মহেশ সায় দিয়া বলিল, অনেকদিন থেকেই তো তোমার মন খারাপ।
ছোট ছেলে যেমন সহানুভূতির প্রত্যাশায় গুরুজনকে দুঃখ জানায়, তেমনিভাবে বিপিন বলিল, আশ্রম নিয়ে আমি পাগল হয়ে গেলাম চৌধুরীমশায়। যা ভেবেছিলাম তা তো কিছু হলই না, একটার পর একটা হাঙ্গামাই বাঁধছে। কত বড় উদ্দেশ্য নিয়ে কি রকম আশ্রমের গোড়াপত্তন করেছিলাম, দিন দিন কি দাঁড়াচ্ছে আশ্ৰমটা! এত চেষ্টা করছি, কিছুতেই গোল্লায় যাওয়া ঠেকাতে পারছি না।
মহেশ বলিল, কেন, তুমি তো আশ্রমের টাকা আর সম্পত্তি বাড়াবার চেষ্টা করেছিলে তা তো বেড়েছে? নাম ছড়াবার চেষ্টা করেছিল, তাও তো ছড়িয়েছে?
বিপিন বলিল, কিন্তু যে উদ্দেশ্যে আশ্রম করেছিলাম, তার যে কিছুই হচ্ছে না, বরং উল্টো ফল হচ্ছে।
মহেশ বলিল, সে দোষটা তোমার।
বিপিন আহত হইয়া বলিল, আমার দোষ? আমার কি দোষ?
মহেশ বিপিনকে তার দোষগুলি বুঝাইয়া দিতে আরম্ভ করে। আগে বিপিন রাগ করি, আজ নিঃশব্দে শুনিয়া যায়। মহেশের কথা শেষ হওয়ার আগেই তার মুখ দিয়া হঠাৎ বাহির হইয়া যায়, আপনাকে যদি আশ্রমে পেতাম!
পাবে।
আপনি আশ্রমে যোগ দেবেন?
দেব। কদিন আগেই ঠিক করেছি, আশ্রমের ভারটা আমিই নেব। মন দুর্বল কিনা, তাই ভাবছিলাম, ধীরেসুস্থে কদিন পরে আশ্রমে যাব। কিন্তু ঠিক যখন করে ফেলেছি, অনৰ্থক দেরি করে লাভ কি, কি বল?
বিপিন অভিভূতের মতো বলিল, নিশ্চয়।
মহেশ বলিল, চল তবে আজকেই যাই।
বিপিন ভয়ে ভয়ে বলিল, কিন্তু সদানন্দের বিষয়ে কি করা যাবে?
মহেশ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, সদানন্দ আর মাধবীলতাকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিলেই চলবে।
সদানন্দ আর মাধবীলতাকে অন্যত্র পাঠাইয়া দিবার ব্যবস্থার অর্থ বিপিন একরকম বুঝিয়াছিল। সদানন্দকে আশ্রম ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে বলা হইবে এবং মাধবীলতাকে মহেশের কোনো আত্মীয়ের কাছে পাঠাইয়া দেওয়া হইবে। মাধবীলতাকে অন্য কোথাও পাঠাইয়া দিবার অর্থটা সে ঠিক বুঝিতে পারে নাই। মহেশের আশ্রমে যোগদানের সঙ্গে সদানন্দকে সরাইয়া দেওয়ার প্রশ্ন জাগতে পারে, মাধবীলতাকে সরাইয়া দিবার প্রয়োজন কি, কারণ কি? মহেশ যে দুজনকে একসঙ্গে সরাইয়া দিবার মতলব করিয়াছে, বিপিন সেটা কল্পনাও করতে পারে নাই।
সদানন্দ অথবা মাধবীলতাও কল্পনা করতে পারে নাই।
রাত্রি প্রায় দশটার সময় মাধবীলতাকে সঙ্গে লইয়া মহেশ চৌধুরী আশ্রমে আসিল, তার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার আসল উদ্দেশ্যটা তিনজনের কাছেই পরিষ্কার হইয়া গেল। মাঝরাত্রে আশ্রমের পিছনের ঘাটে বাঁধা নৌকায় উঠিয়া সদানন্দ আর মাধবীলতা চলিয়া গেল। মাধবীলতা প্রথম দিন রাত্রে আশ্রমে আসিবার সময় নৌকা হইতে এই ঘাটেই নামিয়াছিল।
নৌকা চলিয়া গেলে মহেশ বলিল, আমরা সবাই মিলে এবার আশ্রমটা গড়ে তুলব বিপিন।