মহেশ চৌধুরী ধীরভাবে বলে, উনি হয়তো ওকে শুধু আসর থেকে তাড়িয়ে দেবার জন্য সবাইকে ডেকেছিলেন।
মাধবীলতা আরো ব্যাকুল হইয়া বলে, না না, আপনি বুঝতে পারছেন না। আশ্রমের লোকেরা তাড়াতে পারত না?
দল নিয়ে গিয়েছিল যে?
অগত্যা মাধবীলতাকে ধৈর্য ধরিতে হয়, শান্ত হইতে হয়। সব কথা বুঝাইয়া না বলিলে মহেশ চৌধুরী বুঝিতে পারিবে না, এমন ভালোমানুষ কেন যে সংসারে জন্মায়।
তা নয়, দলে আর কজন ছিল? ওঁকে খুন করাই ওই লোকটার উদ্দেশ্য ছিল। জেলে দেবার জন্যে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছিল মনে নেই? ওঁকে জেলে পাঠালে আমার পেছনে লাগার সুবিধে হত। জেলে পাঠাতে পারল না, তাই একেবারে মেরে ফেলল।
এবার মহেশ চুপ করিয়া চাহিয়া থাকে। একজন স্ত্রীলোককে পাওয়ার লোভে তার স্বামীকে হত্যা করা দুর্বোধ্য ব্যাপার নয়, তবু যেন মহেশ কিছুই বুঝিতে পারিল না। ও রকম হত্যাকাণ্ডগুলি অন্যভাবে হয়। বিভূতিকে সদানন্দ ডাকিয়া পাঠায় নাই, বিভূতি যে আসরে যাইবে, তাও সদানন্দ জানিত না। বিভূতি নিজে হইতে গিয়া হাঙ্গামা আরম্ভ করিয়াছিল। এ রকম অবস্থায় সদানন্দের সম্বন্ধে এমন একটা ভয়ানক কথা অনুমান করা চলে কেমন করিয়া?
মহেশের মুখ দেখিয়া মাধবীলতার শরীর রাগে রি রি করিতে থাকে। এমন অপদার্থ হবাগো ভালোমানুষও পৃথিবীতে জন্মায়।
বুঝতে পারছেন না? আমার বিয়ে হবার পর থেকে দিনরাত ভাবত ওকে কি করে সরানো যায়, সেদিন সুযোগ পাওয়ামাত্র–যেই বুঝতে পারল যে সবাইকে ক্ষেপিয়া দিলেই সকলে মিলে ওঁকে মেরে ফেলবে, অমনি সকলকে ক্ষেপিয়ে দিল।
তা বটে, সুযোগ পাওয়ামাত্র সুযোগের সদ্ব্যবহার করা সদানন্দের পক্ষে অসম্ভব নয়।
মাথা হেঁট করিয়া মহেশ চৌধুরী চুপ করিয়া বসিয়া আকাশপাল ভাবে আর মাধবীলতা ক্ষুব্ধদৃষ্টিতে তার দিকে চাহিয়া থাকে। এই সহজ কথাটা কেন যে মানুষ বুঝিতে পারে না। বিভূতিকে বাঁচাইতে দুহাত বাড়াইয়া আগাইবার উপক্ৰম করিতে গিয়া হঠাৎ যে চিন্তা মনে আসায় সদানন্দ পিছাইয়া গিয়াছিল, মাধবীলতা সেই চিন্তাকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখিয়া সদানন্দের জীবনের দিনে, মাসে, বৎসরে পরিব্যাপ্ত করিয়া দিয়াছে। সদানন্দ এই কথাই সর্বদা চিন্তা করিত, কি করিয়া বিভূতিকে মারিয়া মাধবীলতাকে লাভ করা যায়। মাধবীলতাকে পাওয়ার চিন্তা ছাড়া সদানন্দের কি অন্য চিন্তা থাকিতে পারে?
২০. সবাই মিলে এবার আশ্রমটা গড়ে তুলব
প্রথমটা একটু উত্তেজিত হইয়াছিল, তারপর কিন্তু মহেশ চৌধুরী অস্বাভাবিকরকম শান্ত হইয়া পড়িল। একেবারে শান্তির প্রতিমূর্তি। মুহূর্তের জন্যও তার মুখের চামড়া কুঁচকায় না, দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত হয় না, কথায় আলো প্রকাশ পায় না। আরো বেশি আস্তে চলাফেরা করে, আরো বেশি ধীরতার সঙ্গে বাঁচিয়া থাকার প্রয়োজনগুলি নিখুঁতভাবে পালন করিয়া যায়।
মাধবীলতা দাঁতে দাঁত কামড়ায়। আপনি কিছুই করবেন না?
করব।
কি করবেন? কি করব তাই ভাবছি মা।
মাধবীলতা রাগে পৃথিবী অন্ধকার দেখিতে থাকে।–আপনার কিছু করা উচিত কিনা, তাও ভাবছেন বোধহয়?
মহেশ চৌধুরীর স্পষ্ট, মৃদু ও একটানা আলাপ করার সুর বদলায় না! ভাবছি বৈকি। সব কথা না ভেবে কিছু করতে আছে? সব কথা ভাবছ না বলেই সদানন্দের দোষের কথা ভেবে তুমি অস্থির হয়ে পড়ে।
আগে কোনোদিন মহেশ চৌধুরী সদানন্দকে সদানন্দ বলে নাই। সে অনায়াসে নামটা উচ্চারণ করিয়া গেল; খাপছাড়া শোনাইল মাধবীলতার কানে সে নিজেই মহেশ চৌধুরীকে বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছে যে, ও নামটা খুনীর।
স্বামীজির দোষ আছে বলেই—
দোষ তো তোমারও থাকতে পারে মা?
মাধবীলতা বড় দমিয়া গেল, মুখখানা হইয়া গেল ফ্যাকাসে। মহেশ চৌধুরী কেন তাকেও দোষী করিতেছে, অনুমান করা কঠিন নয়। এ দিকটা আগে সে ভাবিয়া দ্যাখে নাই।
তুমি আগেও ভাবতে সদানন্দ তোমার জন্য এমন পাগল যে, বিভূতিকে খুন পর্যন্ত করতে পারে। তাই এত সহজে সদানন্দকে দোষী ভেবে নিয়ে অস্থির হয়ে পড়েছ যে একবার একটু সন্দেহও জাগে নি। তোমার কোনো দোষ না থাকলে এ সব কথা ভাবতে কেন?
আমি–
তোমার কি দোষ তুমি জান না? অতি ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া মহেশ চৌধুরী যেন তার সেই অক্ষমতাকে সমর্থন করে, সেইখানে তো মুশকিল বাছা। নিজের দোষ যদি আমরা জানতে পারতাম, তবে আর ভাবনা ছিল কি। আমি কি আমার দোষ জানি?
মাধবীলতা বড় দমিয়া যায়। কি ভাবিতেছে মহেশ চৌধুরী? কিছুই বুঝিতে পারা যায় না। কি ধারণা জাগিয়াছে তার সম্বন্ধে তার মৃত স্বামীর পিতার মনে? কি সন্দেহ করিয়াছে এই বাগগাবা ভালোমানুষটি মাঝে মাঝে যাকে মারাত্মক রকমে চালাক মনে হয়? তার ছেলের বৌকে পাওয়ার লোভে সদানন্দ ইচ্ছা করিয়া তার ছেলেকে হত্যা করিয়াছে শুনিয়াও মহেশ চৌধুরীর অবিচলিত ভাব দেখিয়া মাধবীলতার আর রাগ করিবার সাহস হয় না। তাছাড়া, এতক্ষণে তার মনে হইতে থাকে যে, মহেশ চৌধুরীর করিবার বা কি আছে, সে কি করিতে পারে? প্রথমে মনে হইয়াছিল, মহেশ চৌধুরী আসল ব্যাপারটা অনুমান করিতে পারিলেই বুঝি সদানন্দের শাস্তির আর সীমা থাকিবে না। এখন মাধবীলতা ভাবিয়া পায় না, এমন একটা বিশ্বাস তার কেন জাগিয়াছিল। প্রতিহিংসা নেওয়ার মানুষ চৌধুরী নয়, সে ক্ষমতাও তার নাই।
দাঙ্গার ফলে আর কিছু না হোক আশ্রমের নাম আরো বেশি ছড়াইয়া গিয়াছে। কেবল কাছাকাছি গ্রাম আর শহরের মানুষের মধ্যেই ব্যাপারটা নিয়া হৈচৈ হয় নাই, খবরের কাগজেও বিস্তারিত বিবরণ বাহির হইয়াছে। দাঙ্গার বিবরণ শুধু নয়, আশ্রম সম্পর্কেও অনেক কথা প্রকাশিত হইয়াছে। একটি কাগজে লেখা হইয়াছে : এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক শ্ৰী শ্ৰী সদানন্দ স্বামী দীর্ঘকাল তপস্যার পর জনসেবাই সকল ধর্মের শ্ৰেষ্ঠ ধৰ্ম বলিয়া জানিয়া রোগশোক দারিনিপীড়িত নরনারীর কল্যাণের জন্য ইত্যাদি। সকল মহৎ কর্মের বিরোধিতা করাই এক শ্ৰেণীর লোকের প্রকৃতি, এইরূপ একদল লোক অন্যভাবে আশ্রমের ক্ষতি করিতে অসমর্থ হইয়া আক্ৰোশের বশে আশ্রমের বাৎসরিক প্রতিষ্ঠা-উৎসবের দিন গুণ্ডা ভাড়া করা ইত্যাদি। এই বিবরণ যে কাগজে বাহির হইয়াছিল, মহেশ চৌধুরীর বাড়িতে সেই কাগজটিই রাখা হয়। বাড়িতে খবরের কাগজটি আসামাত্র সকলের আগে মাধবীলতা সেটিকে দখল করে। দাঙ্গাহাঙ্গামার কোনো বিবরণ তার অজানা নয়, ব্যাপারটার জের কি দাঁড়াইতেছে, তাও খবরের কাগজে বাহির হওয়ার কয়েকদিন আগেই তার কানে আসে, তবু খবরের কাগজে সংক্ষিপ্ত আর ভুল বিবরণ পড়িবার জন্য সে ছটফট করিতে থাকে। সদানন্দ, তার আশ্রম ও দাঙ্গাহাঙ্গামা সম্বন্ধে অভিনব টীকা পড়িয়াই কাগজটি হাতে করিয়া সে মহেশ চৌধুরীর কাছে ছুটিয়া যায়।