কি ভাবছিস ভাই?
ভাই? সদানন্দের সম্বোধনে বিপিনের তো রীতিমতো চমক লাগেই, মনে হয় যে সে বুঝি তাকে গাল দিয়া বসিয়াছে। এমন সম্পর্ক তো তাদের নয় যে এমন গভীর স্নেহার্ট সুরে ভাই বলিতে হইবে, এতখানি আবেগময় আন্তরিকতার সঙ্গে পরস্পরকে জানিয়া বুঝিয়া তাদের বন্ধুত্ব, পরস্পরের কাছে উলঙ্গ হইয়া দাঁড়াইতে যেমন তাদের লজ্জা করে না, মনের দুর্বলতা আর বিকৃতি মেলিয়া ধরিতেও তেমনি ভয় বা সঙ্কোচ হয় না, অন্তত কিছুকাল আগে তাই ছিল। এভাবে দরদ দেখানো তাদের মধ্যে চলিবে কেন? কি হইয়াছে সদানন্দের আজ, সাতদিন ঘরের কোণে কাটাইবার পর? বিপিন সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়, সে দৃষ্টির বিশ্লেষণপটুতা অসাধারণ। বিপিন উসখুস করে, সেটা তার শারীরিক অস্বস্তিবোধের চরম প্রমাণ।
তখন দুপুরবেলা, ঘণ্টা দুই আগে দুজনেরই মধ্যাহ্নভোজন হইয়াছে। অনেক ভাবিয়া, অনেক দ্বিধা করিয়া, মনকে শান্ত করিবার জন্য সাতদিন ঘরের কোণে নিজেকে বন্দি করিয়া রাখিয়া মনকে আরো বেশি অশান্ত করিয়া, অতিরিক্ত জ্বালাবোধর জন্যই মাধবীলতা সম্পর্কে অত্যাশ্চর্য আত্মসংযমের মধ্যে নিজেকে সত্য সত্যই মহাপুরুষ করিয়া ফেলিবার চরম সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করিয়াছিল। আজ সকালে হঠাৎ মাধবীলতাকে আজই রাত্রে ঘরে আনিবার জন্য নিমন্ত্ৰণ করিয়া বসিয়াছে। কে জানিত মাধবীলতাকে এমনভাবে সে নিমন্ত্ৰণ করিয়া বসিবে? সকালে নদীর ধারে বেড়াইতে বেড়াইতে চোখে পড়িল স্নানরতা রত্নাবলী আর উমাকে, তাই মাধবীলতাকে খুঁজিতে সে জোরে জোরে হটিতে আরম্ভ করিল আশ্রমের দিকে। মাধবীলতাকে দেখা গেল এক আমগাছের তলে। আশ্রমে যে গোয়ালা দুধ যোগায়, তার বৌয়ের সঙ্গে গল্প করিতেছে। গোয়ালা বৌয়ের কঁখের শিশুটি প্রাণপণে স্তন চুষিতেছিল, দুধের কারবার করে বটে, গোয়ালা-বৌ নিজের বুকে যে তার সন্তানের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে দুধ জন্মে না, দেখিলেই সেটা বোঝা যায়।
সদানন্দকে দেখিয়া গোয়ালা-বৌ সরিয়া গিয়াছিল।
রাত্রে একবার আমার ঘরে আসবে, মাধু?
আদেশ নয়, অনুরোধ। মাধবীলতা নয়, মাধবী নয়, মাধু। পরে দুপুরবেলা বিপিনকে ভাই বলার ভূমিকার মতো।
রাত্রে? কখন?
যখন তোমার সুবিধা হয়।
সন্ধেবেলা?
না, একটু রাত করে এস। এই এগারটা সাড়ে এগারটার সময়। অনুরোধ নয়, আদেশ। এতক্ষণে মাধবীলতা বুঝিতে পারিয়াছিল, আহ্বানটা খাঁটি অভিসারের, ধর্ষণের ফলে প্রেমের জন্ম হওয়ায় এতদিন যে পূর্বরাগের পালা চলিতেছিল, আজ তার সমাধি।
আজ নয়, পরশু যাব। একটা হাত বাড়াইয়া মাধবী আমগাছের গুঁড়িতে স্থাপন করিয়াছিল, যেখানে ছিল পিঁপড়াদের সারি বাঁধিয়া যাতায়াতের পথ।
না, আজ।
আদেশ নয়, প্রায় ধমক।
আজ নয়, পরশু।
মিনতি নয়, মৃদু কোমল নিরুপায় বিদ্রোহ।
সদানন্দ তখন অন্ধ আর বোকা হইয়া গিয়াছে কিনা, তাই ভাবিয়া চিন্তিয়া পাঁচ বছরের প্রিয়াকে লজেঞ্জসের লোভ দেখানোর মতো কোমলকণ্ঠে বলিয়াছিল, তুমি কিছু বোঝ না মাধু। আজ ত্ৰয়োদশী, মেঘটেঘ না করলে চমৎকার জ্যোৎস্না উঠবে, জ্যোৎস্নায় বসে তোমার সঙ্গে গল্প করব। এস কিন্তু।
পরশু কি জ্যোৎস্না উঠিবে না? পরশু কি জ্যোৎস্নায় বসিয়া গল্প করা চলিবে না? কিন্তু প্রতিবাদের যতটুকু শক্তি মাধবীর ছিল, এতক্ষণে প্রায় সবটুকুই শেষ হইয়া গিয়াছে। এবার যদি সদানন্দ রাগিয়া যায়? দুঃশাসন জানিয়াও যা বোঝে নাই, সদানন্দ কি না জানিয়া তা বুঝিবে! ত; মাধবী অন্যভাবে চেষ্টা করিয়াছিল।
উমা, শশী, কুন্দ, ওরা টের পাবে যে? একটা কেলেঙ্কারি হবে।
আমি সে ব্যবস্থা করব।
সদানন্দ নিজেই যখন ব্যবস্থা করিবে তখন আর কার কি বলিবার থাকিতে পারে? একটিবার। পশ্চিমে উঠিবার সাধ যদি সূর্যের থাকে, একমাত্র সদানন্দের হুকুমের সুযোগেই সাধটা মিটাইবার সম্ভাবনা কি তার সবচেয়ে বেশি নয়?
এইজন্য সদানন্দ আজ পেট ভরিয়া খাইতে পারে নাই। আহারে রুচি ছিল না। এখন। সদানন্দের তাই ক্ষুধা পাইয়াছে। এদিকে দাঁতের ব্যথা না থাকায় কদিন প্রায় উপবাস করিয়া থাকিবার শোধ তুলিবার জন্যই বোধহয় বিপিন এত বেশি খাইয়াছিল যে, এখন অম্বলে বুক। জ্বলিতেছে। নিজেকে বিপিনের বড়ই ভেতা মনে হইতেছিল। সদানন্দের আদরের জবাবে সে তাই বলিল ভাবছি তোর মাথা।
তারপর ঘরে আসিল মাধবী। ঘরে ঢুকিয়াই বিপিনকে সদানন্দের সঙ্গে দেখিয়া সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল।
সদানন্দ বলিল, কি মাধবী?
কিছু না, এমনি এসেছিলাম। বলিয়া বোকার মতো একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া মাধবী প্রায় চলিয়া যায়, সদানন্দ তাড়াতাড়ি উঠিয়া তার কাছে গেল।
–শোন মাধু, শোন।
কাছে গিয়া গলা নামাইয়া বলিল, কিছু বলবে? চল, বাইরে যাই।
দুজনে ঘরের বাইরে চলিয়া গেল, বিপিন ঘাড় বাকাইয়া বঁকা চোখে চাহিয়া রহিল খোলা দরজার দিকে।
মাধবীলতা বাহিরে আসিয়া মাথা নিচু করিয়া দাঁড়াইয়া থাকে, কথা বলে না।
সদানন্দ চিবুক ধরিয়া তার মুখখানা উঁচু করিয়া ধরে। এটা সদানন্দের যেন অভ্যাসে দাঁড়াইয়া গিয়াছে।
কি বলবে বল?
কি আর বলিবে মাধবী, সেই পুরাতন কথা আবার খানিকটা সাহস সঞ্চয় করিয়া আজ রাত্রির অভিসার পিছাইয়া দিবার জন্য অনুরোধ করিতে আসিয়াছে।
সদানন্দ জোর করিয়া মাধবীর মুখ উঁচু করিয়া রাখিয়াছিল, হঠাৎ হাত সরাইয়া দেওয়ায় মাধবীর চিবুক প্রায় কণ্ঠার সঙ্গে যুঁকিয়া গেল। কিন্তু সদানন্দের মন সত্যিই একটা চিন্তার সঙ্গে ঠোক্কর খাইয়াছে। কেন যে হঠাৎ সদানন্দের মনে হইল বড় পাকা মেয়ে মাধবীলতা, বড় ঝানু, প্রায় বাজারের বেশ্যার মতো। দেহটা যে বেশি-পাকা আমের মতো কোমল আর রঙিন মাধবীর, আদর করিয়া তাহার দেহে হাত বুলানোর সময় আঙুলগুলির যে পাখির পালকের মতো কোমল হইয়া যাওয়া উচিত, সদানন্দ তা জানে। কিন্তু মাধবীর ভিতরটা শুধু শক্ত নয়, পাথর। বোটা-ছেড়া ফলের মতো বছরের পর বছর ধরিয়া শুকাইয়া কুঁকড়াইয়া যাইতে পারিলে যেমন হইতে পারে, সেইরকম শক্ত, এই ধরনের একটা চিন্তা মনে আসায় সদানন্দের কাছে মাধবীর দেহটা পর্যন্ত রংচটা কাঠের খেলনার মতো কুৎসিত হইয়া গেল।