তখনো আশ্রমের সকলের ধ্যানধারণা, সাধন-ভজন শেষ হয় নাই। গুরুদেবের পদার্পণে অনেকেরই কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ হইয়া গেল বটে, কয়েকজন আরো বেশি আসন কামড়াইয়া চোখ বুজিয়া রহিল। গুরুদেব খোঁজ করিয়া জানিবেন, সকলে ইতিমধ্যেই আসন ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িয়াছে কিন্তু তারা ধ্যানধারণায় এখনো মশগুল, গুরুদেবের আবির্ভাব পর্যন্ত টের পায় না, এমন আত্মহারা। জানিয়া গুরুদেব নিশ্চয় খুশি হইবেন, এরাই তার খ্ৰীটি শিষ্য। আশ্রমে এ রকম অতিরিক্ত ভাবপ্রবণ জন সাতেক অন্ধভক্ত বাস করে, অন্য সকলের তুলনায় এদের ভক্তির বাড়াবাড়িতে সদানন্দকে মাঝে মাঝে রীতিমতো বিব্রত হইতে হয়। দুজন বিধবা মহিলা আছে। এইরকম, কি যেন একটা সম্পর্কও আছে দুজনের মধ্যে, পিসি-ভাইঝির সম্পর্কের মতো। একজনের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, শুষ্ক শীর্ণ চেহারা, অত্যন্ত রুক্ষ মেজাজ। বৌরা সকলে ধীরে ধীরে খোলস ছাড়িয়া একে একে অবাধ্য হইতে আরম্ভ করায় এবং ছেলেরা সকলে একজোট হইয়া বৌদের পক্ষ নেওয়ায়, ছেলে, বৌ, নাতি, নাতনিতে ভরা প্রকাণ্ড সংসার ছাড়িয়া আশ্রমে আসিয়া ডেরা বাঁধিয়াছে।
অপরজনের বয়স কম, বছর ত্রিশেক হইবে। গোলগাল, ফর্সা, রসালো চেহারা, হঠাৎ অপদস্থ। হইলে মানুষের মুখের ভাব যেমন হয়, সব সময় মুখে সেইরকম একটা সকাতর লজ্জার ভাব ফুটিয়া থাকে। সংসারত্যাগী বয়স্কা মহিলাটির সঙ্গে সে থাকে এবং সকল বিষয়ে তাকে অনুকরণ করিয়া চলে। ঘুম হইতে ওঠে একই সময়ে, স্নান ও জপতপ সারে একই সময় ধরিয়া, আহার করে একই খাদ্য–পরিমাণটা পর্যন্ত সমান রাখিতে চেষ্টা করে। বয়স্কা মহিলাটি অন্য সব অনুকরণে সায় দেয়, গোলমাল করে কেবল খাদ্যের পরিমাণটা লইয়া। বলে, মরণ তোমার! আমি অম্বুলে রুগী, যা দাঁতে কাটি তাতেই বুক জ্বলে, আমার সাথে পাল্লা দিয়ে খেলে তুই বাঁচবি কেন শুনি? নে, দুধটুকু গিলে ফ্যাল্ ঢক করে।
অপরজন মিনতি করিয়া বলে, বমি হয়ে যাবে পিসিমা–অত দুধ খেলে নিশ্চয় বমি করে ফেলব।
দুধ তাকে খাইতে হয়, সমস্তটাই। খানিক পরে একটা খোঁচাও খাইতে হয়, কৈ লো রত্নী, বমি হয়ে যাবে? বাঁচতে সাধ না থাকে, বিষ খেয়ে মরবি যা, নয়তো গলায় দড়ি দে–না খেয়ে শুকিয়ে মরা চলবে না বাবু আমার কাছে।
এর নাম রত্নাবলী। পিসিমা কখনো ডাকে রনী, কখনো বলে রতন। পিসিমার নাম উমা। সদানন্দ ছাড়া এ জগতে তার নাম ধরিয়া ডাকিবার আর কেউ নাই–একজন ছিল, মাঝে মাঝে নাম ধরিয়া ডাকিত, মস্ত সংসারটা গড়িয়া দিয়া অনেকদিন আগে বিদায় লইয়াছে, সে সংসার ছাড়িয়া উমা এখানে আসিয়াছে, ছেলে, বৌ, নাতি, নাতনিতে ভরা বিরাট সংসার।
মাধবীলতাকে সদানন্দ এদের কাছে জমা করিয়া দিল। বলিল, মেয়েটি আজ আশ্রমে ভর্তি হল, মেয়েটির কেউ নেই উমা।
রত্নাবলী খুশি হইয়া উঠিল, উমা সন্দিগ্ধদৃষ্টিতে মাধবীলতার দিকে চাহিতে লাগিল। বোঝা গেল, আশ্রমে হঠাৎ এই বয়সী একটি মেয়ের আবির্ভাবে তার মনে নানা প্রশ্নের উদয় হইতেছে, সদানন্দের কাছে সেগুলি মুখে উচ্চারণ করিবার সাহস তার নাই।
ঘরের সম্মুখে কার্পেটের আসন পাতিয়া সদানন্দকে বসিতে দেওয়া হইয়াছিল। কোলের উপর ডান হাতের তালুতে বা হাতের তালু রাখিয়া মেরুদণ্ড সিধা করিয়া দেবতার মতো সদানন্দ বসিয়াছে, আনন্দ বেদনার অতীত ধীর, স্থির, বিকারহীন একস্তৃপ মূর্তিমান শক্তির মতো–সংহত ও সচেতন। সোজা উমার মুখের দিকে চাহিয়া বজ্ৰগম্ভীর ধমকের আওয়াজে সদানন্দ বলিল, তুমি কি ভাবছ উমা? আর কি ভাবছ উমা, ধুলায় গড়া ভঙ্গুর পুতুলের মতো উমা চুরমার হইয়া গিয়াছে। পায়ের কাছে লুটাইয়া পড়িয়া উমা অসম্বন্ধ প্রলাপ বকিতে থাকে, মুমূর্ষ জন্তুর মতো জীৰ্ণশীৰ্ণ দেহটা থথর করিয়া কঁপে। গুরুদেবের সম্বন্ধে অন্যায় কথা মনে আসিয়াছে, গুরুদেব সঙ্গে সঙ্গে তাহা জানিতে পারিয়া ক্রুদ্ধ হইয়াছেন, একি আকস্মিক সর্বনাশের সূচনা।
রত্নাবলীর মুখ পাংশু হইয়া গিয়াছে, আশ্রমবাসী আরো যে কয়জন নরনারী ইতিমধ্যে আসিয়া সমবেত হইয়াছিল, তাহাদের মুখও বিবর্ণ। মাধবীলতা সভয় বিস্ময়ে একবার ভূলুণ্ঠিতা উমার দিকে, একবার সদানন্দের মুখের দিকে চাহিতে থাকে। মানুষের উপর যে মানুষের এতখানি প্রভাব থাকে, একটিমাত্র ধমকে যে কেহ উমার বয়সী নারীকে পায়ের নিচে লুটাইয়া দিতে পারে, মাধবীলতার তা জানা ছিল না। নিজের বুকের মধ্যেও টিপঢিপ করিতেছে দেখিয়া সে আরো অবাক হইয়া গেল।
সদানন্দ মৃদুস্বরে বলিল, উঠে বোস উমা।
উমা উঠিয়া বসিলে তেমনি মৃদু ও শান্তকণ্ঠে বলিল, মনকে সংযত রেখো। মন হল ঘরের মতো, ধুলোবালি এসে জমা হয়, ঝাঁট দিয়ে সে সব সর্বদা সাফ করে নিতে হয়, নইলে ঘর যেমন আবর্জনায় ভরে ওঠে মনও তেমনি কুচিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়।
উমা মাথা নিচু করিয়া শুনিয়া যায়। সদানন্দের সাংঘাতিক নির্মমতার এই প্রকাশ্য অভিব্যক্তি মাধবীলতাকে ভীত ও সকাতর করিয়া তোলে। যে যেখানে যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থাতেই পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল হইয়া সদানন্দের কথা শুনিতেছিল, দাঁড়াইয়া থাকিতে না পারিয়া মাধবীলতা মেঝেতেই বসিয়া পড়িল।
তখন সদানন্দ প্ৰসঙ্গ পরিবর্তন করিয়া বলিল, মেয়েটি তোমাদের কাছে থাকবে উমা, তোমরা ওকে দেখাশোনা কোরো। বোসা তোমরা–আর সকলে কোথায়?
একজন শিষ্য তাড়াতাড়ি আশ্রমের সকলকে ডাকিয়া আনিতে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যেই আশ্রমের সকলে উমা ও রত্নাবলীর কুটিরের সম্মুখে আসিয়া জমা হইল, আসনে বসিয়া যে ঈশ্বরকে ডাকিতেছিল, সেও। ঈশ্বরকে ডাকার চেয়ে গুরুদেবের ডাক বড়।
০৩. মাধবীলতাকে নিয়ে বাইরে কিছু হৈচৈ হইল না
মাধবীলতাকে নিয়ে বাইরে কিছু হৈচৈ হইল না। রাজপুত্র নারায়ণের আশঙ্কাটা দেখা গেল, নিছক তার নিজেরই কল্পনা–অন্যায়ে অনভিজ্ঞ মনের স্বাভাবিক ভীরুতার ফল। যাদের কাছ হইতে চুরি করিয়া আনা হইয়াছে মাধবীলতাকে, চোর বা বৰ্মাল সম্বন্ধে তাদের কিছুমাত্র মাথাব্যথার লক্ষণ টের পাওয়া গেল না। দিন গেল, সপ্তাহ গেল, মাস গেল, জীবনের আকস্মিক গতি পরিবর্তনের ধাক্কায় আহত ও বিব্রত মাধবীলতার রক্তমাংসের ক্ষয় বন্ধ হইয়া বিবৰ্ণ পাণ্ডুর মুখে ফিরিয়া আসিতে লাগিল স্বাভাবিক ইক্ষুদণ্ডের রং–তাদের কোনো সাড়াশব্দই পাওয়া গেল না, যাদের কথা ভাবিয়া মাধবীলতাকে প্রকাশ্যে আশ্রমে আনার জন্যে বিপিন নারায়ণকে অনুযোগ জানাইয়াছিল, অত পরামর্শ দরকার হইয়াছিল দুজনের।