রাজকুমার ভাবিতে লাগিল, সভ্যতার নামে এরা কি অসভ্যতাই শিখিয়াছে। প্রথমে দেখা হওয়ামাত্র এই হাসি হাসিলে কত সহজ হইয়া যাইত মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় করার ইচ্ছা জাগানো।
খানিক পরেই শ্যামল আসিল। ব্যস্তসমস্ত উদ্বিগ্ন শ্যামল। এক ঘণ্টার বেশি দেরি করিয়া ফেলার অপরাধে সে যেন নিজের মরণ কামনা করিতেছে। সঙ্গে তার বোন সুধা ও বৌদিদি ইন্দিরা। দুজনের সাজসজ্জা একেবারে চমকপ্রদ। শ্যামলের যে মোটে ঘন্টাখানেক দেরি হইয়াছে তাই আশ্চর্য।
রাজকুমারকে দেখিয়া শ্যামলের মুখ অন্ধকার হইয়া গেল। রাজকুমার মালতীকে পড়ানো ছাড়িয়া দিয়াছে জানিয়া সে স্বস্তি পাইয়াছিল।
রাজকুমার মাঝে মাঝে আসে তা সে জানিত কিন্তু সেদিন বর্ষা-সন্ধ্যার ব্যাপারটির পর রাজকুমারকে সে এ বাড়িতে দ্যাখে নাই।
রাজকুমার বলিল, কেমন আছ শ্যামল?
শ্যামল জবাব দিল না।
প্রশ্নের জবাব না দিবার সাধারণ কারণ থাকা সম্ভব মানুষের। হয়তো শ্যামল শুনিতে পায় নাই। মেয়েদের বিয়েবাড়িতে পৌঁছিয়া দিবার হাঙ্গামায় যে রকম ব্যতিব্যস্তই সে হইয়া পড়িয়াছে! কিন্তু সেদিন মিটিঙের কথাটা সকলের মনে ছিল। সকলেরই তাই মনে হইল, সেদিনের অপমানের জন্যই বুঝি শ্যামল রাগ করিয়া রাজকুমারের সঙ্গে কথা বন্ধ করিয়া দিয়াছে। মালতীই যেন বিব্রত হইয়া পড়িল সকলের চেয়ে বেশি। শ্যামলকে সে একপাশে ডাকিয়া নিয়া গেল।
রাজুদার সঙ্গে কথা বল না?
না।
কেন?
ইচ্ছে হয় না।
ছি ছি, কবে সেই মিটিঙে কি হয়েছিল, আজো তা মনে করে রেখেছ? দোষ তো ছিল তোমার। তুমি কেন গায়ে পড়ে–
সেজন্য নয়। ও একটা রাস্কেল মালতী।
উত্তেজিত অবস্থায় না থাকিলে কথাটা শ্যামল বলিয়া ফেলিত না। অত বোকা সে নয়। মালতীর মুখের সঙ্গে নিজের মুখখানাও তার বিবর্ণ হইয়া গেল।
তোমার বড্ড মাথা গরম। কাকে কি বল ঠিক নেই। রাজুদা তোমাকে দশ বছর পড়াতে পারে, তা জান?
পেটে বিদ্যে থাকলেই লোকের মনুষ্যত্ব থাকে না।
রাজুদার মনুষ্যত্ব নেই, মনুষ্যত্ব আছে তোমার! লোকের মুখের দিকে চেয়ে একটা কথা বলতে পার না তুমি! ওর তুলনায় তুমি তো কেঁচো।
মালতী ছিটকাইয়া রাজকুমারের কাছে সরিয়া গেল।
চল! চল, আমরা যাই।
শ্যামল কোথা হইতে কার একটি গাড়ি সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছে। একটা গাড়িতে এতগুলি মানুষের যাওয়া সম্ভব ছিল না। অন্তত দুজনের ট্রামে বা বাসে যাইতেই হইত। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো কথা ওঠার আগেই মালতী চুপিচুপি রাজকুমারকে বলিল, শ্যামলের গাড়িতে আমি যাব না। চল, আমরা ট্রামে যাই।
গাড়িতে যে জায়গা কম পড়িবে, এতক্ষণে সকলের সেটা খেয়াল হইয়াছিল। সরসী বলিল, গাড়িতে তো কুলোবে না সকলের। আমি বরং রাজকুমারের সঙ্গে
মালতী তখন পথ ধরিয়া কয়েক পা আগাইয়া গিয়াছে। মুখ ফিরাইয়া সে বলিল, তোমরা গাড়িতে যাও। আমরা দুজন ট্রামে যাচ্ছি। এস।
সরসীর চোখের সামনে রাজকুমারকে সঙ্গে করিয়া মালতী বড় রাস্তার দিকে চলিয়া গেল।
একটা ট্রাম সমুখ দিয়া চলিয়া গেল। মালতী বলিল, না। পরের ট্রামে।–এখনো থাকিয়া থাকিয়া মালতী কাঁপিয়া উঠিতেছিল।
কি হয়েছে মালতী?
শ্যামলের সঙ্গে কোনোদিন আমি যদি কথা বলি—
এতক্ষণে গলা ধরিয়া মালতীর চোখে জল আসিয়া পড়িল।
কি করেছে শ্যামল?
আমায় অপমান করেছে!
অপমান করেছে? কি অপমান?
তোমায় রাস্কেল বলেছে।
আমায় রাস্কেল বলেছে তাতে তোমার অপমান হল কেন?
চুপ কর। তামাশা ভালো লাগে না। যা হচ্ছে আমার! শ্যামল কিনা বলে তোমার মনুষ্যত্ব নেই। নিজে থেকে ভিখিরির মতো আসে, দয়া করে হেসে কথা কই, তাইতে ভেবেছে, কি না জানি মহাপুরুষ হয়ে গেছি আমি। এবার বাড়িতে এলে দূর করে তাড়িয়ে দেব।
অত রাগ কোরো না, মালতী। বেচারি তোমায় ভালবাসে, সেদিন জানালা দিয়ে আমাদের দেখে ওর মাথা বিগড়ে গেছে। আমাকে গাল তো দেবেই।
মালতী সন্দিগ্ধভাবে বলিল, ভালবাসে না ছাই। অত ছোট মন নিয়ে কেউ ভালবাসতে পারে?
রাজকুমার হাসিয়া বলিল, ভালবাসে বলেই তো মন ছোট হয়েছে। তাছাড়া, আমার ওপর ওর রাগের আরেকটা কারণ আছে।
জানি, কাদের বাড়ির মেয়ের হাত ধরেছিলে তো?
রাজকুমার আশ্চর্য হইল না।
শ্যামল বলেছে?
মালতী মাথা নাড়িয়া বলিল, না, এমনি শুনেছি। সবাই জানে। ওসব লোকের বাড়িতে যাওয়ার কি দরকার ছিল তোমার?
দরকারের কথা পরে বলছি। জেনেও তুমি চুপ করে ছিলে যে?
তুমিও তো চুপ করে ছিলে?
রাজকুমার কিছুক্ষণ কথা বলিল না। আরেকটি ট্রাম সামনে দিয়া চলিয়া গেল।
ব্যাপারটা প্রথমে আমার কাছে এত তুচ্ছ ছিল মালতী বলার কোনো দরকার বোধ করি নি। পরে যখন দেখলাম আমার কাছে তুচ্ছ হলেও অন্যের কাছে তুচ্ছ নয়, তখন বলব ভেবেছিলাম। সময়মতো নিজেই বলতাম।
আমিও জানতাম তুমি সময়মতো নিজেই বলবে। তাই চুপ করে ছিলাম। কিন্তু শ্যামলের কি স্পর্ধা! তোমার সমালোচনা করতে যায়।
আরেকটি ট্রাম আসিতে দেখিয়া মালতী বলিল, যাবে? আমার কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না।
রাজকুমার বলিল, না, চল। সকলের সামনে বিয়েবাড়ি যাব বলে বেরিয়েছি, না গেলে ওরা কি ভাববে?
মালতী হাসিল, লোকে কি ভাববে, তুমি আবার তা ভাব নাকি? পরের বাড়ির মেয়ের হাত ধরতে যাও কেন তবে?
এই জন্যে।–বলিয়া রাজকুমার মালতীর হাত মুঠায় চাপিয়া ধরিয়া ছাড়িয়া দিল।
বিয়ে বাড়িতে সময়টা কাটিল ভালেই। বন্ধু ও পরিচিত অনেকে উপস্থিত ছিল। রাত দশটার মধ্যে লগ্ন, বসিয়া বসিয়া অনেকক্ষণ রাজকুমার বিবাহ দেখিল। কনেকে সত্যই আশ্চর্য রকম সুন্দরী দেখাইতেছে। রং তার অত্যন্ত ফর্সা, সাধারণ অবস্থায় দিনের বেলা লাবণ্যের অভাবে চোখে ভালো লাগে না, এখন ক্রিম, পাউডার, স্নাে, চন্দন আর ঘামে স্নিগ্ধ ও কোমল হইয়াছে মুখখানা। খুঁতগুলি চাপা পড়িয়া গিয়াছে সাজানোর কায়দায় এবং খুঁতও মেয়েটির কম নয়। রাজকুমার অনাবশ্যক সহানুভূতি বোধ করে। সাধারণ দৈনন্দিন জীবনে এভাবে সাজিয়া থাকিবার সুযোগ মেয়েটি পাইবে না। দুপাশে চাপা কপাল, নিভাজ চোখের কোণ, নাকের নিচে ভিতর দিকে মুখের অসমতল খাদ, চোয়ালের অসামঞ্জস্য, এ সব লোকের চোখে পড়িতে থাকিবে। তবে, ধীরেনের চোখে হয়তো পড়িবে না। ফর্সা রঙে তার চোখে যে ধাঁধা লাগিয়াছে, সেটা আর কাটিবার নয়। বাড়ির বৌয়ের রঙের গর্বে বাড়ির অন্য মানুষেরাও হয়তো তার রূপের অন্য সব কটির কথা তেমনভাবে মনে রাখিবে না।