কিন্তু কে যে মহেশ চৌধুরীকে মারিয়াছে, কেউ তা জানে না। অত সকালে আটচালার দিকে। বড় কেউ যায় নাই। একটু বেলায় মহেশকে রাস্তায় পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া গ্রামে একটা গোলমাল বাঁধিয়া যায়। তখন নন্দনপুর ব্যায়াম-সমিতির সদস্যেরা তাকে সযত্নে তুলিয়া আনিয়া সেবাযত্নের ব্যবস্থা করিয়াছে।
ডাক্তার দেখাইয়া পাল্কিতে করিয়া মহেশকে বাড়ি নিয়া যাওয়া হইল। সারাদিন সারারাত বিভূতি মহেশের শিয়রে বসিয়া রহিল, বিভূতির মা বসিয়া রহিল পায়ের কাছে। মাধবীলতা ওইরকমভাবেই রাতটা কাটাইবার আয়োজন করিয়াছিল, বিভূতির জন্য পারিয়া উঠিল না। মাঝরাত্রে বিভূতি তাকে এমন একটা অপমানজনক ধমক দিয়া ন্যাকামি করিতে বারণ করিয়া দিল যে, কাঁদিয়া ফেলিয়া মাধবীলতা উঠিয়া গেল।
মহেশ চৌধুরীর জ্ঞান ফিরিল পরদিন সকালে।
উদ্ভ্রান্ত ভাবটা একটু কাটিয়া আসিলে বিভূতি মৃদুস্বরে তাকে জিজ্ঞাসা করিল, তোমায় কে মেরেছে বাবা?
মহেশ চৌধুরী বলিল, একজন কি মেরেছে–চার-পাঁচজনে।
কেন মারল?
তোমার জন্যে। পাপ করলে তুমি, তোমার বাপ বলে আমি তার প্রায়শ্চিত্ত করলাম।
উত্তেজিত হওয়ার ফলে হঠাৎ ব্যথায় মহেশ একটু কাতর হইয়া পড়িল। কিছুক্ষণ সকলে চুপচাপ।
তুমি আমার বাবা বলে তোমায় মারল? কে কে মারল?
মহেশ চৌধুরী চোখ বুজিয়া বলিতে লাগিল, ওরা সবাই ভালো লোক, অকারণে কখনো মারত না। যোগেন, দীন, কালীপদ, রামনাথ আর নগেনের সেজমামা ছিল–কি যেন নাম। লোকটার? আমি তো ওদের কোনোদিন ক্ষতি করি নি, মিছিমিছি কেন ওরা আমায় দেখামাত্র পিটাতে আরম্ভ করবেঃ
নড়িতে গিয়া মৃদু একটা আর্তনাদ করিয়া মহেশ চৌধুরী চুপ করিয়া গেল।
বিভূতি দাতে দাতে ঘষিয়া বলিল, আমি যদি ওদের তোমার মতো অবস্থা না করি, তোমার ব্যাটা নই আমি।
কাতরাইতে কাতরাইতে চোখ মেলিয়া মহেশ চৌধুরী বলিল, তুমি যদি আবার ওদের পিছনে লাগতে যাও, তোমায় আমি জন্মের মতো ত্যাগ করব বলে রাখছি।
তা তুমি ত্যাগ কর। তাই বলে ঘাড় খুঁজে এ অন্যায় সহ্য করা–
কিসের অন্যায়? যদি করেই থাকে অন্যায়, তোর কি? মেরেছে আমাকে, তোমাকে তো মারে নি, তোমার মাথা ঘামাবার দরকার?
বাঃ বেশ! বলিয়া বিভূতি খানিকটা হতভম্বর মতোই বসিয়া রহিল। মহেশ চৌধুরী বলিতে লাগিল, তুমি ওদের পেছনে লাগবে, বদনাম রটবে আমার। সবাই বলবে আমি তোমায় দিয়ে। ওদের মারিয়েছি।
বিভূতি বলিল, তুমি এমন কাপুরুষ!
কাপুরুষঃ
নয় তো কি? লোকে নিন্দে করবে ভয়ে মুখ বুজে এত বড় অন্যায় সহ্য করে যাবে? লোকের নিন্দা-প্রশংসা দিয়ে তোমার নীতি ঠিক হয়, আর কিছু নেই তার পেছনে?
বিভূতির মা ব্যাকুলভাবে বলিল, চুপ কর না বিভূতি? কি যে তোরা আরম্ভ করেছিস?
বিভূতি কথাটা গ্রাহ্য করিল না, চুপচাপ একটু ভাবিয়া বলিল, নিন্দা-প্রশংসা তো আমারও আছে। আমার বাপকে ধরে পিটিয়ে দিল, আমি যদি চুপ করে থাকি, লোকে আমায় অপদার্থ বলবে। ভীরু কাপুরুষ বলবে।
মহেশ সভয়ে বলিল, কি করব তুই?
বিভূতি বলিল, ওদের বুঝিয়ে দেব, মারতে কেবল ওরা একাই জানে না।
তাতে লাভ কি হবে?
ভবিষ্যতে আর এ রকম করবে না।
আরো বেশি করে করবে। তার চেয়ে সেরে উঠে আমি যদি গিয়ে হাসিমুখে এদের সঙ্গে কথা বলি, ভাই বলে জড়িয়ে ধরি, ওরা কি রকম লজ্জা পাবে বল তো?
ছাই পাবে। ভাববে, আবার মার খাবার ভয়ে খাতির করছ।
মহেশ শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিল, আর তার তর্ক করার ক্ষমতা ছিল না। তখনকার মতো সে চুপ করিয়া গেল। কিন্তু বিভূতি উঠিয়া যাইবার উপক্রম করিতেই আবার তাকে ডাকিয়া বসাইয়া বুঝাইবার চেষ্টা আরম্ভ করিয়া দিল। রাগ করিয়া, মিষ্টি কথা বলিয়া, মিনতি করিয়া, কতভাবে যে সে বিভূতিকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করি। যতই সে কথা বলিতে লাগিল, বিভূতির কাছে ততই স্পষ্ট হইয়া উঠিতে লাগিল তার ভয়ের পরিচয় মার খাইয়া মহেশ চৌধুরী মার ফিরাইয়া দিয়াছে, মানুষের কাছে এইরকম অসভ্য বর্বররূপে পরিগণিত হওয়ার ভয়! মহেশ চৌধুরীকে এমন দুর্বল বিভূতি আর কখনো দেখে নাই। শেষে বিরক্ত হইয়া সে বলিল, আচ্ছা সে দেখা যাবে। বলিয়া ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।
নিজের ঘরে গিয়া বিছানায় শুইয়া পড়িয়া সে ভাবিতে লাগিল। হাতাহাতি মারামারি সে নিজেও কোনোদিন পছন্দ করে না, ও সমস্ত সত্যই নীচতা। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই কি তাই? মহেশ চৌধুরী কোনো অপরাধ করে নাই, কেবল তার বাবা বলিয়া তাকে যারা মারিয়াছে, উদারভাবে তাদের ক্ষমা করাটা কি উচিত? তাকে কি উদারতা বলে? তার চেয়ে ছোটলোকের মতো ওদের ধরিয়া কিছু উত্তম-মধ্যম লাগাইয়া দেওয়াই কি মহত্ত্বের পরিচয় নয়, মনুষ্যত্বের প্রমাণ নয়? ভাবিতে ভাবিতে বিভূতি বুঝিতে পারি, মাধবীলতা ঘরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। গতরাত্রে মাধবীলতাকে বিশ্রী ধমক দিয়া কাঁদানোর কথাটা মনে পড়ায়, ভাব করার উদ্দেশ্যে হঠাৎ সে মাধবীলতার কাছে পরামর্শ চাহিয়া বসিল।
মাধবীলতা চোখ বড় বড় করিয়া বলিল, ওদের মেরে ফেলা উচিত, খুন করে ফেলা উচিত। বিভূতি হাসিয়া বলিল, সত্যি? কিন্তু ওরা যদি আমায় মেরে ফেলে?
বিভূতি হাত বাড়াইয়া দিতে মাধবীলতা তার বুকের মধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়িল। এতক্ষণ যেন। অধীর আগ্রহে সে এইজন্যই অপেক্ষা করিতেছিল। বিকারের সঙ্গে ভালবাসার তীব্রতা বাড়িয়া গিয়াছে। বিকার ছাড়া স্বাভাবিক মায়ামমতা জোরালো হয় না। এক রাত্রির অভিমান-সংক্ষুব্ধ বিরহ মাধবীলতাকে অধীর করিয়া দিয়াছে।