তুমি একা এসেছ রতন?
আজ্ঞে হাঁ। ভাবলাম যে একবার–
দেখে আসি ওরা কি করছে? সদানন্দ হাসিল। রত্নাবলীর বিব্রত ভাব দেখিয়া আবার বলিল, বন্ধুর জন্য ভাবনা হচ্ছিল, চাবুক মারছি না গায়ে ছাকা দিচ্ছি ভেবে পাচ্ছিলে না, কেমন? আশ্রম ত্যাগ করার জন্য আমি কাউকে শাস্তি দিই না রতন! যার গলায় খুশি মালা দিয়ে তুমিও যেদিন ইচ্ছা আশ্রম ছেড়ে চলে যে, আমি কিছু বলব না।
সত্যমিথ্যায় জড়ানো কথা, না-চাওয়া কৈফিয়তের মতো। সদানন্দের ভাবটা যেন নতুন জামাইয়ের মতো, শালীর সঙ্গে ফাজলামি করিতেছে। রত্নাবলী কিছুই বুঝিতে পারে না, কারণ, বুঝিবার মতো কি যেন একটা জ্ঞান মনের অন্ধকার তলা হইতে উপরে উঠিতে উঠিতে চাকায় লাগা নোংরা কিছুর মতো পাক খাইয়া নিচে তলাইয়া যায়। সে চুপ করিয়া বসিয়া থাকে।
সকলে চুপ করিয়া থাকিলে চলিবে কেন? মাধবীলতা তাই বলে, এবার থেকে মাঝে মাঝে আশ্রমে আসব ভাই। ওঁকে প্রণাম করে যাব।
তারপর আবার তিনজনেই চুপ করিয়া থাকে, তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়। একটু পরেই বিপিন আসিয়া গম্ভীরমুখে খবর দেয় যে, চালার নিচে বসিয়া বসিয়া অনেকে চলিয়া যাইতেছে, অনেকে অপেক্ষা করিতেছে। সদানন্দ যদি না যায়, বিপিন তাদের খবরটা দিতে পারে।
চল যাচ্ছি। সদানন্দ যেন একটু ব্যস্ত হইয়াই চলিয়া গেল।
তারপর দুজনে চুপচাপ বসিয়া থাকে। অনেকক্ষণ। শেষে মাধবীলতাই বলে, এখানে বসে থেকে কি হবে, চল আমরাও যাই।
আশ্রমে থাকবে নাকি আজ?
থাকবার কি উপায় আছে ভাই? তোমার ঘরে বসে নিরিবিলি দুদণ্ড কথা বলিগে চল।
রত্নাবলীর মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন পাক খাইয়া বেড়াইতেছিল, সে খানিক খানিক জানে কিন্তু সব জানে না। সব তাকে জানানো হয় নাই বলিয়া অভিমানে প্রশ্নগুলি গলার কাছে আসিয়া আটকাইয়া যাইতেছিল। তবে জানার সাধটা জোরালো হইলে প্রায় সব মেয়েরাই খুখুক করিয়া একটু কাশির ধাক্কাতেই দারুণ অভিমানের বাধা ঠেলিয়া দিতে পারে। জিজ্ঞাসা তাই হয় আকস্মিক।
হঠাৎ এলে যে?
হঠাৎ এলাম? ও হঠাৎ কেন এলাম? এমনি এলাম আর কি।
এমনি এলে না তোমার মাথা এলে। ছি, ধিক্ তোকে। ঘরে যদি মন না বসে, ঘরের বৌ সাজতে গেলি কেন? কে তোর পায়ে ধরে সেধেছিল?
একজন সেধেছিল ভাই।
ফাঁকি দেওয়া হাসি। হাসির ভঙ্গির সঙ্গে হাল্কা কথা রতনকে রাগে যেন অন্ধকার দেখাইয়া দেয়। আশ্রমের মানুষ-দেবতার পূজার জন্য কোন গ্রামের কে যেন কি উপলক্ষে এক বোঝ নৈবেদ্য পাঠাইয়াছিল, আশ্রমের সকলেই ভাগ পাইয়াছে। ক্রুদ্ধ চোখে চাহিতে চাহিতে রত্নাবলী বন্ধুর জন্য একটা পাথরের থালায় ফলমূল আর মিষ্টান্ন সাজাইতে থাকে। সন্দেহটা মনের মধ্যে ধীরে ধীরে বিশ্বাসে দাঁড়াইয়া যাইতেছে। মনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ না জানিলেও মানুষের বড় বড় ভাব পরিবর্তনের মধ্যে মনের পরিবর্তন আবিষ্কার করা যায়। ভদ্ৰগৃহস্থের ছেলের সঙ্গে সামাজিক বিবাহের ফলে জীবনের সমস্ত তুচ্ছ খুঁটিনাটি যার কাছে এমন গুরুতর হইয়া উঠিয়াছিল যে, প্রায় মুচকি একটু হাসি পর্যন্ত অন্যায় মনে হইত, বন্ধুর এ রকম সাংঘাতিক জেরার সময় সে যদি এমন শয়তানি-ভরা ফাজলামি করিতে পারে, কিছু একটা ঘটিয়াছে বৈকি। হায়, মাঝখানে কিছুদিনের ছেদ পড়িয়া সদানন্দের সঙ্গে আবার কি মাধবীলতার আগের সম্পর্ক পাতানো হইয়া গেল?
খা।
তুইও বোস ভাই, দুজনে একসঙ্গে খাই?
এতক্ষণে, মাধবীলতা যখন এক টুকরো ফল মুখে তুলিতেছে, রত্নাবলীর নজর পড়িল, মাধবীলতার ডান হাতের কজির কাছটা লাল হইয়া ফুলিয়া উঠিয়াছে।
হাতটা প্রায় ভেঙে গেছে ভাই, গায়ে কি জোর মানুষটার!
চিবানো ফলের সঙ্গে টোক গিলিয়া রত্নাবলী ভালোমানুষের মতো জিজ্ঞাসা করে, কেন, এত জোরে হাত ধরল কেন?
মাধবীলতা হাসিয়া বলে, রাগের চোটে, আবার কেন।
তারপর?
তারপর আবার কি? আমি কটমট করে তাকাতে হাত ছেড়ে দিয়ে বকবকানি আরম্ভ করে দিল।
মাধবীলতা তৃপ্তির হাসি হাসে।
১৭. সত্য কথা বলতে
সত্য কথা বলতে কি, মাধবীলতা কটমট করিয়া তাকানোর অবসর বেশিক্ষণ পায় নাই। অবসর পাইলেও সে তাকানিতে বিশেষ কোনো কাজ হইত কিনা সন্দেহ। মূৰ্ছার উপক্রম হইলে যেমন হয়, মাথা সেই রকম বে বোঁ করিয়া পাক খাইতে আরম্ভ করায় সে চোখ বুজিয়া মূৰ্ছা গিয়াছিল। সদানন্দের চোখ মুখ দেখিয়া সে যেমন ভয় পাইয়াছিল, অন্ধকার রাত্রে হঠাৎ ভূত দেখিলে সে রকম ভয় পাইত কিনা সন্দেহ। তার মুখের সেই বীভৎস ভঙ্গি আর চোখের মারাত্মক দৃষ্টির মধ্যে পাশবিক কামনার একটু চিহ্ন খুঁজিয়া পাইলে মাধবীলতা হয়তো মূৰ্ছার চরম শিথিলতা আনিয়া সদানন্দের আলিঙ্গনে গা এলাইয়া দিত না, আলিঙ্গন আরেকটু জোরালো হইলেই সে দেহে কয়েকটা পাঁজর নির্ঘাত মড়মড় করিয়া ভাঙিয়া যাইত। মাধবীলতা নিঃসন্দেহে টের পাইয়াছিল, সদানন্দ তাকে খুন করিবে সঙ্গে সঙ্গেই হোক অথবা অকথ্য যন্ত্ৰণা দিবার পরেই হোক। খবরের কাগজে যে সব খুনের খবর বাহির হয়, সোজাসুজি সেই রকম অভদ্ৰ অমার্জিত হত্যা, উপন্যাসের পাষণ্ডেরা যে রকম রসালো খুন করে, সে রকম নয়।
মাধবীলতার ভয় পাওয়ার আরেকটা কারণ ছিল।
সদানন্দ তখন মহেশ চৌধুরীর বাড়িতে, তাকে নূতন আশ্রমে সরানোর আয়োজন চলিতেছে। একদিন হঠাৎ নির্জন বারান্দায় সদানন্দের সামনে পড়িয়া সে পাশ কাটাইয়া তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইতেছে, সদানন্দ ডাকয়া বলিয়াছিল, একটা কথা শোন মাধু।