ক্ৰমে ক্ৰমে নানারকম আফসোসমূলক মন্তব্য ও প্রশ্নের বাধা ডিঙাইয়া আসল ব্যাপারটা বিভূতির বোধগম্য হয়। কারো বৌ-ঝি কেউ সম্প্রতি হরণ করে নাই, যদিও কিছুকাল আগে এ রকম একটা ব্যাপার এই গ্রামেই ঘটিয়া গিয়াছে। সকলের বর্তমান রাগ, দুঃখ আর আফসোসের কারণটা এই। নন্দনপুরের ভদ্রলোকেরা গ্রামে গ্রামে চাঁদা তুলিয়া পাকা নাটমন্দিরের অভাব মিটানোর জন্য খড়ের একটা চালা তুলিয়াছে। তার নিচে নানা উপলক্ষে, মাঝে মাঝে বিনা উপলক্ষেও, যাত্ৰাগান, কীর্তনগান প্রভৃতি হয়। খড়ের নাটমন্দিরটিতে স্থান একটু কম, তবে সাধারণ অনুষ্ঠানের সময় সেই স্থানও সবটা ভরে না। মুশকিল হয় ভালো দলের যাত্রা বা নাম-করা কীর্তনীয়ার কীর্তন বা ঐ রকম কোনো প্রোগ্রাম থাকিলে, যার আকর্ষণ আছে! তখন চালার নিচে অর্ধেক লোকের বসিবার স্থান হয় না, ভিড়ের বাহিরে দাঁড়াইয়া শুনিতে হয়। তাতেও কোনো আপত্তি ছিল না, যদি ও-গ্রামের ভদ্রলোকেরা এগ্রামের ভদ্রলোকদের মাঝে মাঝে সামনে গিয়া বসিতে দিত।
জায়গা থাকলেও বসতে দেয় না দাদাবাবু। এগিয়ে গিয়ে বসতে গেলে ঠেলে পিছনে হটিয়ে দেয়। কেন আমরা শতরঞ্চিতে বসতে পারি না সামনের দিকে? চাঁদা দিই না আমরা? ওকি তোদের বাপের সম্পত্তি যে, শুধু গাঁয়ের বাবুদের জন্যে বেদখল করে রাখিস?
আগের দিন শ্রীধর, রামলোচন এবং আরো অনেকে যাত্রা শুনিতে গিয়াছিল। সামনের দিকে। অনেকটা জায়গা খালি পড়িয়া আছে দেখিয়া যেই বসিতে গিয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে গলাধাক্কা। কে একজন শ্ৰীধরের পিঠে সত্যই একটা ধাক্কা দিয়াছিল এবং আরেকজন রামলোচনের বাবরি ধরিয়া দিয়াছিল টান।
শেষে ভিড়ের পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাত্রা শুনি।
বিভূতি আশ্চর্য হইয়া বলে, তারপরেও যাত্রা শুনলে?
শুনব না? চাঁদা দিই নি আমরা?
বিভূতি খানিকক্ষণ চুপ করিয়া সকলের মন্তব্য শুনিয়া যায়, তারপর জিজ্ঞাসা করে, ওরা কি বলল, যারা তোমাদের ঠেলে সরিয়ে দিলে?
জবাব দিল শ্রীধর, কি আর বলবে দাদাবাবু, বলল, পিছন দিকে তোমাদের জন্যে বসবার জায়গা থাকে, আগে এসে বসতে পার না?
একটা দিন হয়তো বিশেষ কারণে—
একটা দিন? প্রত্যেকবার এমনি হচ্ছে, একটা দিন কি দাদাবাবু! মোদের গায়ের কেউ সামনে গিয়ে বসতে পায় না।
এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিতে বিভূতির সাধ যায় না। মনে হয়, প্রতিবাদ করার মতো ব্যাপারও এটা নয়। যাত্রা শুনিতে গিয়া গ্রামের কয়েকজন বসিবার স্থান পায় নাই বলিয়া কি বিচলিত হওয়া চলে? তবু বসিবার স্থানের উপর এ-গ্রামের লোকেরও অধিকার আছে, স্থান থাকিলেও যদি তাদের বসিতে দেওয়া না হয়, সেটা অন্যায়। অন্যায়ের প্রতিকার করা কর্তব্য। নিজের চোখে দেখিয়া ব্যাপারটা ভালো করিয়া বুঝিবার উদ্দেশ্যে বিভূতি বলে, সামনের জন্মাষ্টমীতে যাত্রাটাত্রা হবে না?
শ্ৰীধর বলে, তিন রাত্তির হবে, অনেক মজা আছে দাদাবাবু।
বিভূতি বলে, তোমরা সবাই আমার সঙ্গে যে, দেখি কেমন বসতে না দেয়।
একজন একটু সংশয়ভরে জিজ্ঞাসা করে, কি করবেন?
বিভূতি হঠাৎ রাগিয়া উঠিয়া বলে, আমি একা কি করব? তোমরা সবাই করবে–জায়গা থাকলে সেখানে বসে পড়বে। আবার কি?
১৮. নেতা হওয়া যে এত সহজ
নেতা হওয়া যে এত সহজ আর নেতৃত্ব করা এমন কঠিন, বিভূতি তা জানি না। এবার সে ব্যাপারটা ভালো করিয়া বুঝিতে পারে। শ্রীধরের দোকানে বসিয়া মাত্র কয়েকজনের কাছে সে আবেগের সঙ্গে ঘোষণা করিয়াছিল যে নন্দনপুরের যাত্রার আসরে সামনে বসিবার অধিকার সে তাদের আদায় করিয়া দিবে। জন্মাষ্টমীর দিন দেখা গেল নানা বয়সের প্রায় দেড় শ মানুষ তার এই অধিকার আদায়ের অভিযানে যোগ দিয়াছে। শ্রীধর বা রামলোচনের মত যারা অন্তত ফতুয়া গায়ে দিয়া যাত্রা শুনিতে যায়, এদের অধিকাংশই সমাজের সে-স্তরের মানুষও নয়। এর যাত্রা শুনিতে যায় গামছা কাঁধে, আসরে সামনের দিকে ভদ্রলোকদের মাঝে বসিতে পাইলে বোধহয় রীতিমতো অস্বস্তিই বোধ করে। শ্ৰীধর, রামলোচন প্রভৃতির মতো চাঁদা দিয়াও সামনে বসিতে না পাওয়ার অপমানে এরা ক্ষুব্ধ হয় নাই। চাদাই বা এদের মধ্যে কজন দিয়াছে কে জানে! কোথা হইতে দিবে? খাজনা দিতে যাদের অনেকের ঘটিবাটি বাধা দিতে হয়, চাঁদা দেওয়ার বিলাসিতা তাদের কাছে প্রশ্রয় পায় না।
তবু তার নেতৃত্বে যাত্রার আসর আক্রমণের জন্য সকলে যেন উৎসুক হইয়া উঠিয়াছে। নন্দনপুরের স্থায়ী আটচালার নিচে সর্বসাধারণের যাত্রার আসর। চাঁদা দিক বা না দিক, গায়ে ফতুয়া থাক বা না থাক, এদের সকলেরই অবশ্য সে আসরে সামনে বসিবার অধিকার আছে। কিন্তু এরা কি তাই চায়? সেজন্যই কি এরা সকলে জড়ো হইয়াছে? বাঁচিবার অধিকার সম্বন্ধে মাঝে মাঝে এদের সে যে সব কথা বলিয়াছে, এ কি তারই প্রতিক্রিয়া?
এই প্রশ্ন বিভূতিকে পীড়ন করিতে থাকে। তার বক্তৃতা আর উপদেশ এতগুলি মানুষের মধ্যে সাড়া জাগাইয়াছে, এ কথা বিশ্বাস করিতে ভালো লাগে কিন্তু নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করিতে পারা যায়। না। গ্রামের সঙ্গে গ্রামের প্রতিযোগিতা থাকে, মনোমালিন্য থাকে–এক গ্রাম অন্য গ্রামকে অনায়াসে হিংসা করে। কে জানে এরা নন্দনপুরের অধিবাসীদের একটু জব্দ করিতে চলিয়াছে কিনা? শ্ৰীধর, রামলোচন আর অন্যান্য কয়েকজন ফতুয়াধারী হয়তো নিজেদের কোনো উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য এই সব অশিক্ষিত সরল মানুষগুলিকে ক্ষেপাইয়া দিয়াছে। যাত্রার আসরে হয়তো আজ একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটিয়া যাইবে।