অথবা আগেই কথাটা সকলে আলোচনা করিয়াছিল, সে-ই কিছু জানে না? তাকে না জানাইয়াই সকলে তলে তলে বিভূতির সঙ্গে তার বিবাহ ঠিক করিয়া ফেলিয়াছে? কিন্তু তাও কি সম্ভব।
কি হইবে এবার? মহেশ চৌধুরী তো যা মুখে আসিল বলিয়াই খালাস, ফলটা দাঁড়াইবে কি? সদানন্দ কি করিবে? কি করিবে সদানন্দ সদানন্দের সেদিনকার সেই কথাটাই ঘুরিয়া ফিরিয়া মাধবীলতার মনে ভাসিয়া আসিতে থাকে, আমাকে মহাপুরুষ না ভেবে তো তোমার উপায় নাই, তোমাকে যে তাহলে দ্বিচারিণী হতে হবে!।
সদানন্দের ভয়টাই মাধবীলতার মনে সবচেয়ে বড় হইয়া দেখা দেয়। বিভূতিকে বিবাহ করার কথাটা সে কখনো ভাবে নাই, এ রকম একটা সম্ভাবনার কথা তার কল্পনাতেও আসে নাই। আজ এ বিষয়ে মাথা ঘামানোই তার পক্ষে উচিত ও স্বাভাবিক ছিল সব চেয়ে বেশি, কিন্তু কথাটা যে বিবেচনা করা দরকার, নিজের মনে তারও যে এ বিষয়ে একটা মীমাংসা করিয়া ফেলিতে হইবে আজকালের মধ্যে, এটা যেন তার খেয়ালও হইল না। বিভূতির জীবনসঙ্গিনী হইতে সে রাজি আছে। কি নাই, নিজেই সে তা এখনো জানে না। তবু সদানন্দ কি ভাবিবে, সদানন্দ কি বলিবে, সদানন্দ কি করিবে, কল্পনা করিয়া সর্বাঙ্গে যেন রীতিমতো অপরাধমূলক ভয়ের ঢিপটিপানি অনুভব করিতে থাকে।
নিজের ঘরে বিছানায় শুইয়া মাধবীলতা ভাবিতেছিল, কে যেন পাশে আসিয়া বসিল সন্তৰ্পণে, চোরের মতো। মুখ ফিরাইয়া মাধবীলতা দেখিল শশধরের বৌ ঘোমটা কমাইয়া দিয়াছে, তবু কপাল প্রায় সবখানিই ঢাকা।
দিদি?
আজ সে প্রথম ঘোমটা কমাইয়া মাধবীলতার সঙ্গে কথা কহিল, এতদিন কয়েকবার চেষ্টা করিয়াও মাধবীলতা তাকে কথা বলাইতে পারে নাই। হাত দেখিয়াই বোঝা যায় বৌটির রং খুব সুন্দর, মুখের রং আরো টুকটুকে।
ঠাকুরপোর সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে দিদি?
এমন সুন্দর মুখের এত আনন্দের কথা কি যে বিশ্রী শুনাইল, বলিবার নয়। বৌটি ফোক্লা!
সদানন্দ বলে, তবে কি তুমি বলতে চাও, ওদের মধ্যে কোনো কথাই হয় নি, বিভূতি আর মাধুর মধ্যে?
মহেশ বলে, আজ্ঞে না। তবে দুজনে বেশ ভাব হয়েছে সেটা তো বোঝাই যায়।
সদানন্দ বলে, ভাব তো আর প্রণয় নয় মহেশ। দুজনে সর্বদা মেলামেশা করছে, এদের ভাব হওয়াটা আশ্চর্য কি। কিন্তু বিয়ে হল আলাদা ব্যাপার। সকলের সামনে কথাটা বলার আগে ওদের একবার জিজ্ঞাসা করা তো তোমার উচিত ছিল? আমার সঙ্গেও তো পরামর্শ করতে পারতে একবার?
সময় পেলাম না যে প্ৰভু? আপনার নামে অমন একটা কুৎসিত কথা রটেছে শুনে মনে হল, বিয়ে যখন এদের হবেই, আর দেরি না করে মেয়েটিকে কথাটা জানিয়ে দেওয়াই ভালো। মাধুর সম্পর্কে আপনার নামে আর কোনো কথাই তাহলে উঠতে পাবে না।
বিয়ে যখন ওদের হবেই মানে?
আজ্ঞে আপনার আশীর্বাদে বিয়েটা ওদের নির্বিঘ্নে হয়ে যাবে প্ৰভু। ছেলেটার মাথাও একটু ঠাণ্ডা হবে, মেয়েটাও সুখী হবে।
শুনিলে মনে হয় না, বিভূতি আর মাধবীলতার বিবাহ যে হইবেই, সে বিষয়ে মহেশ চৌধুরীর কিছুমাত্র সন্দেহ আছে। কারো মত জিজ্ঞাসা করা হয় নাই, কারো সঙ্গে পরামর্শ করা হয় নাই, যাদের বিবাহ দুঘণ্টা আগেও তাদের ইঙ্গিতেও ব্যাপারটা জানানো হয় নাই, তবু যেন মহেশ চৌধুরী জানে, এ বিবাহ হইয়া যাইবে। রাগে সদানন্দের গা যেন জ্বলিয়া যায়। একটু ভয়ও হয়। মহেশ চৌধুরীর একগুঁয়েমির কিছু কিছু পরিচয় সে পাইয়াছে।
জান মহেশ, তোমার ব্যাপার ভালো বুঝতে পারছি না। বিভূতির একটা বিয়ে দিতে চাও, ভালো কথা। কিন্তু মাধুর সঙ্গে বিয়ে হবে কি করে? মাধু আশ্রমে এসেছে, সংসার ওর ভালো লাগে। নি বলে, সেবা আর আধ্যাত্মিক সাধনা নিয়ে ওর জীবনটা কাটিয়ে দেবার ইচ্ছা। আমি ওকে দীক্ষা দেব, নিজে ওকে সাধনপথে চালিয়ে নিয়ে যাব। ওর বিয়ের প্রশ্নই তো উঠতে পারে না।
প্রভু?
তুমি বুঝতে পার না মহেশ, ও মেয়েটির মধ্যে খাঁটি জিনিস আছে? আমি কি সাধে ওকে। বেছে নিয়েছি! একদিন ও অনেক উঁচুতে উঠে যাবে, হাজার হাজার মানুষের জীবনে একদিন ও সুখশান্তি এনে দেবে। এমন একটা খাঁটি জিনিস নষ্ট হতে দেওয়া যায়!
প্রভু?
বল না, কি বলতে চাও? আলোচনা করবার জন্যই তো ডেকেছি তোমায়!
বিয়ে না হলে মেয়েটির মন শান্ত হবে না, প্রভু। বিয়ের জন্য মেয়েটি ছটফট করছে।
সদানন্দ ব্যঙ্গ করিয়া বলে, তোমায় বলেছে নাকি, তাড়াতাড়ি আমার বিয়ে দিয়ে দিন, বিয়ের জন্য আমি ছটফট করছি মহেশবাবু?
মহেশ হাত জোড় করিয়া বলে, আপনার তো অজানা কিছু নেই প্রভু! কেন মনে কষ্ট দিচ্ছেন। আমার কোনো মেয়ে অমন করে বলেও না, পারেও না। কিন্তু মেয়েমানুষের মন কি বোঝা যায় না? রাজাসায়েবের ছেলে তো ওকে বিয়ের লোভ দেখিয়ে বার করে এনেছিল!
ছেলেমানুষ হঠাৎ একদিন মনের ভুলে কি করেছিল–
আজ্ঞে হ্যাঁ, আমিও তো তাই বলি। নইলে নিজের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইতাম? বিয়ে। করে সংসারী হবার ইচ্ছা মেয়েটির মনে প্রবল।
কিন্তু মহেশ–
আজ্ঞে হ্যাঁ। বিয়েটা হয়ে যাক, দুজনকেই আপনি দীক্ষা দিয়ে পায়ের তলে আশ্রয় দেবেন। যেমন চান তেমনি করে গড়ে তুলবেন দুজনকে। আপনার কাজে দুজনে জীবন উৎসর্গ করবে। ওরা তো আপনারই সন্তান প্রভু?
সদানন্দের মনে হয়, মহেশ যেন তাকে ভক্তিমাখা চাবুক মারিয়াছে।
১২. বিভূতি সত্যই বড় ছেলেমানুষ
এ বিষয়ে বিভূতি সত্যই বড় ছেলেমানুষ বিবাহ করার বিষয়ে। এতটুকু অভিজ্ঞতা নাই। মেয়েদের সম্বন্ধে কোনোদিন সে যে মাথা ঘামায় নাই তা নয়, তবে সেটা খুবই কম। অস্পষ্ট একটা ধারণা তার মনে আছে যে, দেখিলেই ভালো লাগে এমন চেহারার আর মিশিলেই মিষ্টি লাগে এমন স্বভাবের একটি চালাকচতুর চটপটে মেয়ের সঙ্গে একদিন প্রেম তার হইবেই, ব্যস্, তারপরেই মালাবদল। কিন্তু মাধবীলতা কি তার কল্পনার সেই মেয়ে? দুদিন ভাবিয়া বাপকে একটা জবাব দিবে বলিয়াছিল, সাতদিন ভাবিয়াও কিছু ঠিক করিতে পারি না। তারপর মনে হইল, মাধবীলতার সঙ্গে পরামর্শ করিলে দোষ কি?