রত্নাবলীর কথার জবাবে মহেশ চৌধুরী বলিল, তুমি তো আমার মেয়ে, মা? এখানে থাকতে পাব কিনা তাতে তো তোমার সন্দেহ থাকা উচিত নয় মা!
রত্নাবলী এবার হাসিল না।–না না, এমনি কথাটা বলছিলাম মাধুকে তামাশা করে। থাকতে পাব বৈকি এখানে।
তুমি এখানে এসে থাকলে আমরা বড় সুখী হব মা।
আমি তো যখন খুশি আসতে পারি, কেবল উমা-মাসির জন্যে, রত্নাবলী একটু হাসিল।
মহেশ বলিল, প্রভু যখন এখানে আছেন, ওঁকে বললে উনি এসে এখানে থাকতে রাজি হবেন। না?
মনে তো হয় না। উনি বড় চটেছেন।
রত্নাবলী আসিয়া সদানন্দকে প্রণাম করে নাই। সদানন্দ এতক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়াছিল, এবার জিজ্ঞাসা করিল, উমা চটেছে কেন?
আজ্ঞে, আপনি সন্ন্যাস ছেড়ে দিলেন বলে।
সন্ন্যাস ছেড়ে দিলাম? সন্ন্যাস ছেড়ে দিলাম মানে?
সন্ন্যাস ছেড়ে দিয়ে চলে আসেন নি আপনি?
বিপিন বলেছে বুঝি?
রত্নাবলী ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল, বলিল, তাছাড়া, সন্ন্যাস না ছাড়লে গেরস্তের বাড়ি তিন রাত্রির বেশি বাস করছেন কি করে।
সদানন্দের তীব্র দৃষ্টিপাতে রত্নাবলী মথা হেঁট করে, সকলে স্তব্ধ হইয়া থাকে। মহেশ চোখ বুজিয়া হাঁটুতে হাত বুলায়। মাধবীলতা চাহিয়া দেখিতে থাকে সকলের মুখের দিকে।
হঠাৎ সদানন্দ বলিল, তাই বুঝি তুমি আজ আমার প্রণাম করলে না?
রত্নাবলী মাথা হেঁট করিয়া রাখিয়াই বলিল, আজ্ঞে না। আমার আজ কাউকে প্রণাম করতে নেই।
ওঃ! বলিয়া সদানন্দ অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। আর কি বলেছে বিপিন আমার নামে?
মহেশ চৌধুরী হাত জোড় করিয়া বলিল, প্ৰভু?
সদানন্দ অধীর হইয়া বলিল, না মহেশ, আমায় শুনতে দাও। বল রতন, বল আর কি বলেছে বিপিন?
রত্নাবলী বলিল, আমি আর কি বলব, ও তো সবাই জানে।
তবু তুমিই বল না শুনি।
রত্নাবলী মুখ তুলিয়া সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি জানেন না কিছু?
সদানন্দ বলিল, না। কি জানি না?
তবে তো সত্যি নয়! খুব সম্ভব রত্নাবলীর বিস্ময় আরো বাড়িয়া যায়, কিন্তু সেটা মুখে ভালো করিয়া ধরা পড়ে না, হাসি ছাড়া আর কিছুই রত্নাবলীর মুখে ভালো করিয়া পরিস্ফুট হয়। না।–ওমা, আমি তো সত্যি কিনা জানতেই ছুটে এলাম! সত্যি নয় তবে! কি কাণ্ড মা, এ্যা! এমন করেও বলতে পারেন বিপিনবাবু!
কি ছ্যাবলামি করছ রতন? কি সত্যি নয়? কি বলেছে বিপিন?
সদানন্দের ধমকে রত্নাবলী মুষড়িয়া গেল, আমতা আমতা করিয়া বলিল, আর আমি তা উচ্চারণ করতে পারব না! সত্যি যখন নয় ছি ছি…
কিন্তু আর কি এখন উচ্চারণ না করিলে চলে? কদিন ধরিয়া আশ্রম আর বিপিনের কথা ভাবিতে ভাবিতে সদানন্দের মাথা গরম হইয়া গিয়াছে, তার উপর রত্নাবলীর এতক্ষণের ভণিতা! সদানন্দ সিধা হইয়া বসিয়া ডাকে, রতন!–আর সে ডাক শুনিয়া ঘরের সকলের বুক কাঁপিয়া ওঠে।
আমার দিকে মুখ করে বোসো।
রত্নাবলী সদানন্দের দিকে মুখ করিয়া বসে।
চোখের দিকে তাকাও আমার।
রত্নাবলী সদানন্দের চোখের দিকে তাকায়।
এইবার বল।
রত্নাবলী বলে, তবে বলার আগে চোখ নামাইয়া নেয়। প্রথমে আশ্রমে রটিয়াছিল সদানন্দ। সন্ন্যাস ত্যাগ করিয়াছে। তারপর কয়েকদিন আগে রটিয়াছে, সদানন্দ নাকি মাধবীলতাকে বিবাহ করিয়া সংসারী হইবে। সন্ন্যাস ত্যাগ করার উদ্দেশ্যও তাই। খবরগুলি অবশ্য রত্নবালী সোজাসুজি বিপিনের কাছে শোনে নাই। তবে আশ্রমে বিপিন ছাড়া এসব খবর আর কে ছড়াইবে?
আশ্রমের কেউ আসে নাই কেন? বিপিন একদিন আশ্রমের সকলকে একত্র করিয়া বলিয়া দিয়াছে, যে কারণেই হোক, সদানন্দ যখন কারো কাছে বিদায় না নিয়া আশ্রম ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সঙ্গে দেখা করিতে যাওয়া উচিত হইবে না। যতই হোক, এতদিন তো সদানন্দ তাদের শ্রদ্ধেয় গুরুদেব ছিলেন। যুক্তিটার জন্য যত না থোক, বিপিনের হুকুমের বিরুদ্ধে কেউ আসিতে সাহস পায় নাই। বিপিন এই রকম ভাবেই হুকুম দেয়। তাছাড়া, মনেও সকলের প্রচণ্ড আঘাত লাগিয়াছে। কয়েকজন খুব কাঁদিয়াছে।
সদানন্দ সিধা হইয়াই বসিয়া থাকে কিন্তু নিজেকে তার বড়ই দুর্বল অসহায় মনে হইতে থাকে। সে ছাড়া এ জগতে আর সকলেই কি অবস্থা বুঝিয়া হিসাব করিয়া নিজেকে বাঁচাইয়া নিজের কাজ হাসিল করিয়া চলিতে পারে, সে-ই কেবল সব সময় ঠকিয়া যায়, না পারে গুছাইয়া কোনো একটা কাজ করিতে, না পারে নিজেকে বিপদের হাত হইতে বাঁচাইয়া চলিতেঃ বিপিন যখন ওদিকে তার নামে নানা কথা রটাইয়া আটঘাট বাঁধিয়া নিতেছে, সে তখন ভাবিতেছে কখন বিপিন আসিবে হাতে-পায়ে ধরিয়া তাকে ফিরাইয়া নিতে অনুতপ্ত, লাঞ্ছিত বিপিন। বিপিন যে বলিয়াছিল বাস্তব জগতে তার কোনো দাম নাই, কথাটা তো মিথ্যা নয়। কত হিসাব করিয়া বিপিন কাজ করে, প্রত্যেকটি সুযোগ সুবিধা কিভাবে কাজে লাগায়, সে শুধু বসিয়া বসিয়া আকাশপাতাল ভাবে। গৃহস্থের বাড়ি তিনরাত্রির বেশি বাস করা যে সন্ন্যাসত্যাগের কত বড় একটা প্রমাণ সাধারণ মানুষের কাছে, আর এক্ষেত্রে সন্ন্যাসত্যাগের কারণ হিসাবে মাধবীলতাকে বিবাহ করিয়া সংসারী। হওয়ার উদ্দেশ্য যে কত জোরালো সমর্থক যুক্তি, কিছুই বিপিনের ভাবিতে বাকি থাকে নাই। আর এখানে আসিবার পরে তার শুধু একবার খেয়াল হইয়াছিল মাত্র যে, মাধবীলতার সঙ্গে তার নাম জড়াইয়া বিপিন কুৎসা রটনার সুযোগ পাইবে।
এখন সদানন্দ বুঝিতে পারে, এর চেয়ে কুৎসা রটানো ঢের ভালো ছিল। কারো কারো মনে একটু খটকা লাগিত মাত্ৰ। মহেশ চৌধুরীর এ বাড়িতে আজ কত যুগ ধরিয়া একটি পারিবারিক জীবনের ধারা বহিতেছে, বাড়িতে গৃহিণী আছে, একটি বৌ আছে, মেয়েরা মাঝে মাঝে আসা-যাওয়া করে, এখানে মাধবীলতা আর সাধু সদানন্দের বাস করাটাই তো নিন্দনীয় হইতে পারে না। মাধবীলতার পিছনে পিছনে সদানন্দও মহেশ চৌধুরীর বাড়িতে আসিয়া হাজির হইয়াছে, কুৎসার স্বপক্ষে শুধু এই যুক্তি। কিন্তু ও যুক্তি বাতিল হইয়া যাইত দুদিনে, সদানন্দ যখন ঘোষণা করিয়া দিত আশ্রম সে ত্যাগ করিয়া আসিয়াছে অনাচার ও ব্যভিচারে ভরা বিপিনের টাকা রোজগারের উপায় সে আশ্রম। কিন্তু বিপিন তার নিন্দা করে নাই, তার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে। নাই, কেবল এত বড় সাধু সদানন্দ তার সন্ন্যাস ত্যাগ করিয়া সংসারী হওয়ার ইচ্ছার জন্য বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়াছে। এ গুজবও মিথ্যা প্রমাণিত হইয়া যাইবে, কিন্তু লোকের মনে একটা ছাপ থাকিয়াই যাইবে। কত কথাই মনে হইবে লোকের। কেউ ভাবিবে, কোনো কারণে বিবাহ ভাঙিয়া গেল। কেউ ভাবিবে, বিবাহটা বোধহয় দরকার হইল না, বিবাহ ছাড়াই