জটিল, খাপছাড়া, সব রাশি রাশি কথা চিন্তাগুলি যেন হেঁড়া কাগজের মতো মনের ঘরে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল, হঠাৎ দমকা হাওয়ায় এলোমেলো উড়িতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। এ রকম অবস্থায় মহেশ চৌধুরী কথা বলে না। তাছাড়া আর উপায় কি আছে? এমন অভ্যাস জন্মিয়া গিয়াছে। যে, বিচার-বিবেচনার পর একটা কিছু সিদ্ধান্ত দিয়া না বুঝিলে মনের ভাব আর প্রকাশ করা যায় না। আত্মা-বিরোধী মত যদি কিছু প্রকাশ করিয়া বসে? সেটা প্রায় সর্বনাশের শামিল। কেন সর্বনাশের শামিল, তা অবশ্য মহেশ চৌধুরী কখনো ভাবিয়া দেখে নাই, তবে ক্ষতির সম্ভাবনাকে আত্মরক্ষী জীবমাত্রেই ভয় করে। নিজের সুখ-দুঃখের মুখাপেক্ষী করার নীতি যাকে মানিয়া নিতে হয়, অস্বাভাবিক সংযম তার একমাত্র বর্ম। রাগে, দুঃখে, অভিমানে বিচলিত হওয়া মহেশ চৌধুরীর পক্ষে সম্ভব, কিন্তু উচিত কি অনুচিত না জানিয়া পোষা বিড়ালকে মারার জন্য বিভূতিকে চড়চাপড়টা মারিয়া বসাও সম্ভব নয়, গালাগালি দেওয়াও সম্ভব নয়।
কয়েকবার ঢোঁক গিলিয়া মহেশ চৌধুরী একেবারে চুপ করিয়া যায়। অন্য বিষয়েও একটি শব্দ আর তার মুখ দিয়া বাহির হয় না। খাওয়াও তখনকার মতো শেষ হয় সেইখানে।
বিস্ফারিত চোখে খানিকক্ষণ মরা বিড়ালটার দিকে চাহিয়া থাকিয়া মাধবীলতা প্রথম ভয়ে ভয়ে। কথা বলে, কেন মিরলে? কি নিষ্ঠুর তুমি!
যেখানে যেখানে আঁচড় দিয়েছে, আইডিন লাগিয়ে দাও গিয়ে।
আঁচড় লাগে নি।
কথাটা বিভূতি সহজে বিশ্বাস করিতে চায় না। একটুও আঁচড় দেয় নাই? একেবারে না? কি আশ্চর্য ব্যাপার! তবে তো বিড়ালটাকে না মারিলেও চলিত। বোকার মতো একটু হাসে বিভূতি, মরা বিড়ালটার দিকে চাহিয়াই মুখ ফিরাইয়া নেয়। বেশ বুঝিতে পারা যায় সে যেন একটু স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছে বিস্ময়ে নয়, ব্যথা লাগে না এমন কোনো আকস্মিক ও প্রচণ্ড আঘাতে। মহেশ চৌধুরীর নির্বাক থাকার চেয়ে বড় সংযম যেন বিভূতির দরকার হইতেছে শুধু সহজ নির্বিকার ভাবটা বজায় রাখতে। বিচলিত হওয়ার উপায় তো বেচারির নাই। মনের কোমল দুর্বলতা যদি প্রকাশ পাইয়া যায়? সেটা প্রায় সর্বনাশের শামিল। কেন সর্বনাশের শামিল, তা অবশ্য বিভূতি কখনো ভাবিয়া দ্যাখে নাই, তবে অন্যায়-বিরোধী মানুষমাত্রেই নিজের দুর্বলতাকে চাপা দিতে চায়। পরের দুঃখ কমানোর জন্য নিজের দুঃখকে তুচ্ছ করার নীতি যাকে মানিয়া নিতে হয়, অস্বাভাবিক সংযম তারও বৰ্ম। অনুতাপে থতমত খাইয়া যাওয়া বিভূতির পক্ষে সম্ভব, কিন্তু স্ত্রীকে আক্রমণ করার জন্য তুচ্ছ একটা বিড়ালকে শাস্তি দিয়া ব্যাকুলতা প্রকাশ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
চাকর বিড়ালের দেহটা তুলিয়া নিয়া যায়। বিভূতি আবার খাইতে আরম্ভ করে। খাইতে খাইতে ধীরে ধীরে সে আত্মসংবরণ করিতে থাকে। আত্মসংবরণ করিতে সময় তার বেশিক্ষণ লাগে। না, খাওয়াদাওয়ার পর মাধবীলতা যখন আজ শশধরের বৌয়ের সঙ্গে গল্প করার বদলে পান হাতে স্বামীর ঘরে ঢুকিয়া ভিতর হইতে দরজাটা বন্ধ করিয়া দেয়, বিভূতির মন তখন কঠিন কর্তব্য সম্পন্ন করার গাঢ় আর আঠার মতো চটচটে তৃপ্তিতে ভরিয়া গিয়াছে। দুপুরটা সেদিন দুজনের গভীর আনন্দে কাটিয়া গেল। পুরুষ আর নারীর প্রথম যৌবনের সব দুপুর ও রকম আনন্দে কাটে না।
বিভূতির মা ঘরে যায় দুধের বাটি হাতে। মহেশ একরকম কিছুই খায় নাই।
খাও?
মহেশ কথা বলে না, শুধু মাথা নাড়ে। কিন্তু শুধু মাথা নাড়িয়া পতিব্ৰতা স্ত্রীকে কে কবে ঠেকাইতে পারিয়াছে? শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিতে হয়, কেন জ্বালাতন করছ? এখন কিছু খাব না।
কেন খাবে না?
বিভূতির মার নিজেরও খাওয়া হয় নাই, ক্ৰমে ক্ৰমে মেজাজ চড়িতেছিল, আবার খানিকক্ষণ নীরব থাকিয়া মহেশ যখন সংক্ষেপে কৈফিয়ত দেয় যে, মনের উত্তেজনার সময় খাইলে শরীর খারাপ হয়–বিভূতির মার মেজাজ রীতিমতো গরম হইয়া ওঠে।
কচি খোকার মতো কি যে কর তুমি!
ভালো করিয়া কথা বলিলে, এমন কি রীতিমতো ঝগড়া করিলেও, হয়তো বিভূতির মা তখনকার মতো শুধু রাগে গগর করিতে করিতে চলিয়া যাইত, এক ঘণ্টা পরে আবার ফিরিয়া আসিত দুধের বাটি হাতে। কিন্তু এভাবে কথা পর্যন্ত বলিতে না চাহিলে কি মানুষের সহ্য হয়? বিভূতির মা তো আর জানি না, নিজের মনের সঙ্গে মহেশ বোঝাপড়া করিতেছে, কত যে বিচার-বিশ্লেষণ চলিতেছে, তার সীমা নাই। খোলা দরজা দিয়ে দুধের বাটিটা ছুড়িয়া ফেলিয়া দিয়া বিভূতির মা আগাগোড়া একটা বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়া দেয়ালের দিকে মুখ করিয়া শুইয়া রহিল।
তখন মনটা মহেশ চৌধুরীর বড় খারাপ হইয়া গেল। কি দোষ করিয়াছে বিভূতির মা? অন্যের পাপে সে কেন কষ্ট পায়? সেদিনের কথা মহেশের মনে পড়িতে থাকে, সদানন্দের কুটিরের সামনে তার সঙ্গে বিভূতির মা যখন গাছতলায় বৃষ্টিতে ভিজিতেছিল। বিছানার একপ্রান্তে পা গুটাইয়া বসিয়া। মহেশ ভাবিতে থাকে। বিভূতির মাকে তুলিয়া খাওয়ানো যায়, সেটা তেমন কঠিন কাজ নয়। কিন্তু কি লাভ হইবে? বিভূতির সম্বন্ধে যা সে ভাবিতেছে, তাই যদি স্থির করিয়া ফেলে, তখন বিভূতির মাকে যে কষ্টটা ভোগ করিতে হইবে, তার তুলনায় এখনকার এ কষ্ট কিছুই নয়।
বিভূতিকে বাড়ি হইতে চলিয়া যাইতে বলিবে কিনা, এই কথাটাই মহেশ ভাবিতেছিল। বিড়াল মারার জন্য নয়, বিভূতির প্রকৃতি যে কখনো বদলাইবে না, এটা সে ভালো করিয়া টের পাইয়া গিয়াছে বলিয়া। এখন বিভূতিকে বাড়িতে থাকিতে দেওয়ার অর্থই কি তাকে সমর্থন করা নয়? শুধু ছেলে বলিয়া তাকে আর কি ক্ষমা করা চলে, চোখ কান পুঁজিয়া আর কি আশা করা চলে এখনো তার সংশোধন সম্ভব? বিনা প্রতিবাদে এখন চুপ করিয়া থাকা আর বিভূতিকে স্পষ্ট বলিয়া দেওয়া যে, সে যা খুশি করিতে পারে, এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। তার ছেলে বলিয়া বিভূতির অন্যায় করার যে বিশেষ সুযোগসুবিধা আছে, মানুষের উপর যে প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে, বিভূতিকে জানিয়া শুনিয়া সে সমস্ত ব্যবহার করিতে দেওয়া আর তার নিজের অন্যায় করার মধ্যেই বা পার্থক্য কি? মনে মনে মহেশ চৌধুরী স্পষ্টই বুঝিতে পারে, এ বিষয়ে আর ভাবিবার কিছু নাই, বিভূতিকে বাড়ি ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে বলা উচিত কি অনুচিত, এটা আর প্রশ্নই নয়, এখন আসল সমস্যা দাঁড়াইয়াছে এই যে, বিভূতি তার ছেলে। বিভূতি যে তার স্ত্রীরও ছেলে, এটা এতক্ষণ মহেশের যেন খেয়াল ছিল না। বিভূতির মার চাদরমুড়ি দেওয়া মূর্তি এই আসল সমস্যাটাকে তাই একটু বেশিরকম জটিল করিয়া দিয়াছে।