কিন্তু–
কথাটা মনে হইল মাধবীকে বিদায় দিয়া ঘরের মধ্যে বিপিনের কাছে চৌকিতে গিয়া বসিবার পর। আশ্রমে যে আসিয়াছিল কুমারী মাধবী? তাই তো?
ঠিক এই সময় সদানন্দ আর বিপিনের মধ্যে একটু কলহ হইয়া গেল। কত কলহ-বিবাদই আজ পর্যন্ত দুজনের মধ্যে হইয়াছে, কি তীব্র ঝঝ সে সব ঝগড়ার, মনে হইয়াছে জীবনে বুঝি আর দুজনের মধ্যে মিল হইবে না, কেহ কাহারো মুখ পর্যন্ত দৰ্শন করিবে না। কিন্তু কখন আবার বিনা ভূমিকায় দুজনে স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলিতে আরম্ভ করিয়াছে নিজেদেরই তাদের খেয়াল থাকে নাই। আজিকার কলহটা একেবারেই সে রকম হইল না। দুজন পুরুষের মধ্যে, বিশেষত বিপিন আর সদানন্দের মতো দুজন পুরুষ বন্ধুর মধ্যে এত মৃদু, এতখানি ভদ্রতাসম্মত কলহ হইতে পারে, এতদিন কে তা ভাবিতে পারিত।
বিপিন বলিল, ওটাকে নিয়ে বড় বাড়াবাড়ি করছিস সদা।
সদানন্দ বলিল, তুই তো সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি দেখি।
বিপিন বলিল, ওকে আশ্রমে এনেছি আমি।
সদানন্দ বলিল, তাই বলে ওর ওপরে তোর অধিকার জন্মেছে নাকি?
বিপিন বলিল, অধিকারের কথা নয়। ওর ভালোমন্দের একটা দায়িত্ব তো আমার আছে।
সদানন্দ বলিল, অঃ ভালোমন্দের দায়িত্ব।
তারপর বিপিন চলিয়া গেল নিজের ঘরে, সদানন্দ বসিয়া বসিয়া দেখিতে লাগিল নদী। এ কি কলহ? এ তো নিছক কথোপকথন, অলস মধ্যাহ্নের স্বাভাবিক আলাপ। কিন্তু নিজের ঘরে বসিয়া বিপিনের উপর সদানন্দের আর সদানন্দের উপর বিপিনের রাগে গা যেন জ্বলিয়া যাইতে লাগিল। একজন আরেকজনের কত অন্যায়, কত অবিচার, কত স্বার্থপরতা আজ পর্যন্ত সহিয়া আসিয়াছে, কিন্তু আর সত্যই সহ্য হয় না, একেবারে যেন পাইয়া বসিয়াছে।
সে দিন রাত্রে সত্যই জ্যোৎস্না উঠিল। আকাশে একেবারে যে মেঘ রহিল না তা নয়, বর্ষাকালের আকাশ তো। কিন্তু ছাড়া ছাড়া মেঘ আকাশে ভাসিয়া বেড়াইলেই তো জ্যোত্মার শোভা বাড়ে, অনেক দিনের বিশ্বাস এটা। রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর বিপিন বাহির হইয়া পড়িল, ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল আশ্রমের এক কুটির হইতে অন্য কুটিরে। যে কোনো সময় আশ্রম পরিদর্শনের অধিকার বিপিনের আছে। রাত্রির অসংখ্য বিচিত্র শব্দ আছে, কত তুচ্ছ অদৃশ্য প্রাণী শুধু শব্দের মধ্যে প্ৰাণের পরিচয় ঘোষণা করিয়া চলে, তবু দিনের চেয়ে রাত্রিতে স্তব্ধতা গভীরতর। দিবারাত্রি আশ্রমকে ঘিরিয়া যে নিবিড় শান্তি বিরাজ করে, বাহিরের তপ্ত মানুষকে যা কুড়াইয়া দেয় চোখের নিমেষে, রাত্রে যেন সেই শান্তির ভাব আরো বেশি অপার্থিব হইয়া ওঠে। চোখ জুড়াইয়া যায় বিপিনের চারিদিকে চোখ বুলাইয়া, মন ভরিয়া যায় মন-জুড়ানো আনন্দে, কোনো কোনো রাত্রে নিজেকে ভুলিয়া কয়েক মুহূর্তের জন্য স্বপ্ন পর্যন্ত যেন সে দেখিতে আরম্ভ করিয়া দেয়–অবাস্তব, অর্থহীন, কোমল, মধুর স্বপ্ন আদর্শের যে অবাধ্য, অপরিত্যাজ্য লেজুড়কে বিপিন ঘৃণাই করে চিরদিন।
আজ স্বপ্ন দেখা দূরে থাক, একটু গর্ব পর্যন্ত অনুভব করি না। নিজের ঘর হইতে বাহির হইয়া আশ্রমের ছড়ানো কুটির আর রহস্যময় ছায়ালোকবাসী নির্বাক নিশ্চল দৈত্যের মতো ছোট-বড় গাছগুলি দেখিয়া গভীর ক্ষোভের সঙ্গে তার শুধু মনে হইল কি অকৃতজ্ঞ সদানন্দ, কি স্বার্থপর সদানন্দ, কি বিশ্বাসঘাতক সদানন্দ। নিজে রাজ্য সৃষ্টি করিয়া নিজেকে বিসর্জন দিয়া সদানন্দকে রাজা করিয়াছে যে, আজ সদানন্দ তাকেই হীন মতলববাজ মানুষ মনে করিয়া তুচ্ছ করে। অন্যমনে বিপিন এক কুটিরের অধিবাসীদের সঙ্গে দুটি-একটি কথা বলিয়া অন্য কুটিরে চলিয়া যায়। কেহ শয়ন করিয়াছে, কেহ শয়নের আয়োজন করিতেছে, কেহ আসনে বসিয়া চিন্তাসাধনায় মগ্ন হইয়াছে, কেহ বারান্দায় বসিয়া করিতেছে মেঘের গতিতে চাঁদের গতি সৃষ্টির ভ্রান্তিকে উপভোগ।
উমা আর রাবলীর কুটিরের সামনে আসিয়া বিপিনের অন্যমনস্কতা ঘুচিয়া গেল। বারান্দার নিচে দাঁড়াইয়া আছে শশধর, বারান্দায় থাম ধরিয়া দাঁড়াইয়া তার সঙ্গে কথা বলিতেছে রত্নাবলী।
চিনিতে পারিয়াও বিপিন জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কে?
শশধর উৎসাহের সঙ্গে বলিল, আমায় চিনলেন না? সেই যে সেদিন–
রত্নাবলী সোজাসুজি বলিল, উনি মহেশবাবুর ভাগ্নে।
বিপিন বলিল, এত রাত্রে আপনি এখানে কি করছেন?
বিপিনের গলার সুরে শশধরের উৎসাহ নিভিয়া গিয়াছিল, সে আমতা আমতা করিয়া বলিল, মহেশবাবু বললেন কিনা
তার হইয়া রত্নাবলী কথাটা পরিষ্কার করিয়া বুঝাইয়া বলিল, মহেশবাবুর খুব অসুখ, এক শ চারে জ্বর উঠেছে; মাধবীকে একবার দেখবার জন্য বড় ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন। শশধরবাবু তাই বলতে এসেছেন, মাধবী যদি একবার যায়–
এত রাত্রে! দিনের বেলা বলতে এলেই হত।
বিপিনের আবির্ভাবেই রত্নাবলী যেন বিরক্ত হইয়াছিল, জেরা আরম্ভ করায় সে যেন রাগিয়া গেল, আপনি বুঝছেন না দিনের বেলা অতটা ব্যাকুল হন নি! এখন এত বেশি ছটফট করছেন যে, শশধরবাবু ভাবলেন, মাধবীকে যেতে বলে গেছেন, এ খরবটা জানালে হয়তো একটু শান্ত হবেন। তাই এখন বলতে এসেছেন। নইলে এত রাত্রে ওঁর আশ্রমে আসবার দরকার!
এত কথা এক সঙ্গে রত্নাবলী কোনোদিন বলে না। চাঁদের আলোতেও বোঝা যায়, রত্নাবলীর দাঁতগুলি কি ধবধবে। ব্যাপারটা বিপিনের একটু জটিল মনে হইতে লাগিল। মহেশ চৌধুরীর খুব অসুখ হইয়াছে, মাধবীকে দেখিবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছে, শুধু এই ব্যাপারটুকুই কম জটিল নয়। জগতে এত লোক থাকিতে মাধবীলতাকে দেখিবার জন্য ব্যাকুলতা কেন? কতটুকুই বা তার পরিচয় মাধবীর সঙ্গে! মাধবীলতাকে কথাটা জানাইতে এত রাত্রে আশ্রমে আসিয়া রত্নাবলীর সঙ্গে শশধরের গল্প জুড়িয়া দেওয়াটাও জটিল ব্যাপার বৈকি। উমা আর মাধবীলতার অনুপস্থিতির ব্যাপারটা আরো বেশি জটিল।