এই অবস্থায় চ্যালাকাঠগুলি আসিয়া পড়িতে লাগিল তাদের গায়ে মাথায়।
কেউ থামানোর চেষ্টা না করিলেও দাঙ্গা আপনা হইতেই থামিয়া যায়। কোনোটা তাড়াতাড়ি থামে, কোনোটার জের চলে এখানে সেখানে ছাড়াছাড়া হাতাহাতিতে, পিছন হইতে মাথা ফাটানোয়। এই দাঙ্গাটা থামাইয়া দিল বিপিন। আশ্রমে একটা লুকানো বন্দুক ছিল। বন্দুকের লাইসেন্স ছিল, তবু বন্দুকটা লুকানোই থাকিত। ছুটিয়া গিয়া বন্দুকটা আনিতে বিপিনের সময় লাগিল মিনিট পাঁচেক আর খানিকটা তফাতে দাঁড়াইয়া কয়েকবার আওয়াজ করিতে সময় লাগিল দু মিনিট। শেষ মিনিটের আওয়াজ দরকার ছিল না, এ ধরনের শখের দাঙ্গা থামাতে এক মিনিটে যে কটা আওয়াজ করা যায় তাই যথেষ্ট।
দাঙ্গা থামার পরে হাঙ্গামার প্রথম বীভৎস আর বিশৃঙ্খল অবস্থাটাও শেষ হইয়া গেল অল্প সময়ের মধ্যেই। এ রকম হাঙ্গামার ডালপালা ছটিয়া ফেলিতে সদানন্দের আশ্রমবাসী শিষ্য-শিষ্যাদের পটুতা দেখা গেল অসাধারণ। পরিচালনার ভারটা নিতে হইল বিপিনকে, সদানন্দের কিছু করার ক্ষমতা ছিল না, সেও মার খাইয়াছে। মেয়েদের শান্ত করিয়া অভিভাবকদের সঙ্গে মিলন ঘটাইয়া দেওয়া হইতে লাগিল এবং আহতদের প্রাথমিক শুশ্ৰুষার ব্যবস্থা করা হইল।
আধঘণ্টা পরে দেখা গেল আসরে আছে শুধু আশ্রমের লোক, আহত আর নিহতদের আত্মীয়স্বজন, আর আছে গহনার শোকে কাতর কয়েকজন নরনারী। মধ্যে যারা চ্যালাকাঠ ছুড়িয়া মারিতেছিল, দাঙ্গার শেষের দিকে হঠাৎ সে কাজটা বন্ধ করিয়া মেয়েদের ভিড়ে ঢুকিয়া কয়েকজনের গলার হার, কানের মাকড়ি, হাতের চুড়ি ছিনাইয়া নিয়া তারা সরিয়া পড়িয়ছিল। সকলে পলাইতে পারে নাই, একটা চ্যালাকাঠ কুড়াইয়া নিয়া রত্নাবলী দুজনের মাথা ফাটাইয়া দেওয়ায় তারা এখনো আহতদের সারির একপ্রান্তে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া আছে।
আনকোরা নূতন আঘাতের রক্তমাখা চিহ্ন গায়ে নিয়া সদানন্দ, আর পুরোনো আঘাতের ব্যান্ডেজবাধা চিহ্ন গায়ে নিয়া মহেশ চৌধুরী, জড়ভরতের মতো একরকম কাছাকাছিই বসিয়া আছে–বিভূতির গা ঘেঁষিয়া। দাঙ্গা শেষ হওয়ার একটু আগে অথবা সঙ্গে সঙ্গে অথবা একটু পরে বিভূতি মরিয়া গিয়াছে। এক মিনিট স্তব্ধতার আগের তিন মিনিট আর পরের সাত মিনিট, মোট দশ মিনিটের দাঙ্গায় মারা গিয়াছে চারজন। গুরুতর আঘাত পাইয়াছে সাতজন আর সাধারণভাবে আহত হইয়াছে সতেরজন। আরো কয়েকজন আহত হইয়াছে সন্দেহ নাই, তবে তারা এখানে নাই, আগেই সরিয়া পড়িয়াছে। সদানন্দ আর মহেশ আহতদের প্রাথমিক সেবাশুশ্ৰুষার পর প্রাথমিক চিকিৎসার আয়োজন চাহিয়া দেখিতে থাকে, আর শুনিতে থাকে মরা ও আধমরা মানুষগুলিকে ঘিরিয়া বসিয়া মেয়েদের ড়ুরানো কান্না আর পুরুষদের হায় হায় আফসোস। সদানন্দের মাথায় মৃদু ঝিমঝিমানির মধ্যেও মনে হয়, এতগুলি গলার কান্না আর আফসোসের শব্দ না থামা সত্ত্বেও আসরটা যেন বড় বেশি নিঃশব্দ হইয়া গিয়াছে মানুষের ভিড়ে যখন গমগম করিতেছিল আর খোল করতালের সঙ্গে কীৰ্তন চলিতেছিল, তখনো আসরে যেন ঠিক এইরকম স্তব্ধতা নামিয়া আসিয়াছিল। মেয়েদের কান্না শুনিতে শুনিতে মহেশ চৌধুরীর মনে হয় অন্য কথা–এই শোকের ছড়াছড়ির মধ্যে বিভূতি যেন অন্যায়রকম ফাঁকিতে পড়িয়া গিয়াছে, তার জন্য শোক করিবার কেউ নাই!
অন্যায়টা শেষ পর্যন্ত তার বোধহয় সহ্য হইল না, তাই মাঝরাত্রি পার হইয়া যাওয়ার অনেক পরে বিপিনকে ডাকিয়া বলিল, বাড়িতে একটা খবর পাঠাতে পার বিপিন?
পাঠাচ্ছি–সকালে পাঠালে ভালো হত না? এত রাত্রে মেয়েদের—
না, এখুনি খবরটা পাঠিয়ে দাও। মেয়েরা এসে একটু কাঁদুক।
সদানন্দ এতক্ষণ বার বার শুশ্রুষা আর চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান করিয়াছে, এবার বিপিন অনুরোধ করিতেই রাজি হইয়া গেল এবং একজন শিষ্যের গায়ে ভর দিয়া খেড়াইতে খেড়াইতে নিজের তিন মহল আশ্রমের দিকে চলিয়া গেল। সঙ্গে গেল একজন শিষ্য। মনে হইল, এতক্ষণ অন্য সব আহতদের মতো কেবল সাধারণ শুশ্রুষা আর চিকিৎসা পাওয়া যাইত বলিয়া, সে গ্রহণ করে নাই, এবার বিশেষ ব্যবস্থা করা সম্ভব হওয়ায় সকলের চোখের আড়ালে সেটা উপভোগ করিতে যাইতেছে।
এদিকে কয়েক মিনিট কাটিতে না কাটিতে মহেশের মনে হইতে লাগিল, বাড়ির মেয়েদের আসিতে বড় দেরি হইতেছে। তাই, আর অপেক্ষা করিতে না পারিয়া নিজেই সে হাউ হাউ করিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিয়া দিল। মনে হইল, সদানন্দের সামনে ছেলের জন্য কাঁদিতে এতক্ষণ তার যেন লজ্জা করিতেছিল, এবার সুযোগ পাওয়ায় প্রাণ খুলিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিয়াছে।
বিভূতির মা, মাধবীলতা আর বাড়ির সকলে আসিল প্রায় শেষ রাত্রে। কিন্তু তেমনভাবে কেউ কাঁদল না। মাধবীলতা একরকম হ করিয়া বিভূতির দিকে চাহিয়া নিঃশব্দেই বাকি রাতটুকু কাবার। করিয়া দিল। বিভূতির মা এত আস্তে কাঁদতে লাগিল যে একটা কান ব্যান্ডেজে ঢাকা না থাকিলেও পাশে বসিয়া মহেশ চৌধুরী সব সময় তার কান্নার শব্দ শুনিতে পাইল না।
পুলিশ আসিল সকালে।
পুলিশের লোকের কাছে একটা খবর পাওয়া গেল, ইতিমধ্যেই তারা তিনজনকে গ্রেপ্তার করিয়া ফেলিয়াছে। তখন দাঙ্গার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল না। আশ্রমের পশ্চিম সীমানায় আশ্রমের যে ছোট ফুলের বাগানটি আছে, সেখানে পঁচজন লোক কাল রাত্রে একটি এগার বছরের মেয়েকে নিয়া একটু আমোদ করিয়াছিল। তিনজন ধরা পড়িয়াছে দুজন পলাতক।