হাঙ্গামার ফলে নন্দনপুরে যাত্রা আর কীর্তন বন্ধ হইয়া গেল, সেই যাত্ৰা আর কীর্তন প্রভৃতির ব্যবস্থা করা হইল আশ্রমে। বুদ্ধিটা মাথায় আসিল কয়েকটি গ্রামের মাতব্বরদের। তারা ভাবিয়া দেখিল, আশ্রমে সব গ্রামের লোকের সমান অধিকার, সেখানে বিশেষ সুবিধাও কেউ দাবি করিতে পারিবে না, বদমাইশি করিয়া গোলমাল সৃষ্টি করার জন্য সাহসও কারো হইবে না। যেদিন সকালে মহেশ চৌধুরীর জ্ঞান ফিরিয়া আসিল, সেইদিন দুপুরে আরম্ভ হইল শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলাকীর্তন। রাত্রি আটটা নটার সময় যাত্রাভিনয় আরম্ভ হইবে এবং সমস্ত রাত চলিবে।
বিভূতি যখন দল বাঁধিয়া বাপের প্রহারকারীদের খোজে বাহির হইল, তখন পুরাদমে কীর্তন চলিতেছে। বাছা বাছা কয়েকজন ভক্তকে সঙ্গে করিয়া পাঁচটি অপরাধীর খোঁজ করিতে গিয়া বিভূতি শুনিল, তারা সকলে কীর্তন শুনিতে গিয়াছে। বিভূতি তখন সোজা আশ্রমে চলিয়া গেল।
আসর লোকে ভরিয়া গিয়াছে। কীর্তনের দলটি নামকরা, প্রধান কীর্তনীয়ার গলাটি মধুর আর আবেগ রোমাঞ্চকর শ্ৰীকৃষ্ণ কেন জন্মিবেন, যুগে যুগে তপস্যা করিয়া যোগী ঋষিরা যার হদিস পায় না, তিনি কেন নিজে মানুষের মধ্যে মানুষের রূপ ধরিয়া আসিবেন, এই কথাটা সুর করিয়া বুঝাইয়া বলিতে বলিতেই সে সকলকে একেবারে মাতাইয়া দিয়াছে–গদগদ করিয়া তুলিয়াছে। কয়েকজনের চোখে জলও দেখা দিয়াছে।
সদানন্দের কিছু তফাতে অপরাধী পাঁচজন বসিয়াছিল। মনে তাদের একটু ভয় ঢুকিয়াছে, মহেশ চৌধুরী যদি মরিয়া যায়! কাছাকাছিই বসিয়া চুপি চুপি ইঙ্গিতে তারা এ বিষয়ে প্রথমে একটু আলাপ করিয়াছিল, তারপর চুপ করিয়া কীৰ্তন শুনিতেছে। দলবলসহ আসিয়া বিভূতি যখন আসরের একপ্রান্তে দাঁড়াইয়া তাহাদের খেজেই চারিদিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করিতেছে, তার উপর পঁচজনেরই নজর পড়িল।
পাঁচজনকে দেখিয়া বিভূতি সঙ্গীদের বলিল, ওই যে ওরা।
সঙ্গীদের একজন একটু দ্বিধাভরে বলিল, এত লোকের মাঝখান থেকে টেনে আনা কি উচিত হবে?
বিভূতি বলিল, প্রথমে ডাকব, যদি আসে ভালোই। না এলে ঘাড় ধরে টেনে আনতেই হবে। শাস্তিটা সকলের সামনে দিতে হবে!
ইতিমধ্যে সদানন্দ বিভূতিকে ডাকিতে লোক পাঠাইয়া দিয়াছে মহেশের খবর জানিবে। বিভূতিকে আশ্রমে দেখিয়া সদানন্দ সত্যই খুশি হইয়াছিল। বিভূতি মুখ তুলিয়া তার দিকে চাইতে সে একটু হাসিল। বিভূতি হাসিল না, হাসিবার মতো মনের অবস্থা তার তখন নয়, শুধু মাথা একটু কাৎ করিয়া হাসির জবাব দিল।
লোকটিকে বলিল, বলগে, একটু কাজ সেরে আসছি।
পূর্ণেন্দু নামে একটি যুবককে বিভূতি অপরাধী পঁচজনের কাছে পাঠাইয়া দিল। পূর্ণেন্দু গিয়া বলিল, মহেশবাবুর ছেলে বিভূতিবাবু আপনাদের একটু বাইরে ডাকছেন–বিশেষ দরকার।
যোগেন ভড়কাইয়া গিয়া বলিল, আমাদের ডাকছে? কেন ডাকছে?
দরকার আছে, আসুন।
আমাদের ডাকছে? আমাদের কাদের?
পূর্ণেন্দু একে একে আঙুল দিয়া পাঁচজনকে দেখাইয়া দিল, আপনাকে—আপনাকে—আপনাকে—আপনাকে–আপনাকে।
পাঁচজনেই ভড়কাইয়া গেল। আসর ছাড়িয়া কি যাওয়া যায়? দরকার থাকিলে বিভূতি আসুক না?
চৌধুরী মশায় কেমন আছেন জান?
পূর্ণেন্দু বলিল, ভালো নয়।
শুনিয়া পাঁচজনে আরো ভড়কাইয়া গেল এবং আরো স্পষ্টভাবেই জানাইয়া দিল যে, কীর্তন যখন চলিতেছে, আসর ছাড়িয়া যাওয়া কোনোমতেই সঙ্গত হইবে না। আশপাশের দু-একজন এতক্ষণে গোলমালের জন্য অসহিষ্ণু হইয়া বিরক্তি প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। পূর্ণেন্দু উঠিয়া গেল।
তারপর ঘটিল অতি খাপছাড়া নাটকীয় ব্যাপার। লোকজনকে ঠেলিয়া সরাইয়া বিভূতি আর তার সঙ্গীরা অপরাধী পঁচজনের কাছে আগাইয়া গেল! চার-পাঁচজনে মিলিয়া এক একজনকে ধরিয়া হাচকা টান মারিয়া দাঁড় করাইয়া দিল। পাঁচজনের মুখ তখন পাংশু হইয়া গিয়াছে। কীর্তন বন্ধ হইয়া গেল, সকলে অবাক হইয়া ব্যাপার দেখিতে লাগিল।
বিভূতি সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া সকলকে সম্বোধন করিয়া, এই পাঁচটি গুণ্ডা মিলে কাল সকালে আমার বাপকে বিনা দোষে মেরে প্রায় খুন করে ফেলেছে। আজ সকাল পর্যন্ত বাবা অজ্ঞান হয়ে ছিলেন। আপনাদের সকলের সামনে আমি এদের শাস্তি বিধান করছি, চেয়ে দেখুন বলিয়া একদিন সদানন্দের মুখে যেরকম ঘুসি লাগাইয়াছিল, কালীপদর মুখে সেইরকম একটা ঘুসি বসাইয়া দিল। তারপর সকলে মিলিয়া পাঁচজনকে মারিতে আরম্ভ করিল। আরম্ভ করিল বটে, কিন্তু মারটা তেমন জমিল না। ভয়ে যারা আধমরা হইয়া গিয়াছে, চোখ বুজিয়া গোঙাইতে আরম্ভ করিয়াছে, হাত তুলিয়া একটা আঘাত ফিরাইয়া দিবার চেষ্টা পর্যন্ত যাদের নাই, একতরফা তাদের কঁহাতক পিটানো যায়? এমনি মারিতে হাত উঠিতেছে না দেখিয়া, বিভূতি একজনের একটা ছড়ি কুড়াইয়া নিল, তারপর সেই ছড়ি দিয়া পঁচজনকে মারিতে আরম্ভ করিল।
এতক্ষণে চারিদিকে হৈচৈ আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। মারের ভয়ে আশপাশের সকলে তফাতে। সরিয়া গিয়াছে এবং সেখানে নিরাপদে দাঁড়াইয়া চিল্লাইতেছে। সদানন্দই বোধহয় সকলের আগে তাদের কাছে আগাইয়া আসিল। সদানন্দকে আগাইতে দেখিয়া তখন অগ্রসর হইল আশ্রমের অধিবাসীরা।
সদানন্দ বিভূতিকে ধরায় বিভূতি তাকে ধাক্কা দিয়া ঠেলিয়া সরাইয়া দিল। তখন সকলের দিকে চাহিয়া বজ্ৰকণ্ঠে সদানন্দ বলিতে লাগিল, আমার আশ্রমে এসে একজন গুণ্ডা গুণ্ডামি করছে, আমায় অপমান করছে, তোমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে তাই দেখছ? আমাকে মারল, এ অপমান তোমাদের সহ্য হচ্ছে? আমার যদি একজন ভক্ত এখানে থাকে।