বিপিন আশ্চর্য হইয়া বলে, ওদিকে কোথায় চলেছ?
মাধবীলতা কুদ্ধকণ্ঠে বলে, ফপরদালালি করবেন না–আমি পথ চিনি।
শোন, শোন। দাঁড়াও
পিছনে পিছনে খানিকটা প্রায় ছুটিয়া গিয়া মাধবীলতার হাত ধরিয়া বিপিন তাকে দাঁড় করায়। মাধবী বলে, ও! আপনি বুঝি পাওনা মিটিয়ে নেবেন আগে? শিগগির নিন, একটু তে ঘুমাতে হবে রাত্রে?
বিপিন কোমলকণ্ঠে বলে, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে মাধু? কি বকছ পাগলের মতো?
মাধবীলতাও কোমলকণ্ঠে বলে, মাথা খারাপ হবে না? যা আরম্ভ করে দিয়েছেন আপনারা, এতে মাথা ঠিক থাকে মানুষের? এর চেয়ে কুমারসায়েবের মিসট্রেস্ হওয়াই আমার ভালো ছিল, কিছুদিন তো মজা করে নিতাম।
এখানটা ফাঁকা, কাছাকাছি দু-একটি মোটে গাছ আছে। এদিকে এলোমেলোভাবে ছড়ানো আশ্রমের কুটিরগুলির কয়েকটি মাত্র চোখে পড়ে, আর এদিকে চোখে পড়ে সদানন্দের কুটির। জ্যোঙ্গালোকে কুটির ও আবেষ্টনীর মধ্যে ফাকা মাঠে মাধবীলতার হাত ধরিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে থাকিতে বিপিনের মনে হয়, আঙুলগুলি যদি তার পাখির পালকের মতো কোমল হইয়া না যায়, আর সে যদি মেয়েটার সর্বাঙ্গে সস্নেহে আঙুল বুলাইয়া না দেয়, পৃথিবীটাই রসাতলে চলিয়া যাইবে! অকারণে নিজেকে এই মেয়েটার জন্য মহাশূন্যে বিলীন করিয়া দিবার কোনো একটা কারণ কি আবিষ্কার করা যায় না? অসহ্য কোনো যন্ত্ৰণা সহ্য করা যায় না এই মেয়েটার জন্য? অসম্ভব কোনো কার্য সম্ভব করা চলে না? ভাবিতে ভাবিতে মাধবীলতার মাথাটি বুকে চাপিয়া ধরিয়া বিপিন মৃদুস্বরে। বলে, মাধু, কে তোমার ওপর অত্যাচার করছে বল, কাল তাকে আশ্রম থেকে দূর করে তাড়িয়ে দেব। এ আশ্ৰম আমার, দলিলপত্রে আমার নাম আছে, আমার কথার ওপর কারো কথা কইবার অধিকার নেই। কে তোমার মনে কষ্ট দিয়েছে, একবার তার নামটি শুধু তুমি বল।
কি উগ্র উদারতা বিপিনের! এদিকে চাপিয়া ধরিয়াছে মাধবীর মাথাটা নিজের বুকে, মুখে তাকে জিজ্ঞাসা করিতেছে কে অত্যাচার করিয়াছে তার উপর, কে কষ্ট দিয়াছে তার মনে? একটু কঁদে মাধবীলতা, একটু ফোঁসফোঁস করে। বিপিন ব্যাকুল হইয়া বলে, কেন কাঁদছ মাধু? কেঁদ না। বল না তুমি কি চাও? অন্য কোথাও চলে যাবে?
কোথায় যাব? কার কাছে যাব?
যেখানে যেতে চাও, পাঠিয়ে দেব। নিজে আমি তোমার নামে বাড়ি কিনে দেব, ব্যাংকে। তোমার নামে টাকা জমা রেখে দেব–
আপনার মিস্ট্রেস হয়ে থাকতে হবে তো?
বিপিন একটু ভাবিল। হাতের আঙুল পাখির পালক নয় বলিয়া আফসোস করার সময় সদানন্দ যেমন ভুলিতে পারিতেছিল না যে, মাধবীলতার ঠোঁটের নিচে দাঁত আছে, আর আঙুলের ডগায় নখ আছে আর রক্তমাংসের তলায় হাড় আছে, বিপিনও তেমনি এখন কেবলি ভুলিবার চেষ্টা করিতেছিল যে, মাধবীলতা যাকে হাতের কাছে পায়, তাকেই আঁকড়াইয়া ধরে।
ভাবিয়া চিন্তিয়া বিপিন তারপর জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কি বল?
মাধবীলতা চুপ। বিপিন সত্যই মানুষ নয়।
যাকগে, ওসব কথা পরে হবে। এখন চল, তোমাকে মহেশবাবুর ওখানে রেখে আসি।
মহেশবাবুর ওখানে?
হ্যাঁ। এখানে তোমার থাকা চলবে না।
মাধবীলতা কাঁদিতে কাদিতে বিপিনের সঙ্গে নদীর ঘাটে গিয়া নৌকাটিতে উঠিয়া বসিল। ছোট ডিঙি নৌকা, ছাউনি নাই, হাল নাই, বসিবার ভালো ব্যবস্থাও নাই। তবু পায়ে হাঁটিয়া যাওয়ার চেয়ে নৌকায় মহেশ চৌধুরীর বাড়ি যাওয়া অনেক সুবিধা। বিপিন নৌকা বাহিতে জানে।
০৭. কয়েকদিন জ্বরে ভুগিয়া মহেশ চৌধুরী সারিয়া উঠিলেন
কয়েকদিন জ্বরে ভুগিয়া মহেশ চৌধুরী সারিয়া উঠিলেন। এ কয়দিন কত লোক আসিয়া যে তার খবর জানিয়া গেল, হিসাব হয় না। কেবল খবর জানা নয়, পায়ের ধুলা চাই। সদানন্দের আশ্রম জয় করিয়া আসিয়া মহেশ চৌধুরীও পর্যায়ে উঠিয়া গিয়াছেন। লোকের ভিড়েই মহেশ চৌধুরীর প্রাণ বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম হইয়াছিল, মাধবীলতাকে পৌঁছিয়া দিতে আসিয়া কথায় কথায় এই বিপদের কথাটা শুনিয়া বিপিন ভালো পরামর্শ দিয়া গেল। পরদিন হইতে শশধর সকলকে একটি করিয়া তুলসীপাতা বিতরণ করিয়া দিতে লাগিল–উঠানের মস্ত তুলসীগাছটি দেখিতে দেখিতে দু-একদিনের মধ্যে হইয়া গেল প্ৰায় ন্যাড়া। যারা আসে, তাদের প্রায় সকলেই চাষী-মজুরকামার-কুমার শ্রেণীর এবং বেশিরভাগই স্ত্রীলোক–তুলসীপাতা পাইয়াই তারা কৃতার্থ হইয়া যাইতে লাগিল।
বিপিন প্রত্যেক দিন খবর জানিতে আসে। কার খবর জানিতে আসে, মহেশের অথবা মাধবীলতার সেটা অবশ্য ঠিক বোঝা যায় না। যদিও মহেশের কাছেই সে বসিয়া থাকে অনেকক্ষণ, আলাপ করে নানা বিষয়ে। আশ্রমে বিপিনের কাছে মহেশ বহুদিন ধরিয়া যে অবহেলা অপমান পাইয়া আসিতেছে, সে কথা কেউ ভুলিতে পারিতেছিল না, এখন মহেশের খাতির দেখিয়া সকলে অবাক হইয়া গিয়াছে। আশ্রমের কদমগাছের নিচেই কি মহেশের সব লাঞ্ছনার সমাপ্তি ঘটিয়াছে? সদানন্দ কি সত্যই এতকাল মহেশকে পরীক্ষা করিতেছিলেন, বিপিন এবং আশ্রমের অন্যান্য সকলে তারই ইঙ্গিতে মহেশের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিতেছিল? পরীক্ষায় মহেশ সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়ায় এবার বিপিন বাড়ি আসিয়া তার সঙ্গে ভাব করিয়া যাইতেছে, সেবার জন্য মাধবীলতাকে এখানে পাঠাইয়া দিয়াছে?
বিপিন আসে, নানা বিষয়ে আলোচনা করে, আর মহেশ চৌধুরীর ভক্তদের বিশেষভাবে লক্ষ করিয়া দ্যাখে। কয়েকদিন পরে মহেশ চৌধুরীর আশীর্বাদপ্রার্থীদের সংখ্যাও কমিয়া যাইতে থাকে, বিপিনের উৎসাহেও যেন ভাটা পড়িয়া যায়। প্রতিদিন আর তাকে বাগবাদায় দেখা যায় না। আসিলেও মহেশের কাছে সে বেশিক্ষণ বসে না।