বটে! বিপিনবাবুর স্পৰ্ধা তো কম নয়!
তারপর সদানন্দের সামনে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া হাত জোড় করিয়া ঊৰ্ধমুখে সদানন্দের মুখের দিকে চাহিয়া গদগদ কণ্ঠে বলিল, আপনি আমার এখানে থাকবেন প্রভু? আমার এত বড় সৌভাগ্য হবে, আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি। আজ আমার জীবন সার্থক হল। এ বাড়ি আপনার, এ বাড়ির মেয়ে-পুরুষ আপনার দাসদাসী।
ব্যাপারটা কি হইয়াছে, কেন বিপিন হঠাৎ সদানন্দকে আশ্রম হইতে তাড়াইয়া দিয়াছে, এ ক্ষমতা বিপিন কোথায় পাইল, সকলের মনে এ ধরনের কত যে প্রশ্ন জাগিতেছিল হিসাব হয় না। কিন্তু সদানন্দকে কিছু জিজ্ঞাসা করিবার সাহস কারো নাই। ভরসা না পাওয়ার জন্যই হোক অথবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, মহেশ চৌধুরীও এ বিষয়ে একেবারে মুখ বুজিয়া ছিল।
অন্য কেউ কথা তুলিবে ভাবিয়া মাধবীলতা একটু অপেক্ষা করে, তারপর খানিকক্ষণ ইতস্তত করিয়া বলিয়া বসে, আপনাকে তাড়িয়ে দিলেন কেন বিপিনবাবু?
সদানন্দ কিছু বলিবার আগেই মহেশ চৌধুরী বলে, কি যে তুমি বল মাধু? তাড়িয়ে আবার কে দেবে প্রভুকে? উনি রাগ করে চলে এসেছেন, তাও বুঝতে পার না?
সদানন্দ বলে, না মহেশ, বিপিন আমায় তাড়িয়ে দিয়েছে।
মহেশ বলে, তাই কি হয় প্রভু! আপনাকে তাড়াবার ক্ষমতা কারো নেই।
সদানন্দ বলে, তা আছে বৈকি। আশ্রমটা বিপিনের সম্পত্তি। আমি আশ্রমের শিক্ষক হিসাবে ছিলাম, কবছরের মাইনে ছাড়া আর কিছু দাবি করতে পারব না। বিষয়বুদ্ধি তো নেই–
আপনার বুদ্ধির কাছে বিপিনবাবুর বিষয়বুদ্ধি! মহেশ চৌধুরী একগাল হাসে, কবিঘা মেঠো জমি বিপিনবাবুর নিজের নামে লিখে নিয়েছেন, আপনি জয় করেছেন মানুষগুলিকে। আশ্রম কখনো বিপিনবাবুর সম্পত্তি হতে পারে প্রভু? আপনাকে নিয়ে তবে তো আশ্রম। আপনি যেখানে থাকবেন। সেখানটাই হবে আশ্রম। আপনি যখন চলে এসেছেন, আপনার সঙ্গে আশ্রমও চলে এসেছে।
সজোরে নিশ্বাস ফেলিয়া গভীর আফসোসের সঙ্গে মহেশ আবার বলে, প্রথমটা রাগ হয়েছিল, এখন আবার বিপিনবাবুর জন্য মায়া হচ্ছে। বুদ্ধির দোষে মানুষ কি সৰ্বনাশটাই নিজের করে।
মহেশ চৌধুরী সদানন্দের বিশ্রামের ব্যবস্থা করিয়া দিল। মহেশ চৌধুরীর ঘরবাড়ি সর্বদাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, ঘষামাজা, ধোঁয়া-মোছা নিয়া বিভূতির মা সব সময়েই ব্যস্ত হইয়া আছে। সবচেয়ে ভালো ঘরখানায় তাড়াতাড়ি সদানন্দের থাকিবার ব্যবস্থা করিয়া দেওয়া হইল। পিতামহের আমলের প্রকাণ্ড খাটে আনকোরা নূতন তোশক পাতা হইল–একটু ছোট হইল তোশকটা। তা হোক, লোকের ব্যবহার করা তোশক তো আর সদানন্দকে দেওয়া যায় না। তোশক ঢাকা পড়িল গায়ে দেওয়ার মুগার চাদরে। বালিশের বদলে দেওয়া হইল ঝালর দেওয়া তাকিয়া, কেবল বিশেষ উপলক্ষে আসর পাতা হইলে যেগুলি কাজে লাগে। ঘরের এক কোণে পড়িল ঘরে বোনা কার্পেটের আসন, দুপাশে জ্বলিতে লাগিল ধূপধুনা আর কোণ ঘেষিয়া একটি মস্ত ঘিয়ের প্রদীপ। অভ্যর্থনার আরো কত ছোট-বড় আয়োজনই যে মহেশ চৌধুরী করিল! কিছুকাল আগেও মহেশ চৌধুরীর বাড়ি ছিল নিস্তব্ধ, মহেশ আর তার ভাগ্নে শশধর এবং তাদের দুজনের দুটি স্ত্ৰী চুপচাপ এ বাড়িতে দিনরাত্রি কাটাইয়া দিত, কারো মধ্যে যেন প্ৰাণ ছিল না। তারপর মাধবীলতা আসিয়াছে, বিভূতি আসিয়াছে, আজ আসিল সদানন্দ–মাধবীলতার পদার্পণের পর সেই যে একটু জীবনের সাড়া জাগিয়াছিল বাড়িতে, আজ যেন তা চরমে উঠিয়া দাঁড়াইয়া গিয়াছে বিশেষ একটি উৎসবে।
সকলের মধ্যে চাঞ্চল্য আসিয়াছে, মুখে ফুটিয়াছে কথা। একজন কেবল আগেও যেমন চুপচাপ ছিল, এখনো তেমনি চুপচাপ থাকিয়া গিয়াছে। সে শশধরের ঘোমটা-টানা বৌ। কোন ফাঁকে কখন বাড়ির কোন আড়াল হইতে আসিয়া সে যে সদানন্দের সামনে মাটিতে মাথা ঠেকাইয়া প্ৰণাম করিল এবং আবার নিজের অন্তরালে চলিয়া গেল, কেউ খেয়ালও করিল কিনা সন্দেহ। শশধরের বৌ যে বাড়িতে থাকে, অধিকাংশ সময়ে তা টেরও পাওয়া যায় না।
মহেশ কেবল একবার একরাশি বাসন হাতে খিড়কি পুকুর যাওয়ার সময় উঠানের কোণে পিছন হইতে তাকে পাকড়াও করিয়া বলিল, বৌমা, তুমিই প্রভুর জন্য রান্না কোরো। চান করে
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে যেমন করে ঠাকুরদেবতার ভোগ রান্না কর না, ঠিক তেমনি করে।
শশধরের বৌ মামাশ্বশুরের সঙ্গে কথা বলে না। ডাক শুনিয়া মহেশ চৌধুরীর দিকে পিছন করিয়াই সে থমকাইয়া দাঁড়াইয়াছিল, ঠিক সেই অবস্থাতেই ঘোমটার মধ্যে মাথা নত করিয়া সে নীরবে সায় দিল। মহেশ চৌধুরী সরিয়া গেলে আর কিছু বলিবার নাই জানিয়া আবার চলিতে আরম্ভ করিল খিড়কির পুকুরের দিকে।
তারপর মহেশ জিজ্ঞাসা করিতে গেল, শশধরের বৌ স্নান করিয়া ভোগ রান্না করিয়া দিলে সদানন্দের আপত্তি নাই তো?
সদানন্দ বলিল, বাড়াবাড়ি কোরো না মহেশ, বাড়াবাড়ি কোরো না।
মহেশ বলিল, না প্ৰভু।
সকলের জন্য যা রান্না হবে, আমিও তাই খাব। আমার ওসব নেই জান তো?
আপনি অনুমতি দিলে একটু বিশেষভাবেই রান্নাটা করাই প্রভু। আশ্রমের কথা আলাদা, এখানে–
সদানন্দ হাসিয়া বলিল, তুমি আমায় টিকতে দেবে না মহেশ।
মহেশও হাসিয়া বলিল, আপনাকে আমি আর ছাড়ব না প্রভু, আজ থেকে আপনি আমার হয়ে গেলেন।
অন্য কেহ হইলে হয়তো এ কথার জবাবে তামাশা করিয়া বলিত, আজ তোমার সম্পত্তি হয়ে গেলাম মহেশ? কিন্তু ওসব রসিকতা সদানন্দের আসে না। মহেশ যে তাকে সত্য সত্যই স্থায়ীভাবে এখানে আটকাইয়া ফেলিবার বিরাট আয়োজন আরম্ভ করিয়া দিয়াছে, সদানন্দের এটা যেন ভালো লাগিতেছিল না। বিপিন একবার রাগ করিয়া আশ্রম হইতে একদিনের জন্য কিছু না বলিয়া যখন চলিয়া গিয়াছিল, আশ্রমের পাশের আমবাগানটি যেবার সে বাগাইয়া আনে, তখন বিপিনের জন্য তার কি রকম মন কেমন করিয়াছিল, সদানন্দের মনে আছে। আজ নিজে রাগ করিয়া চলিয়া আসিয়াও তার তেমনি মন কেমন করিতেছে। সেবার যেমন কেবলই মনে হইত বিপিন ফিরিয়া আসিবে, আজ তেমনি আশা হইতেছে বিপিন হয়তো ডাকিতে আসিবে, হাতে-পায়ে ধরিয়া তাকে ফিরাইয়া নিয়া যাইবে।