মাধবীলতা আর সে মাধবীলতা নাই। সদানন্দের কাছে সব রকম চাপল্য হারাইয়া আর সে। জড়োসড়ো হইয়া যায় না, ভয়ে ভয়ে হিসাব করিয়া কথা বলে না, অনায়াসে ব্যঙ্গ করে। মাধবীলতার সঙ্গে সদানন্দের ব্যবহারও অবশ্য বদলাইয়া গিয়াছে। বাহিরের সকল ভক্তের সঙ্গে আলাপ করার অভ্যস্ত ভঙ্গিতেই প্রথম প্রথম সে মাধবীলতার সঙ্গে আলাপ করিত, মাঝে মাঝে সব গোলমাল হইয়া যাইত বটে, কিন্তু তাও যেন ছিল ছেলেমানুষি ভাবপ্রবণতার আবরণে মানবীকে দেবতার প্রশ্রয় দেওয়া, দেবতার বাড়াবাড়ি অন্তরঙ্গতার জবাবেও যাতে মাথা তুলিবার সাহস মানবীর হয় না। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে মাধবীলতার সঙ্গে আলাপ করাটা তার নামিয়া গিয়াছে বিপিনের সঙ্গে আলাপ করার স্তরে।
মাধবীর আগের মন্তব্যে সদানন্দ রাগ করিয়াছিল, এবারকার ব্যঙ্গে হাসিয়া বলে, তোমার কাছে তাই বটে। আমাকে মহাপুরুষ না ভেবে তো তোমার উপায় নেই।
কেন?
তোমাকে যে তাহলে দ্বিচারিণী হতে হবে।
মুখ মাধবীর লাল হয় না, বিবর্ণ হইয়া যায়। ধীরে ধীরে উঠিয়া সে বাহিরে চলিয়া যায়।
সদানন্দ নিচু গলায় ব্যথভাবে বলে, রাগ করলে মাধু? মোন, শুনে যাও—
কিন্তু মাধবীলতা আজকাল বড়ই অবাধ্য হইয়াছে, কোনো কথাই শুনিতে চায় না।
সদানন্দ যতই আশা করুক, বিপিন তো আসেই না, আশ্রম হইতে কোনো শিষ্যও আসে না। সদানন্দ কারো কাছে কিছু বলিয়া আসে নাই, আশ্রমের শিষ্যদের কিছু জানাইবার কথা ভাবিতেও তার সঙ্কোচ হইতেছিল। বিপিন তাদের কি বুঝাইয়াছে, সেই জানে। হয়তো আশ্রমের কেউ এখনো জানিতেই পারে নাই, সদানন্দ চিরদিনের জন্য চলিয়া গিয়াছে অথবা সদানন্দ বাগবাদায় মহেশ চৌধুরীর বাড়িতে গিয়া উঠিয়াছে। হয়তো বিপিন তাদের বুঝাইয়াছে, সদানন্দ বিশেষ কারণে কিছুদিন মহেশ চৌধুরীর বাড়িতে বাস করিতে গিয়াছে, তাকে গিয়া কারো দৰ্শন করা বারণ। বিশেষ কারণটাও হয়তো বিপিন সকলকে ইঙ্গিতে জানাইয়া দিয়াছে। মাধবীলতার আকর্ষণ।
মহেশ চৌধুরীর বাড়িতে আসিয়া উঠিলে বিপিন যে এমন একটা ইঙ্গিত করার সুযোগ পাইবে, এখানে আসিবার আগে সদানন্দের সেটা খেয়াল হয় নাই। যাই হোক, এখন নানাভাবে ঘুরাইয়া ফিরাইয়া কথাটা সে ভাবে। মাধবীলতা এখানে আসিবার কয়েকদিন পরে সেও আসিয়া হাজির হইয়াছে, মাধবীলতার সঙ্গে তার নাম জড়াইয়া কলঙ্ক রটানোর পক্ষে এ একটা জোরালো যুক্তিই বটে। ভাবিতে ভাবিতে মাথা গরম হইয়া উঠিলে এই বলিয়া সদানন্দ নিজেকে সান্ত্বনা দেয় যে, বিপিন কি বলিয়াছে কি বলে নাই না জানিয়া নিজের মনের অনুমান নিয়া বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ হয় না। হয়তো ক্ষতিকর কিছুই বিপিন বলে নাই, সদানন্দের অন্তর্ধানের একটা সাধারণ ও সঙ্গত কারণই সকলকে জানাইয়াছে। আর যদি সত্য সত্যই তাকে ফিরাইয়া নিয়া যাওয়ার ইচ্ছা বিপিনের জাগিয়া থাকে, তবে হয়তো সেই সঙ্গে এ কথাও সকলকে জানাইয়া দিয়াছে যে, কয়েকদিন পরেই সাধুজী আশ্রমে প্রত্যাবর্তন করিবেন।
আশ্রমের কেউ না আসুক, আশপাশের গ্রামের নরনারী দলে দলে সদানন্দকে দর্শন ও প্ৰণাম করিতে আসে। প্রথমে ঝোঁকের মাথায় সদানন্দ এখানে সকলের কাছে নিজের আশ্ৰমত্যাগের ভিতরের ব্যাপারটা ঘোষণা করিয়া ফেলিয়াছিল, তারপর ভাবিয়া চিন্তিয়া মহেশ চৌধুরীকে বলিয়া দিয়াছে, কথাটা কয়েকদিন যেন বাহিরে প্রকাশ না পায়।
এখন সকলকে জানিও, আমি এমনি কয়েকদিন তোমার এখানে থাকতে এসেছি।
প্ৰভু?
সদানন্দ বুঝিতে পারিয়াছে।
না, মিথ্যে কথা তোমায় বলতে বলি নি মহেশ। তোমরা যে জান আমি কেন আশ্রম ছেড়ে এসেছি, এ কথা অস্বীকার করবে কেন? শুধু বলবে যে, কারণটা এখন প্রকাশ করা হবে না।
পরদিন সকালেই দলে দলে দর্শনার্থীর সমাগম ঘটায় মহেশ বারণ না মানিয়া সব কথা প্রকাশ করিয়া দিয়াছে ভাবিয়া সদানন্দ প্রথমটা বড়ই রাগিয়া যায়।
মহেশ চৌধুরী বলে, আজ্ঞে না, আমি কিছুই বলি নি। আপনি এখানে এসেছেন জেনে সকলে প্ৰণাম করতে আসছে।
আমি এখানে এসেছি, এ কথাটাও এত তাড়াতাড়ি নাই বা ছড়িয়ে দিতে মহেশ? দুদিন একটু শান্তিতে থাকতাম।
আপনি এসেছেন, এ কথা কি ছড়িয়ে দেবার দরকার হয় প্ৰভু? মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে যায়। সূর্যকে কি লুকিয়ে রাখা চলে প্রভু! কাল সকালে যখন এলেন, তখনি গাঁয়ের অর্ধেক লোক জেনে। গেছে আপনি এসেছেন। কালও অনেকে এসেছিল, আমি আপনাকে বিরক্ত করতে দিই নি। আজ আসতে বলে দিয়েছিলাম।
সকলে আসে, প্রণাম করিয়া যায় এবং অনেকে প্রণামীও দেয়। মাধবীলতা কাছে উপস্থিত থাকিলে কেউ কেউ কৌতুহলের দৃষ্টিতে তাকে দ্যাখে, কৌতূহলের সঙ্গে মেশানো থাকে ভয়। কে জানে, মাধবীলতার সম্বন্ধে তাদের মনে কি কল্পনার ছায়া ভাসিয়া আসিতে শুরু করিয়াছে। মেয়ে দরকার হয়, এমন সাধনাও তো সাধু-পুরুষেরা করে, শব-সাধনার মতো যে সব সাধনার কাল্পনিক বিবরণ শুনিলেই সাধারণ মানুষের রোমাঞ্চ হয়।
প্রণামী নিয়া একটু বিপদ হয়। প্ৰণামী নেওয়া হইবে কিনা, সদানন্দও ঠিক করিতে পারে না, মহেশও ঠিক করতে পারে না। প্রথমে মুখ খোলে মহেশ।
কি করব প্ৰভু?
তুমি কি বল মহেশ?
আমার মনে হয়, প্রণামী এখন না নেওয়াই ভালো। এখন প্রণামী নিলে যেন নিজের জন্য নেওয়া হবে প্রভু। আশ্রম খোলা হলে তখন আশ্রমের জন্য প্রণামী নিলে দোষের হবে না।
শুনিয়া সদানন্দ ভাবে, মহেশ তবে তাকে নিয়া নূতন একটি আশ্রম খুলিবার কল্পনা আরম্ভ করিয়া দিয়াছে? কে জানে, প্রথম হইতেই মনে মনে মহেশের এ মতলব ছিল কিনা! হয়তো এরকম একটা উদ্দেশ্য নিয়াই তাকে বাগানোর জন্য এতকাল মহেশ হাজার অপমান সহিয়াও আশ্রমে যাতায়াত করিয়াছে, অতিভক্তির বন্যায় তাকে ভাসাইয়া দেওয়ার চেষ্টা করিয়াছে। প্রথম প্রথম মহেশকে একটু বোকা মনে হইত, কিন্তু এখন সময় সময় তাকে সদানন্দের বিপিনের চেয়েও চালাক মনে হয়।