জিজ্ঞাসা করায় রত্নাবলী বলিল, ওরা খাচ্ছে।
এখনো খাওয়া হয় নি কেন?
রত্নাবলী মাথায় একটা ঝাঁকি দিয়া ঝাঁঝালো গলায় বলিল, কারণ আছে, ওসব মেয়েদের ব্যাপার আপনি বুঝবেন না। পারি না বাপু আর আপনার কথার জবাব দিতে।
মনে মনেও কোনো রকমেই বিপিন রাগ করিতে পারিতেছিল না, আশ্রমের নিয়ম ভঙ্গ করা তার কাছে গুরুতর মনে হইতেছিল না। আশ্রমের নিয়মেই যেন এসব ঘটিতেছে, আগাগোড়া তার নিজেরও সমর্থন আছে। একটু ভাবিল বিপিন, তারপর কোনোরকমে গলা গম্ভীর করিয়া বলিল, আপনি ভেতরে যান, রাত্রে কেউ কোনো দরকারে আশ্রমে এলে এবার থেকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। আর আপনি বাড়ি ফিরে যান শশধরবাবু, মহেশবাবুকে বলুন গিয়ে মাধবীকে সঙ্গে করে নিয়ে আমি যাচ্ছি।
আজ রাত্রেই যাবেন?
অসুখবিসুখের সময় কি দিন-রাত্রির বিচার করলে চলে? সময় বুঝে মানুষের অসুখ হয় না। বুড়ো মানুষ, এমন অসুখে পড়েছেন, তাঁর সামান্য একটা ইচ্ছা যদি আমরা না পূর্ণ করিতে পারি, আমাদের আশ্রমে থাকা কেন? নিজেরা সুখে থাকার জন্য আমরা আশ্রম-বাস করি না শশধরবাবু।
শশধর অভিভূত হইয়া দাঁড়াইয়া থাকে। বিপিন তাগিদ দিয়ে বলে, দাঁড়িয়ে থাকবেন না, আপনি যান। বলুন গিয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা যাচ্ছি।
শশধর চলিয়া গেলে রত্নাবলী জিজ্ঞাসা করিল, এত দূর রাস্তা যাবেন কি করে? হেঁটে?
সে ভাবনা তো আপনাকে ভাবতে বলি নি? আপনাকে যা বললাম তাই করুন, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন।
রত্নাবলী সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল, আমি সঙ্গে যাব না?
বিপিন বলিল, না।
এত রাত্রে বিপিন মাধবীলতাকে সঙ্গে করিয়া মহেশ চৌধুরীর বাড়ি যাইবে। মহেশ চৌধুরীর। বাড়ি কাছে নয়, আশ্রম হইতে প্রায় চার মাইল পথ। বিপথে মাঠ-ঘাট বন-জঙ্গলের ভিতর দিয়া গেলে পথ কিছু সংক্ষিপ্ত হয়, কিন্তু এখন বর্ষাকালে দিনের বেলাও সে পথে যাতায়াত করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। আশ্রম হইতে বাগবাদা যাইতে হইলে সাতুর গা ঘেঁরিয়া যাইতে হইবে, সাতুনা বেশি দূরে নয়। সাতুনা পর্যন্ত যাওয়ার আগেই পথের ধারে ছাড়া ছাড়া ভাবে কয়েকজন গৃহস্থের খানকয়েক বাড়ি আর ক্ষেতখামার পাওয়া যায়, তাদের কারো কারো গরুর গাড়ি আছে। বিপিন কি লোক পাঠাইয়া গরুর গাড়ি আনাইয়া লইবে? অথবা মাধবীকে সঙ্গে করিয়া হাঁটিতে আরম্ভ করিয়া দিবে, পথে ওই ছোট পাহাড়টিতে হোক, সাতুনায় হোক, কারো কাছে সগ্ৰহ করিয়া লইবে গরুর গাড়িঃ গরুর গাড়ি না পাওয়া গেলে হটিয়াই হাজির হইবে বাগবাদায় মহেশ চৌধুরীর বাড়িতে? এই সব ভাবিতে ভাবিতে রত্নাবলীর সর্বাঙ্গে কাটা দেয়–আকাশ ও পৃথিবীব্যাপী ক্ষান্তবর্ষার রাত্রি রত্নাবলীকে ঘিরিয়া আছে, নির্জন পথ বাহিয়া দুজন হাঁটিয়া চলিয়াছে ঘুমন্ত গ্রামের গা ঘেঁষিয়া, পথের খানিক খানিক ভিজা চাঁদের আলোয় ঢাকা আর খানিক খানিক বড় বড় গাছের ছায়ায় প্রায় অন্ধকার, কোথাও ঝোপঝাড় পথের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে, কোথাও দুদিকেই জলভরা ক্ষেত হাঁটিয়া চলিতে চলিতে দুজন কখন উঠিয়া বসিয়াছে গরুর গাড়িতে ছাউনির মধ্যে, গাড়ির দোলনে এদিক-ওদিক চলিতে কখন তারা জড়াইয়া ধরিয়াছে পরস্পরকে, কখন শশধরের দুটি হাত অন্ধের দুটি হাতের মতো রত্নাবলীর সর্বাঙ্গে ব্যাকুল আগ্রহে খুঁজিতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে রত্নাবলীর সর্বাঙ্গের পরিচয় একা বিপিনের সঙ্গে একাকিনী মাধবীর এত রাত্রে মহেশ চৌধুরীর বাড়ি যাওয়ার নানারকম অসুবিধা ও অসঙ্গতির কথা ভাবিতে ভাবিতে রত্নাবলীর গায়ে সত্যই কাঁটা দিয়া ওঠে। বিপিনের কি মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে? কাল মাধবীকে নিয়া গেলে চলিবে না মহেশ চৌধুরীর বাড়ি?
কি ভাবছেন? খাওয়া হয়ে থাকলে মাধবীকে পাঠিয়ে দিন বাইরে।
আমিও যাই না আপনাদের সঙ্গে?
বিপিন মাথা নাড়িয়া জোর দিয়া বলিল, না না, আপনাকে যেতে হবে না।
আমি সঙ্গে না গেলে মাধু আপনার সঙ্গে যাবে না।
মাধু যাবে কি যাবে না, সেটা আপনার কাছে না শুনে মাধুর কাছেই না হয় শুনতাম?
রত্নাবলী অধীর হইয়া বলিল, বুঝেও কি বুঝতে পারেন না আপনি? এত রাত্রে আপনার সঙ্গে মাধুকে আমি যেতে দেব না। যদি চেষ্টা করেন নিয়ে যাবার, হৈচৈ গণ্ডগোল বাধিয়ে দেব।
বিপিনের যে প্রতিভা কদিন হইতে মায়ানিদ্রায় আচ্ছন্ন হইয়াছিল, রত্নাবলীর মুখে এ কথা শুনিবামাত্র সোনার কাঠির স্পর্শে ঘুমভাঙার মতো চোখের পলকে জাগিয়া উঠিল। সত্যই, চোখের পলকে। প্রত্যক্ষ প্রমাণ পর্যন্ত পাওয়া গেল বিপিনের চোখেই। রত্নাবলী স্পষ্ট দেখিতে পাইল একবার কি দুবার পলক পড়ার মধ্যে বিপিনের চোখ যেন জ্বলজ্বল করিয়া উঠিল অন্ধকারে হিংস্র পশুর চোখের মত, তারপর হইয়া গেল জ্ঞানের ছানিপড়া বৃদ্ধের চোখের মতো স্তিমিত।
আপনাকে নিলে আর গোলমাল করবেন না?
না। আমি সঙ্গে গেলে–
ডাকব নাকি সবাইকে?
রত্নাবলী ভয় পাইয়া বলিল, সবাইকে ডাকবেন? সবাইকে ডাকবেন মানে? কেন ডাকবেন। সবাইকে?
বিপিন গম্ভীরমুখে বলিল, পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে যাওয়া কি ভালো নয়? আপনি এত সঙ্কোচ বোধ করছেন কেন, আপনি প্রথম নন, আপনার মতো দু-একজন এভাবে আশ্রম ছেড়ে গিয়েছে।
আশ্রম ছেড়ে যাব? এতক্ষণ রত্নাবলী দাঁড়াইয়া ছিল, এবার দাওয়ায় উঠিবার ধাপটিতে বসিয়া পড়িল। বলিল, একটু বসি, পা ধরে গেছে। কি বলছেন আপনি বুঝতে পারছি না।
কথাটা সত্য নয়। রত্নাবলী বেশ বুঝিতে পারিতেছিল সব। অনেকদিন আগে, দেড় বছর দু বছরের কম হইবে না, সে তখন অল্পদিন হয় আশ্রমে বাস করিতে আসিয়াছে, বিপিন একদিন এমনিভাবে অসময়ে হঠাৎ সকলকে ডাকিয়াছিল। সীতা নামে একটি শিষ্যার আশ্রমে মন টিকিতেছে না, সে চলিয়া যাইবে, সকলের কাছে বিদায় চাহিতেছে। সে দৃশ্য রত্নাবলীর মনে গাথা হইয়া আছে। কুটিরের সামনে মাটিতে বসানো দুটি লন্ঠনের আলো সকলের মুখে পড়িয়াছে, কারো মুখে বেশি কারো কম। সকলে নির্বাক পাথরের মূর্তির মতো নির্বাক। এখনকার চেয়ে শিষ্য ও শিষ্যার সংখ্যা তখন কম ছিল আশ্রমে।