মহেশ চৌধুরীকে তীব্রভাবে ঘৃণা করিয়া, দশজনের কাছে তাকে হীন প্রতিপন্ন করার সম্ভব অসম্ভব মতলব আঁটিয়া, আর নিজেকে তার চেয়ে ছোট মনে করার প্রতিক্রিয়ায় জর্জরিত হইয়া গিয়া, সদানন্দ আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। অন্তত তার তাই মনে হয়। ভয়টা যে এড়ানো যায়, রক্ত চলাচল শ্লথ করিয়া দেওয়ার মতো উত্তেজনাবিহীন সর্বগ্রাসী ভয়, তাও কি কম? মহেশ চৌধুরী অবশ্য ভয় এড়ানোর চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু এসব ব্যাপারের সে কি বোঝে, কি দাম আছে তার উপদেশের? সদানন্দকে উপদেশ দিতে আসে, স্পর্ধাও কম নয় লোকটার!
দিন কাটিয়া যায়। মহেশ চৌধুরী শান্ত চোখে সদানন্দের চালচলন আর ভাবভঙ্গি লক্ষ করে। মুখখানা যেন তার দিন দিন অল্পে অল্পে বিষণ্ণ ও গম্ভীর হইয়া উঠিতে থাকে।
একদিন মহেশ চৌধুরী বলে, প্ৰভু?
সদানন্দ একটা শব্দ করে, যেটা জবাব হিসাবে ধরা যায়, আবার অবজ্ঞা হিসাবেও ধরা যায়।
আর এগোতে পারছেন না প্রভু, না?
কিসের এগোতে পারছি না? কে বললে তোমাকে, এগোতে পারছি না?
মহেশ চৌধুরীর চোখ ছলছল করিতে থাকে, এগোতে না পারলে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন, পিছিয়ে আসছেন কেন প্রভু? এখন পিছু হটতে শুরু করলে কি আর উপায় আছে। প্রথমটা একটু ভালো লাগে, কিন্তু দুদিন পরে নিজের হাত-পা কামড়াতে ইচ্ছা হবে। এমন যন্ত্রণা পাবেন, এখন তা ভাবতেও পারবেন না।
তোমার উপদেশ বন্ধ কর তো মহেশ।
উপদেশ নয়, কথাটা মনে পড়িয়ে দিচ্ছি। নিজেই বুঝে দেখুন, কি বিপদ ঘটাচ্ছেন নিজের।
সম্পূৰ্ণ বুঝিতে না পারলেও সদানন্দ কিছু কিছু বুঝিতে পারে। মহেশ চৌধুরীর সম্মুখ হইতে ছুটিয়া পালানোর এরকম জোরালো ইচ্ছা আগে তার হইত না এবং মহেশ চৌধুরীর দিকে চোখ তুলিয়া চাহিবার কাজে এতটা শক্তিক্ষয়ও করিতে হইত না! নূতন একটা অনুভূতি আজকাল তার কাছে ধরা পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে, মানুষের জীবনের ব্যর্থতার অনুভূতি। অনুভূতিটা একেবারে নূতন, এ পর্যন্ত চাপা পড়া সঙ্কেতের মতো কোনোদিন অনুভব করে নাই। মানুষের জীবনের ব্যর্থতার কথা অবশ্য সে অনেক ভাবিয়াছে, মাঝে মাঝে গভীর বিষাদে হৃদয় ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিয়াছে, কিন্তু সে যেন ছিল অন্য জিনিস। রোগে শোকে একজন মানুষকে কষ্ট পাইতে দেখিলে সহানুভূতির মধ্যে যে বিষাদ জাগিত, সমস্ত মানুষের জীবনের মূল্যহীনতা জাগাইয়া তুলিত সেই বিষাদ। কিন্তু এখন সে যা অনুভব করে, সেটা যেন ঠিক বিষাদ নয়। মানুষের বাঁচিয়া থাকার কোনো অর্থ নাই, তার নিজের জীবনটা ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে, আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত লোক বাঁচিয়া ছিল, তাহাদের জীবনও ব্যর্থ এবং ভবিষ্যতে যত লোক পৃথিবীতে বাঁচিয়া থাকিবে, তাদের জীবনও ব্যর্থ–কিন্তু তাতে যেন কিছু আসিয়া যায় না। ব্যর্থতার চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর নাই, জীবনের প্রতিকারহীন জীবনব্যাপী ব্যর্থতা। অথচ তাও যেন সদানন্দের কাছে তুচ্ছ হইয়া গিয়াছে। নির্বিকার ভেতা একটা ক্ষোভ শুধু সে অনুভব করে। জ্বর আসিবার আগে শরীর ম্যাজম্যাজ করার মতো এটা কি ভয়ানক কিছুর সূচনা? মহেশ চৌধুরীর আলোচনা এই প্রশ্ন আর ভয় তার মধ্যে জাগাইয়া দেয়।
মহেশ চৌধুরীর ভক্তিশ্রদ্ধা ক্ৰমে ক্ৰমে যেন কমিয়া আসিতে থাকে। জোড় হাতে ছাড়া সদানন্দের সঙ্গে সে একরকম কথাই বলিত না, আজকাল হাত জোড় করিতে ভুলিয়া যায়। প্ৰভু শব্দটাও তার মুখে শোনা যায় কদাচিৎ। মহেশ চৌধুরীর ভক্তি শেষের দিকে সদানন্দকে বিশেষ কিছু তৃপ্তি দিত না, কিন্তু ভক্তির অভাব ঘটায় আজকাল তার ভয়ানক রাগ হয়।
সভায় কথা বলিতে বলিতে হঠাৎ থামিয়া গিয়া সে সকলের মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাহিয়া দ্যাখে। মহেশ চৌধুরীর মতো অন্য সকলের ভক্তিশ্রদ্ধাও কি কমিয়া গিয়াছে? এতকাল যাদের সে শিশু মনে করিয়া আসিয়াছে, মতামত নিয়া কোনোদিন মাথা ঘামায় নাই, আজকাল তাদের তাকানোর ভঙ্গিতে অনুকম্পা আর অবজ্ঞা আবিষ্কার করিয়া বুকের মধ্যে হঠাৎ তার ধড়াস করিয়া ওঠে। কি করিয়াছে সে? কার কাছে কি অপরাধ করিয়াছে? কার সঙ্গে কিসের বাধ্যবাধকতায় সে আটক পড়িয়া গিয়াছে? দেহবাদী এইসব অপদাৰ্থ মানুষ কেন তাকে সর্বদা ইঙ্গিত করিতেছে, আমরা কাপুরুষ, কিন্তু হে মহাপুরুষ, তোমার চেয়ে কত সুখেই আমরা বাঁচিয়া আছি।
নিছক ভাবপ্রবণতা? যে জিনিসটা চিরদিন সে এড়াইবার চেষ্টা করিয়াছে? বুঝিয়াও সদানন্দ যেন বুঝিতে পারে না। কোটা মনের দুর্বলতা জানিবার পরেও সেটাকে দমন করা যে এমন কঠিন ব্যাপার, এতকাল তার জানা ছিল না। আগে ঘরের কোণে নিজের ছেলেমানুষির কথা ভাবিয়া তার হাসি পাইত, এমন তুচ্ছ একটা বিষয়কে এত বড় করিয়া তুলিয়াছে কেন ভাবিয়া অবাক হইয়া যাইত আজকাল ছেলেমানুষিকে প্রশ্রয় দেওয়ার দুর্ভাবনায় মাথা যেন তার ফাটিয়া যাওয়ার উপক্রম করে। হাত-পা নাড়ায় বাধা দিলে শিশু যেমন ক্ষেপিয়া যায়, ছেলেমানুষিকে উড়াইয়া দিবার। চেষ্টায় ব্যর্থ হইয়া সদানন্দের সেইরকম উন্মাদের মতো আর্তনাদ করিতে ইচ্ছা যায়।
একবার বিপিন আসিয়া বলে, তোর চেহারাটা বড় খারাপ হয়ে গেছে সদা।
সদানন্দ রাগিয়া বলে, গেছে তো গেছে, তোর কি?
বিপিন উদাসভাবে বলে, আমার আবার কি! তুই মরলেই বা আমার কি?
ফিরে যাওয়ার সময় মহেশ চৌধুরীর সঙ্গে বিপিনের দেখা হয়। বিপিন হাসিয়া বলে, সাধুজীকে খেতে দেন না নাকি? মুখের চামড়া যে কুঁচকে যেতে আরম্ভ করেছে মশায়?