তবে, সীমাবদ্ধ জ্ঞান মানুষকে এমনিভাবে সংগ্রহ করিতে হয়, সঙ্কীর্ণ জীবনের তুচ্ছ সমস্যার বিচারও করিতে হয় এমনিভাবে। তা ছাড়া আর উপায় নাই। জন্ম হইতে সকলে আমরা করিয়াও আসিতেছি তাই। শৈশবেও সমস্যার মীমাংসা করিয়াছি, আজো করিতেছি। তখন যেটুকু জ্ঞান · আয়ত্তে ছিল কাজে লাগাইতাম, আজ যেটুকু জ্ঞান আয়ত্তে আছে কাজে লাগাই। তখনকার জ্ঞান হয়তো ছিল মোটে কয়েকটি টুকরা জ্ঞানের যোগফল, আজকের জ্ঞান হয়তো অনেক বেশি টুকরার মিলিত পরিণাম, কিন্তু তখনো যেমন আর টুকরাগুলির জন্য ভিন্ন ভিন্নভাবে মাথা ঘামাইতাম না, আজো ঘামাই না। জলের সঙ্গে জল মেশার মতো, আলো মেশার মতো, আলোর সঙ্গে আলো মেশার মতো, মিলিত আংশিক জ্ঞানের পার্থক্য ঘুচিয়া গিয়াছে।
সমস্ত মানুষ, মনের মধ্যে কোনো প্রশ্ন জাগিলে, সাময়িক যুক্তি বা সত্যোপলব্ধির সম্পত্তি দিয়া তার বিচার করে এবং সঙ্গে সঙ্গে তার জবাবও পায়। জবাব না মানা আর নিজের মনের সঙ্গে লড়াই করা আর নিজের ভবিষ্যৎ পরিবর্তিত যুক্তি বা সত্যোপলব্ধির কাছে আপিলের ভরসা করা। অবশ্য ভিন্ন কথা। তবে সাধারণ আপিলের ফলটাও হয়তো মন মানিতে চায় না–শেষ যুক্তি বা শেষ সত্যের আদালত খুঁজিয়া মরিতে হয়।
সীমাবদ্ধ সংক্ষিপ্ত জ্ঞানের জগতের সমগ্ৰতার আশীর্বাদ মানুষ ক্ৰমে ভুলিয়া যাইতেছে। সংশয়বাদের রোগ ধরিয়াছে মানুষকে। প্রত্যেক প্রশ্নের বিচার করিতে আজ তাকে সেই প্রশ্নের সঙ্গে। সংশ্লিষ্ট বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের খোঁজ করিতে হয়। কে জানে এমন একদিন আসিবে কিনা, যেদিন কেহ আমার এই উপন্যাসটি পড়িতে বসিয়া প্রথম লাইনটি পড়িয়া ভাবিতে আরম্ভ করিবে, লাইনটির যে অর্থ মনে আসিয়াছে তাই কি ঠিক, অথবা প্রত্যেকটি শব্দের আর প্রত্যেকটি অক্ষরের অর্থ বিশ্লেষণ। করিয়া, ব্যাকরণের নিয়ম-কানুনগুলি ভালো করিয়া ঘটিয়া, শব্দতত্ত্ব আর ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান। অর্জন করিয়া লাইনটির মানে যাচাই করা উচিত?]
একটি দুপুর তো বিভূতির মাধবীলতার সঙ্গে অপরিসীম আনন্দে কাটিয়া গেল, কিন্তু রাত্রি? পরের দিনের দুপুরটা? তার পরের দিনগুলি? দুপুরটা যেন ছিল মাতালের মাঝরাত্রির মতো, শেষ হওয়ার সঙ্গে জীবনের আর কিছুই যেন রহিল না। তারপর কয়েকদিন ধরিয়া মাতলামির ক্ষুধায়। ভিতরটা যেন জ্বলিয়া যাইতে লাগিল। কিন্তু স্নায়বিক বিকারের ভাটিখানায় বড় বেশি খামখেয়ালি চলে।
তাই আর কোনো কারণ, কোনো তুচ্ছতম নূতন ঘটনা না ঘটিলেও মাধবীলতার উপর অবিশ্বাসে বিভূতির যেন প্রায় বিশ্বাস জন্মিয়া গেল। অনেক যুক্তিই মনে আসিতে লাগিল, তার মধ্যে সর্বপ্রধান, সে নিজে অতি অপদার্থ, আকর্ষণহীন, কুৎসিত পুরুষ। কেবল তাকে নিয়া খুশি থাকা মাধবীলতার পক্ষে কি সম্ভব?
হঠাৎ আবার একদিন বিভূতি জেরা আরম্ভ করে, কই, সেদিন আশ্রমে গিয়েছিলে কেন, তা তো বললে না?
মাধবীলতা ভয় পাইয়া বলে, বললাম যে?
কই বললে? ওই যে সেদিন বললাম।
হুঁ, বলিয়া বিভূতি চুপ করিয়া যায়।
গভীর বিতৃষ্ণায় পিছন ফিরিয়া সে শুইয়া থাকে, মাধবীলতা মৃদুস্বরে ডাকিলে বলে বড় ঘুম পাইয়াছে। ঘুম কিন্তু আসে না, মনের অস্বস্তি দেহের একটা অপরিচিত যন্ত্রণার মতো তাকে জাগাইয়া রাখে। মনে হয়, ঠিক চামড়ার নিচে সর্বাঙ্গে পেটের অম্বলের জ্বালা যেন ছড়াইয়া গিয়াছে আর বাহিরের গুমোটে তাতিয়া উঠিয়াছে মাথাটা। অথচ এমন আশ্চর্য ব্যাপার, শেষত্রে ঘুমাইয়া পরদিন যখন অনেক বেলায় ঘুম ভাঙে, মনের অবস্থাটা একেবারে বদলাইয়া গিয়াছে। পাশে যে অসতী স্ত্রী ছিল গত রাত্রে, অবিশ্বাসের সবকিছু ঝাড়িয়া ফেলিয়া আজ সকালে সে যেন চোখের আড়ালে সংসারের কাজ করিতে গিয়াছে। আগের রাত্রের ধারণা আজ বিভূতির নিছক ছেলেমানুষি মনে হয়। এমন তুচ্ছ মনে হয় কথাটা যে, ও বিষয়ে একটু চিন্তা করাটাও তার কাছে পরিশ্রমের অপচয়ের শামিল হইয়া দাঁড়ায়। দুঃস্বপ্ন দেখিয়া যেন বিচলিত হইয়াছিল, দুঃস্বপ্ন কাটিয়া গিয়াছে। অনুভূতির জগতে যদি বা একটা দুর্বোধ্য আতঙ্কের জের এখনো আছে, পেটে অম্বলের শক্ৰতা নাই, দেহে টনটনানি নাই, মাথায় গ্রীষ্মবোধও নাই। একটু শুধু ভারি মনে হইতেছে দেহটা। বোধহয় হৃদয়ের ঈষৎ চাপা-পড়া বেদনাবোধের ভারে।
চা আর খাবার খাইয়া বিভূতি গ্রামের দিকে যায়। শেষরাত্রে বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। আকাশে অল্প অল্প মেঘের জন্য রোদেরও তেমন তেজ নাই। ঘুরিতে ঘুরিতে বিভূতি গিয়া হাজির হয় শ্রীধরের দোকানে। দোকানের সামনে কাঠের বেঞ্চে বসিয়া কয়েকজন ফিসফাস করিতেছিল, বিভূতিকে দেখিয়া তারা অপরাধীর মতো চুপ করিয়া যায়।
শ্ৰীধর অভ্যর্থনা জানাইয়া বলে, আসেন। বসেন। বিড়ি খান?
বিভূতি বসে কতকটা উদাসভাবেই, মাথা নাড়িয়া বলে, বিড়ি তো আমি খাই না।
শ্ৰীধর সঙ্গে সঙ্গে সায় দিয়া বলে, ঠিক বটে, শহরে ছিলেন এতকাল, আপনারা খান সিগারেট। তা তো নেই দাদাবাবু! তারপর কোথা হইতে কি করিয়া শ্ৰীধর যে মারাত্মক গাম্ভীৰ্য মুখে টানিয়া আনে, সে-ই জানে, একটা অদ্ভুত আফসোসের শব্দ করিয়া বলে, শহর ভালো। জানেন দাদাবাবু, মোদের এ সব লক্ষ্মীছাড়া গাঁয়ের চেয়ে শহর ঢের ঢের ভালো। বৌ-ঝি নিয়ে নিস্তাবনায় ঘর তো করা চলে–ঘরের বৌ-ঝিকে তো কেউ জোর করে ধরে নিয়ে যায় না।
যারা ফিসফাস করিতেছিল, তারা সকলে একবাক্যে সায় দেয়। একজন, রামলোচন দে, কাঁচাপাকা চুলের বাবরিতে ঝাঁকি দিয়া বলে, আপনি তো বলে খালাস দাদাবাবু, মরি যে আমরা। হুঁ, নিজের দোষে মরি তো বটে, উপায় কি বলেন?