মহেশ তখনো হাত জোড় করিয়া বলে, ওকে প্রণাম না করিয়ে কেমন করে যাব প্ৰভু?
সদানন্দ বাক্যহারা হইয়া থাকে। মহেশ বলে, বিভূতি, প্রণাম কর প্রভুকে।
বিভূতি নড়ে না। সদানন্দ আগাইয়া গিয়া সশব্দে মহেশের গালে বসাইয়া দেয় এক চড়।
কিছুদূরে চালার নিচে আশ্রমের অধিকাংশ নরনারী জমা হইয়াছিল; দু-চারজন করিয়া তখনো আসিয়া জুটিতেছিল। সদানন্দ আজ আত্মজ্ঞানলাভের প্রক্রিয়ায় ব্রহ্মচর্যের স্থান সম্বন্ধে উপদেশ দিবে। সকলে নিঃশব্দে সদানন্দের প্রতীক্ষা করিতে করিতে কাঠের গুড়িটার কাছে এদের লক্ষ্য করিতেছিল। ততদূর হইতে কথা বোঝ তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, কিন্তু সকলের চলাফেরা আর অঙ্গভঙ্গির নির্বাক অভিনয় দেখিয়া বেশ অনুমান করিতে পারিতেছিল যে, রীতিমতো একটি ব্যাপারই ঘটিতেছে। সদানন্দ আগাইয়া গিয়া মহেশ চৌধুরীর গালে যে চড় বসাইয়া দিয়াছে, এটা তারা স্পষ্টই দেখিতে পাইল। হঠাৎ একটা জোরালো গুঞ্জনধ্বনি উঠিয়া আবার তৎক্ষণাৎ থামিয়া গেল।
সদানন্দ সকলের আগে একবার চাহিয়া দেখিল চালার দিকে। অনেক সাক্ষীর সামনেই মহাপুরুষ সদানন্দ সাধু মহেশ চৌধুরীকে মারিয়া বসিয়াছে বটে। এখন কেবল ঘটনাটা সকলের চোখে পড়িল, পরে বিস্তারিত বিবরণ শুনিবে।
রত্নাবলীর চোখ আর পাঁত দুই-ই তখন চকচক করিতেছে। মাধবীলতা অস্ফুট শব্দ করিয়া মুখের মধ্যে পুঁজিয়া দিয়াছে ডান হাতের চারটি আঙুল ছেলেবেলায় মাধবীর এই অভ্যাসটা ছিল, বড় হইয়া কোনোদিন এভাবে সে মুখে আঙুল ঢুকাইয়া দেয় নাই।
থমত খাইয়া গিয়াছিল সকলেই, কিন্তু দেখা গেল অবাধ্য বিভূতি বাপের অপমানের প্রতিকার করিতে বড়ই চটপটে। মহেশ চৌধুরীর মোটা বাঁশের ছড়িটি কাঠের গুড়িতে ঠেস দিয়া রাখা ছিল। চোখের পলকে লাঠিটা তুলিয়া নিয়া সে সদানন্দের দিকে আগাইয়া আসিল। দেশের জন্য মানুষ খুন। করার কেবল পরামর্শ করার জন্য এতগুলি বছর সে আটক থাকিয়া আসিয়াছে, আজ বাপের জন্য হয়তো সত্য সত্যই মানুষ খুন করিয়া বসিত। বাধা দিল মহেশ।
ছি বিভূতি, ছি।
বিভূতির হাতের লাঠি ছিনাইয়া নিয়া সদানন্দের পদতলে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া মহেশ চৌধুরী তার মাথা গুজিয়া দিল।
আপনাকে রাগিয়েছি, আমায় মাপ করুন প্রভু। ছেলে আমার আপনাকে লাঠি নিয়ে মারতে উঠেছিল, আমায় মাপ করুন প্রভু।
প্রায় আর্তনাদ করার মতো চিৎকার করিয়া বিভূতি বলিল, তোমার কি লজ্জাশরম নেই বাবা?
কি বকছিস্ তুই পাগলের মতো? প্ৰণাম কর বিভূতি, প্রভুকে প্রণাম কর। ও বিভূতি, শিগগির প্ৰণাম কর প্রভুকে। আমি না তোর বাপ বিভূতি? আমার দেবতাকে মারবার জন্য তুই লাঠি তুলেছিস, হাত যে তোর খসে যাবে রে, কুষ্ঠ হবে যে তোর হাতে! শিগগির প্রণাম কর বিভূতি, প্রভুকে শিগগির প্রণাম কর।
পাগল হইয়া গিয়াছে মহেশ চৌধুরী? বিভূতি সভয় বিস্ময়ে সদানন্দের পদতলে বাপের সর্বাঙ্গীণ আত্মোৎসর্গ চাহিয়া দেখে আর তার অভিনব মন্ত্ৰোচ্চারণ শুনিয়া যায়।
মাধবীলতা কানের কাছে ফিসফিস করিয়া বলে, প্রণাম করে নিন। তারপর ওঁকে নিয়ে বাড়ি যাই চলুন।
বিভূতি একটু ইতস্তত করিয়া সদানন্দকে প্রণাম করিবার জন্য আগাইয়া যায়। মহেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া সদানন্দের পা দুটিকে মুক্তি দেয়। হাত জোড় করিয়া নিবেদন জানায়, প্রভু, আশীর্বাদ করুন, ছেলের যেন আমার সুমতি হয়।
০৯. বিকালে মহেশ চৌধুরীর বাড়িতে
বিকালে মহেশ চৌধুরীর বাড়িতে সকলে পিঠা খাইতে বসিয়াছে। খাওয়ার জন্য বিভূতির লুব্ধ ব্যাকুলতা দেখিয়া তার মার চোখে জল আসিয়া পড়িতেছিল। ছেলে বাড়ি ফেরার পর বিভূতির মা আজকাল কেবল নানা রকম খাবারই তৈরি করে। বিভূতি খাইতে পারে না, সামান্য কিছু খাইলেই তার পেট ভরিয়া যায়। দুর্ভিক্ষপীড়িতের মতো উগ্র খাওয়ার লোভের তার তৃপ্তি হয় না। তার চাহনি দেখিয়া কত কথাই যে মাধবীলতার মনে হয়। হঠাৎ শিহরিয়া উঠিয়া মাথায় সে একটা ঝাঁকুনি দেয়।
ভিতরের চওড়া বারান্দায় অর্ধচন্দ্রাকারে সকলে বসিয়াছে, মুখোমুখি হওয়ার সুবিধার জন্য। বৈকালিক জলখাবার শেষ হইতে কোনো কোনোদিন দুঘণ্টা সময়ও লাগিয়া যায়। রাজ্যের কথা আলোচনা হয় এই সময়। আজ কথাবার্তা তেমন জমিতেছিল না। সকালের ঘটনায় একমাত্র মহেশ চৌধুরী ছাড়া সকলেই কম-বেশি অস্বস্তি বোধ করিতেছে।
হঠাৎ বিভূতি বলিল, আচ্ছা বাবা, তুমি পাগল হয়ে গেছ?
মহেশ চৌধুরী হাসিয়া বলিল, কে আগে কথা তোলে দেখছিলাম। পাগলামি মনে হয়েছে। তোদের, না? কেন বল তো? পাগলের কথা, কাজ, কোনো কিছুর মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে না, আমি
তো খাপছাড়া কিছু বলিও নি, কিছু করি নি।
বল নি? কর নি?
না। আমি আবোল-তাবোল কথা কোনোদিন বলি না, খাপছাড়া কাজ করি না। মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যেতে পারে, তা সেটা সবারই হয়।
এরকম অহঙ্কার তো কখনো দেখি নি তোমার! নিজেকে প্রায় মহাপুরুষে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছ।
মহেশ চৌধুরী মাথা নাড়িল, তা করি নি, একটা সোজা সত্য কথা বলেছি। তোর অহঙ্কার মনে হল কেন জানি? তোর সঙ্গে কথা বলবার সময় আমার মনে আছে তুই আমার ছেলে, কিন্তু আমার বিচার করার সময় তুই ভুলে যাচ্ছিস যে আমি তোর বাপ। কথাটা প্রভুকে বললে অন্যভাবে বলতাম শুনলে আমার বেশি বেশি বিনয় দেখে তুই চটে যেতিস, তখন তার খেয়াল থাকত যে আমি তোর বাপ, আর নিজের বাপের আত্মমর্যাদা, জ্ঞানের অভাব দেখে লজ্জায় দুঃখে অপমানে তোর মাথা হেঁট হয়ে যেত।