উত্তেজনা অনেকের মধ্যেই সঞ্চারিত হইয়াছিল, তার উপর সদানন্দের অনুপ্রেরণা। একটা গৰ্জনের মতো আওয়াজ উঠিয়া এলোমেলো গোলমালটা একেবারে ঢাকিয়া দিল। শ চারেক লোক আগাইয়া গেল বিভূতি আর তার সঙ্গীদের দিকে। বিভূতিরা দলে যে বিশেষ ভারি নয়, সেটা টের পাইয়া সকলের মধ্যেই অনেকটা সাহসের সঞ্চার হইয়াছিল। বাকি পাঁচ শ ছ শ লোকের মধ্যে তিন চার শ স্ত্রীলোক আর্তনাদ করিতে লাগিল, বাকি সকলে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল মজা।
মাঝে মাঝে শোনা যাইতে লাগিল মার শালাদের। এই মহামন্ত্ৰ উচ্চারণ না করিয়া বাঙালি দাঙ্গাহাঙ্গামা, মারামারি আরম্ভ করিতে পারে না।
জনতা যখন আক্রমণ করে, তখন দেরি হয় শুধু আরম্ভ করিতে, একজন যতক্ষণ আসল ব্যাপারটা হাতেনাতে শুরু করিয়া না দেয়, ততক্ষণ চলিতে থাকে শুধু হৈচৈ আস্ফালন। তবে এরকম অবস্থায় আরম্ভ হইতেও যে খুব বেশি দেরি হয় তা নয়–দু-এক মিনিটের মধ্যেই কারোর না কারোর উত্তেজনা চরমে উঠিয়া যায়। ব্যাপার যে কি রকম গুরুতর হইয়া পঁড়াইয়াছে, বিভূতি আর তার সঙ্গীরা ভালো করিয়াই টের পাইয়াছিল। সকলে মিলিয়া আরম্ভ করিলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাদের ছিড়িয়া টুকরা টুকরা করিয়া ফেলিবে। কিন্তু এখন আর উপায় কি? পালানোর চেষ্টা করিলে কয়েকজন বাঁচিয়া যাইতে পারে, কিন্তু পালানোর চেষ্টা তো আর করা চলে না। তার চেয়ে উন্মত্ত জনতার হাতে মরাই ভালো।
পালানোর চেষ্টা করা চলে না কেন? বিভূতির ভক্তরা সকলে কি মনে করিবে! মানুষের নিন্দা প্রশংসা সম্বন্ধে মহেশ চৌধুরীর দুর্বলতা দেখিয়া সেদিন সকালে বিভূতির লজ্জা আর দুঃখ হইয়াছিল, এখন সে চোখের পলকে বুঝিতে পারে, অনুগত যুবক-সমাজের নিন্দা-প্ৰশংসার ভাবনাই তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে আড়ষ্ট করিয়া দিয়াছে। যাদের এত বড় বড় কথা শুনাইয়াছে, অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য বুক ফুলাইয়া যাদের সঙ্গে করিয়া এখানে নিয়া আসিয়াছে, এখন বিপদ দেখিয়া তাদের ফেলিয়া পালানোর কথা ভাবিতেই হাত-পা অবশ হইয়া আসিতেছে। অথচ এ ভাবে মরণকে বরণ করা নিছক বোকামি। রেললাইনে ট্রেনের সামনে দাঁড়াইয়া সাহস দেখানোর মতো।
সদানন্দও নিমেষের মধ্যে ব্যাপারটা অনুমান করিতে পারিয়াছিল। দুহাত মেলিয়া বিভূতিকে আড়াল করিয়া দাঁড়াইয়া সকলকে ঠেকানোর কল্পনাটা মনের মধ্যে আসিয়াই অন্য একটা কল্পনার তলে মিলাইয়া গেল। চোখের সামনে এমন একটা ভীষণ কাণ্ড ঘটিতে যাইতেছে, অথচ এই অবস্থাতেও সদানন্দের মনে পড়িয়া গেল যে, এ জগতে মাধবীলতার একজনমাত্র মালিক আছে, তার নাম বিভূতি। বিভূতির যদি কিছু হয়, মাধবীলতার তবে কেউ আর কর্তা থাকিবে না। চিন্তাটা মনে। আসিতেই সদানন্দ একটু সরিয়া দাঁড়াইল।
এমন সময় ঘটিল আরেকটা কাণ্ড। হাতে আর মাথায় ব্যাণ্ডেজবাধা মহেশ চৌধুরী খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে পাগলের মতো আসিয়া হাজির হইল। খানিকটা তফাত হইতেই সে প্রাণপণে চেঁচাইতে লাগিল, ওরে, রাখ্, রাখ্। ওরে বিভূতি রাখ্।
সকলে স্তব্ধ হইয়া গেল। কতকটা বিস্ময়ে, কতকটা কৌতূহলে, কতকটা সহানুভূতিতে। বিভূতি প্রথমে সকলকে শুনাইয়া যা বলিয়াছিল, মহেশ চৌধুরীকে দেখিয়া সেই কথাগুলি সকলের মনে পড়িয়া গিয়াছে।
১৯. কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতা
কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতা। তারপর আবার মারামারি আরম্ভ হইয়া গেল। এবার আরো জোরে। আসরে মহেশ চৌধুরীরও অনেক ভক্ত উপস্থিত ছিল, তাদের রক্ত গরম হইয়া উঠিয়াছে। ব্যাপার দেখিয়া মনে হইতে লাগিল, মহেশ চৌধুরী আর্তনাদের সুরে বিভূতিকে হাঙ্গামা থামাইতে অনুরোধ করে নাই, বিভূতিকে রক্ষা করার জন্য তার অনুগতদের কাছে আবেদন জানাইয়াছে। বাপের আর্তনাদ বিভূতির কানে পৌঁছায় নাই। গোলমালের জন্য নয়, সে তখন প্রায় সদানন্দের পায়ের কাছেই উদ্ভট ভঙ্গিতে পড়িয়া আছে, বা হাতটা কজি ছাড়াও আরেক জায়গায় ভঁজ হইয়া শরীরের নিচে চাপা পড়িয়া গিয়াছে আর ডান হাতটা টান হইয়া নিবেদনের ভঙ্গিতে আগাইয়া গিয়াছে সদানন্দের পায়ের দিকে। শরীরটা রক্তমাখা। তবে কোনো কোনো অঙ্গের নড়নচড়ন দেখিয়া বোঝা যায় তখনো মরে নাই। আরো অনেকে জখম হইয়াছে, সকলে তারা বিভূতির সঙ্গীও নয়, সদানন্দের মান রক্ষার জন্য তার যে সব উৎসাহী ভক্তেরা আগাইয়া আসিয়াছিল, তাদের মধ্যেও কয়েকজন অন্য উৎসাহী ভক্তের হাতে মার খাইয়াছে। মারামারির সময় হাতের কাছে যাকে পাওয়া যায় তাকেই দুঘা দিতে এমন হাত নিশপিশ করে।
শুধু হাতের মার নয়, গ্রামের লোকের পথ চলিতে লাঠির বড় দরকার হয়।
মারামারির দ্বিতীয় খণ্ডটা পরিণত হইয়া গেল রীতিমতো দাঙ্গায়, কেউ ঠেকাইতে পারিল না। অনেকে আগেই পালাতেই আরম্ভ করিয়াছিল, ব্যাপার এতদূর গড়াইবে না আশায় বুক বাঁধিয়া যারা অপেক্ষা করিতেছিল, এবার তারাও ছিকটাইয়া সরিয়া গেল। কেউ সটান পা বাড়াইয়া দিল বাড়ির দিকে, কেউ দূরে দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল মজা। কেউ মাটির ঢেলা ইটপাটকেল, হাতের কাছে যা পাইল, দূর হইতে তাই ছুড়িয়া মারিতে লাগিল যুদ্ধক্ষেত্রে একটু আগেও যেটা ছিল শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলাকীর্তনের আসর। খানিক তফাতে একটা চ্যালাকাঠের স্তুপ ছিল, আট-দশজন লোক হঠাৎ কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া দুহাতে চ্যালাকাঠ ছুড়িতে আরম্ভ করিয়া দিল–ঠিক যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে নয়, একপাশে, সেখানে তখন সমবেত স্ত্রীলোকদের অর্ধেকের বেশি নিরুপায় আতঙ্কে। কিচিরমিচির সুরে আর্তনাদ করিতেছে। কোনো অল্পবয়সী স্ত্রীলোক পুরুষ সঙ্গীর খোজে বিফলদৃষ্টিতে চারিদিকে চাহিতে চাহিতে প্রাণপণে চিৎকার করিতেছে বাবাগো মাগো বলিয়া, আর কোনো বয়স্কা স্ত্রীলোক বসিয়া বসিয়াই মধুসূদনকে ডাকিতেছে। মেয়েদের অবস্থাই সবচেয়ে সঙ্গিন। আসরের চারিদিকে রাত্রি আর নির্জনতা, পালানোর উপায় নাই। কয়েকজন অবশ্য দাঙ্গার সূচনাতেই উন্মাদিনীর মতো যেদিকে পারে ছুটিয়া পালাইয়াছে, সকলে সে রকম উদ্ভ্রান্ত সাহস কোথায় পাইবে? পুরুষ অভিভাবকরা আসিয়া অনেককে উদ্ধার করিয়া নিয়া গিয়াছে, কিন্তু এখন। উদ্ধারের কাজটাও হইয়া দাঁড়াইয়াছে আরো কঠিন। নিজেদের সঙ্কীর্ণ সীমানাটুকুর মধ্যে অনেকে ভয়ের তাড়নায় কয়েকটি পলাতকা উন্মাদিনীর মতোই দিশেহারা হইয়া এদিক ওদিক ছুটিতে আরম্ভ করায় নিজেদের মধ্যে নিজেরাই হারাইয়া গিয়াছে। তারপর আছে ছোট ছেলেমেয়ে। তারপর আছে। ধাক্কা দেওয়ার, গা মাড়াইয়া দেওয়ার বচসা আর গালাগালি। যে দু-একজন অভিভাবক লজ্জা ভয় ভদ্রতা ছাড়িয়া একেবারে মেয়েদের মধ্যে আসিয়া খোঁজ করিতেছে, খোঁজ পাইয়া, দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া, কাছে আনাইয়া সঙ্গে করিয়া পালাইতে তারও সময় লাগিতেছে অনেকটা।