নারায়ণ গোলমাল করিল না। হয়তো সাহস পাইল না, হয়তো ভাবিয়া দেখিল গোলমাল করা মিছে, অথবা হয়তো ঘাড়ের বোঝা নামিয়া যাওয়ায় নিশ্বাস ফেলিল স্বস্তির। আশ্রমে ভর্তি করার জন্যই মেয়েটিকে সে আনিয়াছে, প্রথমে এই কথা বলা হইয়াছিল সদানন্দকে, তার কাছে এই ঠাঁই বজায় রাখিয়া চলিতে হইল আগাগোড়া। দেখা গেল, ঠাট বজায় রাখতে সদানন্দও কম ওস্তাদ নয়। এস বাবা বোসো, বলিয়া রাজপুত্রকে সে বসাইল কাছে। রাজপুত্রের বেলা নির্বিকার ভাবটা কমাইয়া একটু স্নেহ জানাইবার জন্য বিপিনের যে অনুরোধ ও উপদেশ এতকাল কিছুতেই স্মরণ রাখিতে পারি না, আজ যেন সেই অনুরোধ ও উপদেশের মর্যাদা সুদে-আসলে দিবার জন্যই নির্বিকার ভাবটা বিসর্জন দিয়া জানাইল গভীর স্নেহ। বলিল া যাও, বেড়িয়ে এস গে একটু নদীর ধার থেকে দুজনে। কবে আবার দেখা হয় তোমাদের ঠিক তো নেই। কেন যাবে না মাধু, যাও। শিগগির ফিরো–সন্ধ্যার আগে।
মাধবীলতাকে চোখের দেখা দেখিতে না দিয়াই সদানন্দ রাজপুত্র নারায়ণকে ফিরাইয়া দিতে পারিত, কারো ক্ষমতা ছিল না বাধা দেয়। বিপিন তো রাগ করিয়াছেই, না হয় আরো খানিকটা বেশি রাগ করিত। কিন্তু দুজনকে নির্জনে একটু আলাপ করিতে দেওয়াই সদানন্দ ভালো মনে করিল। দুজনের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হওয়া দরকার বলিয়া নয়–বোঝাপড়া হইবে না, এরকম অবস্থায় বোঝাপড়া হয় না, বোঝাপড়ার কিছু নাই। একটু আবোল তাবোেল বকিবার সুযোগ পাক দুজনে। সদানন্দের জোর-জবরদস্তির অভিযোগ যেন ঘূণাক্ষরেও মনে না জাগে কারো; মাধবীলতা আশ্রমে থাকিতেছে স্বেচ্ছায়, নারায়ণ তাকে আশ্রমে রাখিয়া যাইতেছে স্বেচ্ছায়, এর মধ্যে আর কারো কর্তৃত্ব নাই। বিপিনও হয়তো একটু ঠাণ্ডা হইবে ব্যাপার বুঝিয়া, জোর দিয়া বলা চলিবে বিপিনকে যে, মাধবী থাকতে চাইলে, আমি কি করব বিপিন?
এত সব ভাবিয়া সদানন্দ দুজনকে নদীর ধারে বেড়াইতে পাঠাইয়া দিল। তবু একান্ত যুক্তিহীনভাবেই মনটা একটু উতলা হইয়া রহিল বৈকি! বর্ষার গোড়ায় এ কি অপরাহু আসিয়াছে। আজ। দীপ্তি সংবরণ করিয়া বর্ণচ্ছটা বিতরণের আর কি দিন জুটিত না অকালে ক্লান্ত সূর্যের। মন্থর গতিতে নদীতীরের কোনখানে ওরা দুজনে পৌঁছিয়াছে, কি বলাবলি করিতেছে নিজেদের মধ্যে। কত অভিমান আর অনুনয় না জানি রাজপুত্র প্রকাশ করিতেছে কথায়, মুখের ভাবে, চোখের বিষাদে। অনুযোগ হইয়া উঠিতেছে মিনতি। মন যদি না মানে মাধবীর? মোড় যদি ঘুরিয়া যায় তার মনের? যদি সে তুলনা করে, এই বিরাট-দেহ শ্ৰীহীন দরিদ্র প্রৌঢ়ের সঙ্গে রূপবান ধনবান সঙ্গী যুবকটির, আর তুলনা করিয়া যদি তার মনে খটকা বাধে যে কি হইবে ধাৰ্মিকের মুখোশপরা নরপিশাচটার আশ্রমে বাস করিয়া; তার চেয়ে রাজপুত্রের হাত ধরিয়া উধাও হইয়া যাওয়া ঢের ভালো, যাহোক তাহোক ফলাফল? সকাতর ক্লিষ্ট ঔৎসুক্যের সঙ্গে সদানন্দ দুজনের ফিরিয়া আসার প্রতীক্ষা করে, নিজেকে নিজেই মনে মনে বলে, আমি কি আঁ!–অত্যন্ত আত্মাদর যেন দীনভাবের আধিক্যে কোথায় তলাইয়া যায় কিছুক্ষণের জন্য এবং এতক্ষণে প্রকৃত পুণ্যবানের মতো অস্থায়ীভাবে বিনা প্রতিবাদে মাধবীলতা সম্পর্কে নিজেকে বিশ্বাস করিয়া ফেলে–পাপী। তেজস্বী কম নয় সদানন্দ। গোয়ার নয় বলিয়া বিপিন জানে মানুষটা সে নরম–খুঁটিনাটিতে সে সর্বদা হার মানে, মোটামুটিতে কবে তার প্রচণ্ড তেজস্বিতা প্রকাশ পাইয়াছিল, সে কথা মনে করে রাখে। কে? তেজস্বীর কাছে দুঃখ বেদনা সহজে আমল পায় না। কিন্তু অন্যায়ের ক্ষণিক উৎসমুখে নিবিড় মমতার এক অপরূপ মাধুর্য উৎসারিত হইয়া বিলীন হইয়া গিয়াছে, তার আফসোস বড় দুরন্ত। আহা, কী মিষ্টিই ছিল মাধবীলতাকে উমার জিস্ম করিয়া দিয়া আসিবার পর হইতে প্রায় সমস্ত রাত্রির অযাচিত জাগরণের ছটফটানি রীতিমতো আরম্ভ হওয়া পর্যন্ত, সেই বীভৎস করুণ পাশবিক। মায়ার স্বাদ! অনাস্থাদিতপূর্ব সেই মাধুর্যের লোভই হাল ছাড়িয়া দিয়া ধৈর্যহীন, ক্লেদাক্ত দুঃখে কী কাবুই হইয়া পড়ে মহাতেজস্বী সদানন্দ।
সন্ধ্যা পার হইয়া যায়, দুজনের ফিরিবার নাম নাই। নিজের সঙ্গে নিজের বিষাক্ত আত্মীয়তা স্থাপনের মজাটা সদানন্দ পরিষ্কার টের পাইতে থাকে। তারপর যখন খবর আসে নারায়ণ চলিয়া গিয়াছে, মাধবীলতা উমা ও রত্নাবলীর কুটিরে ফিরিয়া গিয়াছে, তখন খুশি হইবার ক্ষমতাও থাকে। না, এমনি নিস্তেজ আর ভেতা হইয়া পড়ে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, বিপিনও গোলমাল করিল না। অন্তত সদানন্দ যেরকম ভাবিয়াছিল, সেরকমভাবে করিল না। পরের উত্তেজনা নিজের মধ্যে গ্রহণ করিয়া উত্তেজিত হওয়ার মতো প্রথমটা একেবারে ক্ষেপিয়া উঠিয়া অল্প সময়ের মধ্যেই ঠাণ্ডা হইয়া গেল। ফাট ফাট বোমার মতো অবস্থায় সদানন্দের কাছে আসিয়া দাবি করিল, এর মানে? সদানন্দ জবাব দেওয়ামাত্র বোমার মতো ফাটিয়া গেল। ব্যস্। আর কিছুই নয়। নিজের বিস্ফোরণে নিজেই যেন সে দারুণ আহত হইয়াছে, রাগ করিবারও আর ক্ষমতা নাই।
তারপর আশ্রমের কারো কাছে কিছু না বলিয়া সে যে কোথায় চলিয়া গেল, সেই জানে। মাধবীলতার সঙ্গে নদীর ধারে একটু পায়চারি করিয়া নারায়ণ সেদিন ফিরিয়া গেল, বিপিন আশ্রমে অনুপস্থিত। আরো দুদিন পরে সে ফিরিয়া আসিল। গম্ভীর চিন্তিতমুখে সদানন্দকেই জিজ্ঞাসা করিল, মাধবী নারাণবাবুকে কি বলেছে?