দেখছেন কি আরম্ভ করেছে ওরা? পড়ে দেখুন।
মহেশ ধীরে ধীরে আগাগোড়া পড়িয়া বলে, সদানন্দের তপস্যা আর আশ্রমের উদ্দেশ্যের কথা সত্য, গুণ্ডা ভাড়া করার কথাটা সত্য নয়।
মাধবীলতা বোমার মতো ফাটিয়া যায়, একটা কথাও সত্যি নয়। ও লোকটা কত খারাপ আপনি জানেন না, যে সব কাণ্ড চলে–
মহেশ বলে, জানি মা, সব জানি। সদানন্দ অনেক সাধনা করেছে, তবে কি জান মা, সাধকেরও পতন হয়। সদানন্দ লোক ভালো। আশ্রমটাও বড় উদ্দেশ্য নিয়েই স্থাপন করা হয়েছিল, তবে ঠিক সেভাবে কাজ হয় নি। মানুষের ভুলত্রুটি হয় কিনা, বুঝবার দোষ হয় কিনা নানারকম–
মাধবীলতা অবাক হইয়া শুনিয়া যায়। সদানন্দ লোক ভালো? আশ্রমের উদ্দেশ্য মহৎ? এত কাণ্ডের পর মহেশ চৌধুরীও যে এমন কথা বলিতে পারে, কানে শুনিয়াও মাধবীলতার যেন বিশ্বাস হইতে চায় না। হঠাৎ তার মনে হয়, লোকটি বোধহয় পাগল। প্রত্যেক উন্মাদের মতো নিজের একটা জগৎ সৃষ্টি করিয়া সেখানে সে বাস করিতেছে আর বাস্তব জগতের অর্থ স্থির করিতেছে তার নিজের খাপছাড়া জগতের নিয়মে।
কিছু ভেব না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
মাধবীলতা অভিভূতের মতো বলে, সব ঠিক হয়ে যাবে?
মহেশ চৌধুরী একদিন আশ্রমে গেল। বিপিনের সঙ্গে দেখা করিয়া বলিল, বিভূতির দোষে এতগুলি লোক জেলে যাবে বিপিনবাবু?
ওরাও তো মারামারি করেছিল।
তা করেছিল, কিন্তু দোষ তো ওদের নয়। বিভূতি হাঙ্গামা না বাঁধলে কিছুই হত না।
বিপিন চুপ করিয়া মহেশের মুখের দিকে চাহিয়া থাকে। কয়েক মুহূর্তের জন্য তারও মনে হয়, লোকটা কি পাগল? দাঙ্গা করার জন্য পুলিশ যাদের ধরিয়াছে, বিভূতিকে নিজের হাতে মারিয়াছিল এমন লোকও যাদের মধ্যে আছে, তারা শাস্তি পাইবে বলিয়া এই মানুষটার দুর্ভাবনা!
সেদিন সকালেই বিপিন আর সদানন্দের মধ্যে পরামর্শ হইয়াছিল, আদালতে প্রমাণ করিতে হইবে দাঙ্গাহাঙ্গামার দায়িত্বটা ছিল বিভূতির। কিছুদিন আগে একটি আশ্রম স্থাপন করিবার উদ্দেশ্যে মহেশ চৌধুরী সদানন্দকে নিমন্ত্ৰণ করিয়া তার বাড়িতে নিয়া গিয়াছিল। কিন্তু কোনো ভালো উদ্দেশ্যের পরিবর্তে বড় আশ্রমটির ক্ষতি করিবার জন্য একটি বিরোধী আশ্রম স্থাপন করাই মহেশ চৌধুরীর আসল উদ্দেশ্য, ইহা টের পাইয়া সদানন্দ চলিয়া আসিয়াছিল। বাপের অপমানে ক্রুদ্ধ হইয়া প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য বিভূতি এই হাঙ্গামা বাধায়। মহেশ চৌধুরীকেও দাঙ্গাহাঙ্গামার সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠভাবে জড়াইয়া কিছুদিনের জন্য জেলে পাঠানোর চেষ্টা করার ইচ্ছা সদানন্দের ছিল, বিপিন কোনোমতেই রাজি হয় নাই। মহেশ চৌধুরীর সম্বন্ধে বিপিনের মনের ভাব ক্ৰমে ক্ৰমে বদলাইয়া যাইতেছিল।
বিকৃত সত্য বলিয়া জানিয়া যে আদালতে প্রমাণ করার জন্য সদানন্দের সঙ্গে গোপনে চক্রান্ত করিতেছিল, মহেশ চৌধুরী নিজে আসিয়া তাই সত্য বলিয়া ঘোষণা করিতেছে, সব দোষ ছিল তার ছেলের! বিভূতিকে দোষী প্রমাণ করার উদ্দেশ্য তাদের ছিল স্বার্থরক্ষা, বিভূতির দোষে কতকগুলি লোক জেলে যাইবে বলিয়া মহেশ চৌধুরীর হইতেছে আফসোস!
কিছু করা যায় না?
কি করা যাবে বলুন?
বিভূতির দোষটা আদালতে প্রমাণ করলে–?
বিপিন ভাবিয়া বলিল, তাতে অন্য সবাই ছাড়া পাবে না, তবে শাস্তিটা কম হতে পারে।
মহেশ বলিল, তাই হোক। তাছাড়া যখন উপায় নেই, কি আর করা যাবে।
সদানন্দের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া যা ঠিক হইয়াছিল, সেটা মনে মনে বাতিল করিয়া দিয়া বিপিন বলিল, আদালতে কি বলবেন?
যা সত্য তাই বলব, আর কি বলব?
যা সত্য আদালতে তাই বলা হইবে স্থির হইলেও, কি বলা হইবে, সে বিষয়ে পরামর্শ করার প্রয়োজন দেখা গেল। সকলে সত্য কথা বলিলেও সত্যের খুঁটিনাটিগুলি ভিন্ন ভিন্ন লোকের মুখে এমন পরস্পরবিরোধী হইয়া দাঁড়ায়! আদালতে দাঁড়াইয়া মহেশ চৌধুরী ধীরস্থির শান্তভাবে বলিয়া গেল, বিভূতি কেমন একগুঁয়ে ছিল, মেজাজটা তার কি রকম গরম ছিল, আগে একবার সে একটা ছোটখাটো হাঙ্গামা সৃষ্টি করিবার ফলে মহেশ কিভাবে কয়েকজনের হাতে মার খাইয়াছিল এবং বাপকে যারা মারিয়াছিল তাদের শাস্তি দিবার জন্য কীর্তনের আসরে গিয়া সে কিভাবে হাঙ্গামার সৃষ্টি করিয়াছিল। এই প্রসঙ্গে ছেলের চরিত্রের কয়েকটা বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করিয়া সকলকে বুঝাইয়া দিবার চেষ্টাও করিল যে কর্তব্যজ্ঞান, নিষ্ঠা, তেজ, সাহস, এ সব মানুষের যতই থাক, ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত, ন্যায়-অন্যায় বিচার করিবার ক্ষমতা না থাকিলে ও সব কোনো কাজেই লাগে না।
অনেকে হতভম্ভের মতো শুনিয়া গেল, কেউ ভাবিল মহেশ চৌধুরীর মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে, কয়েকজন সকৌতুকে হাসিতেও লাগিল।
বিভূতির মা বলিল, আদালতে দশ জনের কাছে তুমি আমার ছেলের নিন্দে করে এলে! এবার আমি গলায় দড়ি দেব। আমি অনেক সয়েছি, আর সইব না! বলিয়া মাথা কুটিতে লাগিল।
মাধবীলতা বলিল, আপনার মনে এই ছিল! আমিও গলায় দড়ি দেব। বলিয়া হু হু করিয়া কাঁদতে আরম্ভ করিয়া দিল।
মহেশ চৌধুরী তাদের বুঝাইয়া শান্ত করিবার কোনো চেষ্টা করি না, এতটুকু বিব্রত হইয়াছে। বলিয়াও মনে হইল না।
অপরাহ্নে বিপিন আসিল। মহেশ বলিল, এস বিপিন।
বিপিন যেন হঠাৎ তার স্নেহের পাত্রে পরিণত হইয়া গিয়াছে। সম্বোধনের তারতম্যটা বিপিনও খেয়াল করিল কিনা সন্দেহ, শ্ৰান্ত ক্লান্ত মানুষের মতো সামনে বসিয়া পড়িয়া পরমাত্মীয়ের মতোই বিনা ভূমিকায় বলিল, কিছু ভালো লাগছে না।