অন্য সকলের, পুরুষ ও নারীদের, বিস্ময় নাই। সকলে মুগ্ধ, উত্তেজিত। কথা শেষ করিয়া সদানন্দ হাসিমুখে উঠিয়া দাঁড়ায়, ধীরে ধীরে একা নদীর দিকে আগাইয়া যায়। যে মৃদু গুঞ্জনধ্বনি ক্ষণকালের স্তব্ধতার শেষে শুরু হয়, তার মধ্যে অনেকগুলি আত্মসমৰ্পিত মনের সার্থকতার আনন্দ যেন রবীন্দ্রনাথের গানের সুরের মতো প্রাঞ্জল মনে হয়। অন্তত মহেশের যে মনে হয় তাতে সন্দেহ নাই, কারণ সে আরো বেশি থতমত খাইয়া সদানন্দের গতিশীল মূৰ্তির দিকে হাঁ করিয়া তাকাইয়া থাকে।
রত্নাবলীর সঙ্গে তার কুটিরে যাওয়ার আগে মাধবীলতা তাকে খবরটা দিতে আসিল, ফিরিবার সময় যাতে তাকে খোঁজ করার হাঙ্গামা না বাধে।
মহেশ চৌধুরী বলিল, আমরা আজ এখানে থাকব মাধু।
সারা দিন?
সারা দিন তো বটেই, সারা রাতও থাকতে পারি।
মাধবীলতা এই উদ্ভট সিদ্ধান্তের কারণটা জানিবার চেষ্টা আরম্ভ করার আগেই মহেশ চৌধুরী উঠিয়া চলিতে আরম্ভ করিয়া দিল। সদানন্দ তখন চোখের আড়ালে চলিয়া গিয়াছে। নদীর ধারে অনেক খোঁজাখুঁজি করিয়াও তার দেখা না পাইয়া মহেশ চৌধুরী অবশ্য বুঝিতে পারিল যে, নদীর দিকের খিড়কি দরজা দিয়া সদানন্দ কুটিরে ফিরিয়া গিয়াছে, কিন্তু নিজে সে কুটিরে ঢুকি না। রত্নাবলীর কুটিরে ফিরিয়া গিয়া মাধবীলতাকে বলিল, ওঁকে একবার ডেকে আন তো মাধু।
মাধবীলতা অবাক! ডেকে আনব? এখানে?
হ্যাঁ। বলগে, আমি একবার দেখা করতে চাই।
মহেশ চৌধুরী হুকুম দিয়া ডাকিয়া আনিয়া দেখা করিবে সদানন্দের সঙ্গে। প্রতিবাদ করিতে গিয়া কিছু না বলিয়াই মাধবীলতা চলিয়া গেল। হঠাৎ তার মনে পড়িয়া গিয়াছিল মহেশ চৌধুরীর পাগলামির মানে বুঝিবার ক্ষমতা এতদিন এক বাড়িতে থাকিয়াও তার জন্মে নাই।
প্রায় এক ঘণ্টা পরে, রত্নাবলী যখন ব্যস্ত আর বিব্রত হইয়া বার বার বলিতে আরম্ভ করিয়াছে। যে, তার একবার গিয়া খোঁজ করিয়া আসা উচিত, মাধবীলতা ফিরিয়া আসিল। সদানন্দ বলিয়া পাঠাইয়াছে, দেখা করিবার দরকার থাকিলে মহেশ চৌধুরী যেন সন্ধ্যার পর তার সঙ্গে দেখা করিয়া আসে। শুনিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া মহেশ চৌধুরী বলিল, চল আমরা ফিরে যাই মাধু।
সারা দিন এখানে থাকবেন বলেছিলেন যে?
আর থেকে কি হবে? ভেবেছিলাম মানুষটা বুঝি হঠাৎ বদলে গেছে, কিন্তু মানুষ কি কখনো বদলায়?
মানুষ যে বদলায় না, তার আরেকটা মস্ত বড় প্রমাণ পাওয়া গেল ফিরিবার পথে। চরডাঙ্গা গ্রামের কাছাকাছি মস্ত একটা মাঠে পঁচিশত্রিশ জন অর্ধ-উলঙ্গ নোংরা মানুষকে আত্মহত্যা করিতে বিভূতি নিষেধ করিতেছে। মুখে ফেনা তুলিয়া এমনভাবে নিষেধ করিতেছে যেন কোনোরকমে এই লক্ষ্মীছাড়া বোকা মানুষগুলোকে কথাটা একবার বুঝাইয়া দিতে পারিলেই তারা হত্যা করিবে।
তবু আর এভাবে আত্মহত্যা করিবে না।
একসঙ্গে খাইতে বসিয়া মহেশ চৌধুরী সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করিল, আবার কি তুমি জেলে যেতে চাও?
সাধ করে কেউ জেলে যায়?
বিভূতির মেজাজটা ভালো ছিল না।
অমন করে ওদের ক্ষেপিয়ে তুললে জেলেই তো যেতে হয় বাবা? একটু কিছু ঘটলেই তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে।
নেয় নেবে।
মহেশ চৌধুরী ডালমাখা ভাত খায় আর ভাবে। বুঝাইয়া কোনো লাভ হইবে না। এই কথাটাই অনেকবার অনেকভাবে ছেলেকে সে বুঝাইয়াছে যে, অকারণে জেলে গিয়া কোনো লাভ হয় না, সেটা নিছক বোকামি–কাজের মতো কোনো কাজ করিয়া ছেলে তার হাজার বার জেলে যাক, হাজার বছরের জন্য জেলে যাক, মহেশ চৌধুরীর তাতে তো কোনো আপত্তি নাই! কিন্তু পাহাড়ে উঠিবার উদ্দেশ্যে সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার মতো দেশ আর দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য চোখ কান বুজিয়া জেলে যাওয়ার তো কোনো অর্থ হয় না। মনে হইয়াছিল, বিভূতি বুঝি কথাটা বুঝিতে পারিয়াছে বিভূতি চুপচাপ শুনিয়া গিয়াছে, তর্কও করে নাই, নিজের মতামত জাহির করিবার চেষ্টাও করে নাই। আজ আবার মহেশ চৌধুরীর মনে হইতে লাগিল, অনেক দিন পরে বাড়ি ফিরিয়া সে শুধু বাপের সঙ্গে কথা কাটাকাটি এড়াইয়া চলিয়াছিল, কথাগুলি তার মাথায় ঢোকে। নাই।
একবার টোক গিলিয়া মহেশ চৌধুরী এক চুমুকে জলের গ্লাসটা প্রায় অর্ধেক খালি করিয়া ফেলিল। ছেলেও যদি তার সহজ সরল কথা না বুঝিয়া থাকে–
অথবা এ সব কথা বুঝিবার নয়? মানুষ যা করিতে চায় তাই করে?
অল্প দূরে মহেশের পোমানা বিড়ালটি ঘাপটি মারিয়া বসিয়া ছিল। মাছের ঝোল পরিবেশন করিতে আসিবার সময় বেচারির লেজে কি করিয়া মাধবীলতার পা পড়িয়া গেল কে জানে, চমক দেওয়া আওয়াজের সঙ্গে লাফাইয়া উঠিয়া মাধবীলতার নতুন শাড়িখানা আঁচড়াইয়া চিড়িয়া দিল। মাছের ঝোলের থালাটি মাটিতে পড়িয়া গেল, বিড়ালটির মতোই বিদ্যুৎগতিতে লাফ দিয়া পিছু হটিতে গিয়া মাধবীলতা ধপাস করিয়া মেঝেতে পড়িয়া গেল পা ছড়াইয়া বসিবার ভঙ্গিতে। গায়ে তার আঁচড় লাগে নাই, পড়িয়া গিয়াও বিশেষ ব্যথা লাগে নাই, কিন্তু চিৎকার শুনিয়া মনে হইল তাকে বুঝি বাঘে ধরিয়াছে।
কাঠের মোটা একটা পিঁড়ি কাছেই পড়িয়া ছিল, দুহাতে পিঁড়িটা তুলিয়া নিয়া এমন জোরেই। বিভূতি বিড়ালটিকে মারিয়া বসিল যে, মরিবার আগে একটা আওয়াজ করার সময়ও বেচারির জুটিল না।
সকলের আগে মহেশ চৌধুরীর মনে হইল তার পোমানা জীবটি আর কোনোদিন লেজ উঁচু করিয়া তার পায়ে গা ঘষিতে ঘষিতে ঘড় ঘড়, আওয়াজ করিবে না। তারপর অনেক কথাই তার মনে হইতে লাগিল।