয়হীনতায় আহত হয়ে চলে যাবে, আর আসবে না। প্রথমদিন। ভাববে আমি রক্তমাংসের মানুষ নই, পরদিন ভাববে আমি মাটি, পরদিন পাথর, পরদিন লোহা, পরদিন ইস্পাত বেশ মজা হবে, না? সব ব্যাপারকে একেবারে চরমে না তুললে কি তোমার চলে না? তুমি জান ওভাবে তোমাকে আমি যেতে বলতে পারি না। তুমি বোধহয় ভাব যে মেয়েরা যার সঙ্গে লভে পড়ে তাকে ছাড়া সকলের মনে কষ্ট দিয়ে সুখ পায়?
আর কিছু বলতে হবে না মালতী। আমি যাচ্ছি।
শোন। তোমাকে কয়েকটা কথা বুঝিয়ে বলা দরকার। আজ আমার সময় নেই, ক্ষমতাও নেই। কাল সন্ধ্যার পর একবার এস।
আমাকে আর কিছু বুঝিয়ে বলতে হবে না, মালতী!
হবে। সব কথায় কথা বাড়াও কেন? কাল এস।
না এলে তুমি দুঃখিত হবে?
শ্যামল! ফের যদি তুমি আমার সঙ্গে এমনি কর কোনোদিন তোমার সঙ্গে কথা কইব না।
তারপর শ্যামল চলিয়া গেলে এমন শ্ৰান্ত, উদ্ভ্রান্ত আর অসহায় মনে হইয়াছিল নিজেকে, আধ ঘণ্টা মালতী চোখ বুজিয়া বিছানায় পড়িয়া ছিল। এখন আবার রাজকুমারের সঙ্গে বোঝাপড়া বাকি আছে। শেষ বোঝাপড়ার কি আছে, কিছুই সে জানে না। কিন্তু আর তার সহ্য হয় না। এই অনির্দিষ্ট অসহ-হওয়ার প্রতিকার চাই। এ ভাবে আর চলে না, চলিতে পারে না। হয় রাজকুমার তাকে লইয়া যাক সমুদ্রতীরের কোনো বন্দরে, পাহাড়ের মাথায় কোনো শহরে, মাঠের ধারের কোনো গ্রামে, সেখানে সন্ধ্যা হইতে তাকে বুকে তুলিয়া এত জোরে পিষিতে থাক যেন শেষ রাত্রে তার দম আটকাইয়া যায়, নয়তো তাকেই অনুরোধ করুক জোরে তার গলা জড়াইয়া ধরিতে যাতে আর রাজকুমার নিশ্বাস নিতে না পারে। তার দুর্বোধ্য অর্থহীন যন্ত্রণার মতো এইরকম খাপছাড়া ভয়ানক কিছু ঘটুক।
রাজকুমার প্রতীক্ষা করিয়া আছে, সে যাচিয়া দেখা করিতে চাহিয়াছে বলিয়া রাজকুমার তার জন্য রাস্তার ধারে একটা বিলিতি দোকানের লাল বাড়ির সামনে গাড়িবারান্দার নিচে ফুটপাতে দাঁড়াইয়া তার প্রতীক্ষা করিতেছে, ক্ৰমাগত এই কথাটা মনে পড়িতে পড়িতে মালতীর মস্তিষ্কে। উদ্ভ্রান্ত চিন্তার পাক-খাওয়া কমিয়া আসিল। জীবনে মালতী একবার নাগরদোলায় চড়িয়াছিল, দশ-এগার বছর বয়সে। তার দুর্দশা পৌঁছিয়াছিল সেই সীমায় যার পরেই মূৰ্হা গিয়া পড়িয়া যাইতে হয়। উঠিয়া জামাকাপড় বদলানোর সময় আজ তার মনে হইতে লাগিল, এইমাত্র সে যেন নাগরদোলা হইতে নামিয়া আসিয়াছে। সে জানিত না, সম্প্রতি রাজকুমারেরও একদিন এই রকম মনে হইয়াছিল।