সকলে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, বিভূতি ওঠে নাই। বসিয়া থাকিয়াই সে দুহাত একত্ৰ করিয়া কপালে ঠেকাইয়া বলিল, নমস্কার, ভালো আছেন? অনেক দিন পরে দেখা হল। আপনার আশীর্বাদ গবর্নমেন্টকেও টলিয়ে দিতে পারে, তা তো জানতাম না! .
সদানন্দ শান্তভাবে বলিল, আমার বলে নয়, আশীর্বাদ আন্তরিক হলে ভগবানকে পর্যন্ত টলিয়ে দিতে পারে বাবা।
বিভূতি আরো বেশি শান্তভাবে বলিল, ভগবানের কথা বাদ দিন, তিনি তো সব সময়েই টলছেন মাতালের মতো। টাল সামলাতে প্রাণ বেরোচ্ছে আমাদের।
মাধবীলতা চোখ বড় বড় করিয়া বিভূতির দিকে চাহিয়া থাকে। রত্নাবলীর সাদা দাঁতগুলি ঝকঝক করে। অস্থির হইয়া ওঠে মহেশ। কি করিবে ভাবিয়া না পাইয়াই যেন প্রথম দিকে ব্যাকুলভাবে শুধু বলিয়া চলে, আহা, ওকি আর ছি ছি। তারপর হঠাৎ রাগ করিয়া, সোজা আর শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া, গম্ভীরকণ্ঠে ডাকে, বিভূতি!
বসা অবস্থাতেই বিভূতি বলে, কেন?
পায়ে হাত দিয়ে এঁকে প্রণাম কর, নিজের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়ে নাও।
এঁকে আমার প্রণাম করতে ইচ্ছা হয় না বাবা। ক্ষমা চাওয়ার মতো অন্যায় কথা কিছু বলি নি।
এঁকে আমি দেবতা মনে করে পূজা করি, আমার ছেলে তুই, একে তোর প্রণাম করতে ইচ্ছা হয় না? যা মনে এল বলে বসলি মুখের ওপর, তবু তোর অন্যায় কথা বলা হল না?
বিভূতি নীরবে মাথা নাড়িল।
করবি না প্ৰণাম?
না।
এবার প্রশান্তকণ্ঠে সদানন্দ বলিল, মহেশ, কি ছেলেমানুষি আরম্ভ করে দিলে তুমি?
ছেলেমানুষি প্ৰভু?
তুমি কি ভাব ওর প্রণাম পাওয়ার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে আছি?
তা ভাবি নি প্রভু। ও প্রণাম করুক না করুক আপনার তাতে কি আসবে যাবে সর্বনাশ হবে ওর নিজের। ও যে আমার সন্তান প্রভু?
সদানন্দ অভয় দিয়া বলিল, ভয় নেই, ওর কিছু হবে না। প্রণাম নিয়ে আমি আশীৰ্বাদ বিক্রি করি না মহেশ, আশীৰ্বাদ করাটা আমার ব্যবসা নয়, ভুলে যাও কেন? ছেলেমানুষের কথায় যদি আমি রাগ করি, আমি যে ওর চেয়েও ছেলেমানুষ হয়ে যাব।।
মহেশ ভক্তিগদগদ কণ্ঠে বলিল, তা কি জানি না প্ৰভু? আপনি দেবতা, আপনার কি রাগ-দ্বেষ আছে? কিন্তু আপনাকে প্রণাম না করলে ওর অকল্যাণ হবে।
অনিচ্ছায় প্রণাম করার চেয়ে না করাই ভালো, মহেশ।
না প্ৰভু। প্ৰণম্যকে প্রণাম করতেই হয়। প্রণাম করতে করতে মনে ভক্তি আসে।–বিভূতি, প্ৰণাম কর একে।
বিভূতি নীরবে মাথা নাড়িল।
মহেশ আবার বলিল, বিভূতি, প্রণাম কর। এই দণ্ডে যদি প্রণাম না কর এঁকে, আমি যেমন আছি তেমনিভাবে যে দিকে দুচোখ যায় চলে যাব, কোনোদিন আর ফিরব না।
বিভূতি শুকনো মুখে কোনো রকমে বলিল, আমি পারব না বাবা।
মাধবীলতার সব কথাতেই ফোড়ন দেওয়া চাই। পিতার আদেশ আর মিনতি যেখানে ব্যর্থ হইয়া গেল, যেদিকে দুচোখ যায় চলিয়া যাওয়ার ভয় প্রদর্শন পর্যন্ত কাজে লাগিল না, সেখানে কাতরকণ্ঠে বিভূতিকে অনুরোধ না জানাইয়া সে পারিল না, আহা এমন করে বলছেন সবাই, করুন না প্রণাম একবারটি?
এমন সময় আসিল বিপিন।
কারো দিকে বিপিন চাহিয়াও দেখিল না। সোজাসুজি মাধবীলতার কৈফিয়ত দাবি করিয়া বলিল, আমায় না জানিয়ে আশ্রমে এলে যে মাধু?
বিপিনের মুখ দেখিয়া আর গলার আওয়াজ শুনিয়া মাধবীলতার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। মহেশ বলিল, আমি ওকে এনেছি বিপিনবাবু।
বিপিন তীব্রস্বরে ধমক দিয়া বলিল, চুপ করুন, আপনাকে আমি কিছু জিজ্ঞাসা করি নি।
প্রকাশ্যভাবে কেউ কোনোদিন বিপিনকে উঁচু গলায় কথা বলিতে শোনে নাই–বিশেষত সদানন্দের সামনে।
সকালবেলাই এমন একটা জটিল অবস্থা সৃষ্টি হইবে কেহ কল্পনা করতে পারে নাই। মনে মনে সকলেই একটা শঙ্কা-জড়িত অস্বস্তি বোধ করিতে থাকে। বিভূতি সদানন্দকে প্রণাম করিতে অস্বীকার করায় যে খাপছাড়া কাণ্ড ঘটিবার উপক্রম হইয়াছিল, বিপিনের আবির্ভাবে এখনকার মতো সেটা চাপা পড়িয়া গিয়াছে। কিন্তু সে আর কতক্ষণের জন্য? মহেশ চৌধুরী ছাড়িবার পাত্র নয়। সে প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করিয়া দিয়াছে, বিভূতি সদানন্দের পায়ে হাত দিয়া প্ৰণাম না করিলে যেদিকে দুচোখ যায় চলিয়া যাইবে। বিপিনের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া হইয়া গেলেই সে আবার ছেলেকে নিয়া পড়িবে।
কিন্তু কি বোঝাপড়া হইবে বিপিনের সঙ্গে? মহেশ চৌধুরী কি চুপ করিয়া থাকিবে বিপিনের ধমক সহ্য করিয়া? ধমকটা সদানন্দ দিলে সকলে অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করিত, সদানন্দ এমন প্ৰচণ্ড শব্দে ধমক দিলে এতটা খারাপ শোনাইত না। মহেশ চৌধুরীর মতো ভক্তকে ধমক দিবার অধিকার সদানন্দের মতে মহাপুরুষের থাকে এবং আগেও অনেকবার অনেক ছুতায় মহেশ চৌধুরীকে সে অপমান করিয়াছে। সদানন্দের অপমান অনেকটা গা-সহা হইয়া আসিয়াছে মহেশ চৌধুরীর। কিন্তু বিপিনের অপমান সে সহ্য করিবে কেন? দুজনে যদি এখন কলহ বাঁধিয়া যায়।
মহেশ চৌধুরী কি বলে শুনিবার জন্য সকলে উৎকৰ্ণ হইয়া থাকে।
মহেশ চৌধুরীর মুখ দেখিয়া বিশেষ কিছু বোঝা যায় না। বিপিনের ধমকটা তার কানে গিয়াছে কিনা, এ বিষয়েও যেন কেমন সন্দেহ জাগে। চাহিয়া সে থাকে মাধবীলতার মুখের দিকে। কিছুক্ষণের জন্য তার দৃষ্টি এমন তীক্ষ্ণ ও অস্বাভাবিক মনে হয় যে, এতদিনের ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের পর তার একটা নূতন রূপ আবিষ্কারের সম্ভাবনায় শশধর ও সদানন্দের কেমন ধাঁধা লাগিয়া যায়।
মহেশ চৌধুরীর মুখ ধীরে ধীরে গম্ভীর হইয়া আসে। আকাশের দিকে একবার মুখ তুলিয়া উদাস কণ্ঠে সে বলে, মধু আশ্রমে আসতে পাবে না হুকুম দিয়েছিলেন, আমি জানতাম না বিপিনবাবু!