একবার কেবল সদানন্দের মনে হইয়াছিল, এই কি প্ৰেম, প্রিয়কে হারানোর পর প্রেম যা হয়, আসল খুঁটি প্রেম? মাধবীলতাকে হারানোর পর হইতেই তো তার মধ্যে এরকম হইতেছে? কিন্তু নিজের কাছে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করিয়া ব্যাকুলতা এত সহজে মিটাইয়া দেওয়া সম্ভব হয় নাই। অজানা ও দুর্বোধ্য স্মৃতি হোক, উপলব্ধি হোক, ক্ষয়িতমূল আত্মবিকাশের বিচ্ছিন্ন অংশ হোক, অথবা আর যাই হোক, স্পষ্টতর হওয়ার যে প্রক্রিয়া চলিতে থাকে, তার সঙ্গে মাধবীলতার কোনো সম্পর্ক নাই। মাধবীলতা সম্বন্ধে মানসিক দুর্বলতা ঘটিবার একটা আশঙ্কা মনে আসিয়াছিল, সেই আশঙ্কাটার জন্যই এ ধরনের কথা সদানন্দের মনে আছে।
এক সময় হঠাৎ দরজা বন্ধ করিয়া সদানন্দ ঘরের কোণে মাটিতে বসিয়া পড়ে, আসন থাকিলেও মনে থাকে না। মেরুদণ্ড সিধা করিয়া বসে, চোখ বন্ধ করে, হাত জোড় করে ইচ্ছায়ও নয়, অনিচ্ছায়ও নয়। বিড়বিড় করিয়া বলিতে থাকে হে ঈশ্বর দয়া কর। ঈশ্বর বলে যদি কেউ থাক, এ সময় আমায় দয়া কর। তুমি তো জান আমি স্বীকার করি না তুমি আছ, তবু যদি থাক, দয়া কর। তুমি তো সব জান–তুমি তো জান কি উদ্দেশ্যে আমি এখন মেনে নিচ্ছি যে তোমায় আমি স্বীকার করি না–তোমায় স্বীকার করি না মেনে নেওয়ার উদ্দেশ্যটা কেন মেনে নিচ্ছি তাও তো তুমি জান–কথা জড়াইয়া সদানন্দের কথা বন্ধ হইয়া যায়। মাথাটা প্ৰণাম করার ভঙ্গিতে মাটিতে ঠেকাইয়া সে চুপ করিয়া পড়িয়া থাকে।
এমনিভাবে ভাবোঞ্ছাসের নেশায় সদানন্দ অন্যমনস্কও হয়, নিজেকে শ্ৰান্ত ও শান্ত করিয়া ঘুমও পাড়ায়।
আশ্রমের বড় চালাটার পাশে সদানন্দের জন্য একখানা নূতন ঘর তোলা হয়। সদানন্দ হাসিয়া বলে, বাড়িতে রাখতে ভরসা হচ্ছে না মহেশ।
মহেশ আহত হইয়া বলে, প্ৰভু?
আহা, এত সহজে ঘা খাও কেন বল তো মহেশ? তামাশা বোঝ না?
স্তব্ধ হইয়া খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া মহেশ হঠাৎ বলে, না প্ৰভু, আমি সত্যই বড় অপদার্থ। আপনি যা বললেন, ওই জন্যই আপনাকে সরিয়ে দিচ্ছি।
মহেশ চৌধুরীর মুখে কথাটা এমন খাপছাড়া শোনায়, বলিবার নয়। অন্তঃপুরে তাকে স্থান দিতে সাহস না হওয়াও মহেশের পক্ষে যেমন আশ্চর্য, তার সামনে এ ভাবে স্বীকার করার সাহস হওয়াও তার চেয়ে কম আশ্চর্য নয়। এই মহেশ চৌধুরীই না হাতুড়ি দিয়া নিজের মুখে আঘাত করিয়াছিল, মাধবীলতাকে অপমান করার জন্য সদানন্দের উপর ছেলের রাগ হওয়ার প্রায়শ্চিত্ত বাবদে?
আমায় তুমি আর বিশ্বাস কর না, না মহেশ।
বিশ্বাস করি বৈকি প্ৰভু, আপনি তো দেবতা। তবে সাধনার যে স্তরে আপনি পৌঁছেছেন, এখন আর আপনাকে ঘর-গেরস্থালির মধ্যে রাখতে ভরসা হয় না। আপনার জন্যে সারাদিন আমার বুকের মধ্যে কাপে প্রভু। আমি এ অবস্থাটা পার হতে পারি নি প্রভু, তবে আমি তো অপদার্থ বাজে লোক, আমার সঙ্গে আপনার তুলনাই হয় না–আপনি পারবেন। আপনি নিশ্চয় পার হয়ে যাবেন।
সদানন্দ ভূ কুঁচকাইয়া মহেশ চৌধুরীর মুখের দিকে চাহিয়া থাকে, বুঝিয়াও যেন বুঝিয়া উঠিতে পারে না মানুষটাকে, দ্বিধা সন্দেহ ভয় শ্রদ্ধা মমতা প্রভৃতি কত বিভিন্ন মনোভাব যে পলকে উদয় হয়, তার হিসাব থাকে না। যা বলিল মহেশ চৌধুরী তাই কি তবে ঠিক? মিথ্যা কথা তো মহেশ বলে না। কেমন করিয়া লোকটি সম্বন্ধে এই ধারণাটা তার নিজের মনেই বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছিল, নিজেই সদানন্দ তা জানিতে পারে নাই, কিন্তু ক্ষণিকের মধ্যে এই ধারণাটি আর সব মনোভাবকে যখন চাপা দিয়া মাথাচাড়া দিয়া ওঠে, তখন সদানন্দ এক অদ্ভুত কাজ করিয়া বসে। হঠাৎ মহেশের পায়ের উপর হুমড়ি খাইয়া পড়িয়া প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলে, মহেশ, আমায় তুমি রক্ষা কর-বাঁচাও আমায়।
তিন সন্ধ্যা পরম ভক্তিভরে যার পায়ের ধূলা মাথায় ঠেকায়, তাকে এই ভাবে পায়ে পড়িতে দেখিয়া মহেশ চৌধুরীর মূৰ্ছা যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু মানুষটা সে সত্যই খাপছাড়া। আরো কত তুচ্ছ কারণে কতবার যে ব্যাকুল হইয়াছে, কিন্তু এখন ব্যাকুলতার বদলে আত্মপ্রতিষ্ঠাই যেন তার বাড়িয়া যায়। সহজভাবেই সে বলে, প্রভু, এ রকম করবেন না। এই জন্যই তো গেরস্থালির ভেতর থেকে আপনাকে সরিয়ে দিচ্ছি। আপনাকে রক্ষা করার ক্ষমতা কি আমার আছে প্ৰভু? নিজেকে আপনার নিজেরই রক্ষা করতে হবে ভেবে দেখুন, নিজেকে আপনার নিজেরই রক্ষা করতে হবে।
তারপর সদানন্দ উঠিয়া বাগানে চলিয়া যায়, লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ সদানন্দ। গেরস্থালি! কতবার মহেশ কথাটা উচ্চারণ করিয়াছে। মানুষটা কি কম চালাক মহেশ, কম ফন্দিবাজ! মেয়েমানুষ নয়, গেরস্থালি! গেরস্থালির মধ্যে সদানন্দকে আর রাখিতে ভরসা হইতেছে না, তাই মহেশ তাকে সরাইয়া দিতেছে! বাগান হইতে সদানন্দ মাঠে যায়, সেখানে নেংটি পরা কে যেন একটা মানুষ একটা বাধা গরুকে প্রাণপণে মারিতেছিল। দেখিয়াই প্ৰাণপণে ছুটিতে ছুটিতে কাছে গিয়া সদানন্দ লাঠিটা ছিনাইয়া লইয়া লোকটাকে এক ঘা বসাইয়া দেয়। এমন করে মারছিস, লাগে না। গরুটার? তারপর লাঠিটা ফেলিয়া দিয়া লোকটার যেখানে মারিয়াছিল সেখানে হাত বুলাইয়া দিতে দিতে বলে, আহা তোমার লেগেছে বাবা? তারও পরে লোকটিকে সঙ্গে করিয়া আশ্রমে ফিরিয়া আসিয়া মহেশকে বলে, একে একটা টাকা দিয়ে দাও তো মহেশ।
গরিব-চাষাভূষা মানুষ সাধু-সন্ন্যাসী দেখিয়াই ভড়কাইয়া যায়। তার উপর, সাধুটি কে, তাও তার অজানা ছিল না। থতমত খাইয়াই ছিল, এতক্ষণে বলিল, মোটে একটা, আজ্ঞে?