তারপর আবির্ভাব ঘটে বিপিনের। রাগ করিয়া লাভ নাই, সে তাই রাগ করে না, আশ্চর্য হইবার ভান করিয়া বলে, আপনি যান নি এখনো?
মহেশ চৌধুরী বলে, আজ্ঞে না। আপনাকে তো বলেছি, একবার প্রভুর চরণ দর্শন করতে না দিলে আমি উঠব না।
তা হলে সাতদিন আপনাকে এখানে থাকতে হবে।
তাই থাকব।
বিপিন একটু হাসিল, আপনার ভক্তিটা কিন্তু বড় খাপছাড়া চৌধুরী মশায়। প্রভুর আদেশ অমান্য করতে আপনার বাঁধবে না, প্রভুর চরণদর্শনের জন্য আপনি ব্যাকুল।
মহেশ চৌধুরী নিশ্চিন্তভাবে বলিলেন, ও আদেশ আমার জন্য নয়।
মাধবীলতা বলিল, না, সত্যি, উনি জানিয়েছেন, সাতদিন কেউ দর্শন পাবে না। সাতদিন উনি একমনে সাধনা করবেন কিনা।
আমি আড়াল থেকে একবার দর্শন করেই চলে আসব।
তা কি হয়?
সন্ধ্যা হইল, রাত্রি বাড়িতে লাগিল, মহেশ চৌধুরী গাছতলার মাটি কামড়াইয়া পড়িয়া রহিল। নিরীহ, শান্ত, ভীরু মানুষটা যে আসলে এমন একগুঁয়ে, সদানন্দ ছাড়া এতকাল আর কে তা জানিত। তাকে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টাও ব্যর্থ হইয়া গেল। মাধবীলতা আর রত্নাবলী কোনোরকমে তার স্ত্রীকে একটু দুধ খাওয়াইয়া শশধরকে ডাকিয়া নিয়া গেল আশ্রমের রাত্রির আহার্যের ব্যবস্থায় ভাগ বসাইতে। রাত্রে আশ্রমে রান্না হয় না, কিন্তু পেট ভরাইতে শশধরের অসুবিধা হইল না–দুধ, ছানা, মিষ্টি, ফলমূল এ সবের অভাব নাই। খাওয়ার পর সে আসিয়া আবার মামা-মামির কাছে বসিয়া রহিল গাছতলায়। রাত্রি দশটা পর্যন্ত আশ্রমের দু-এক জনকে সেখানে দেখা গেল, তারপর একজনও রহিল না। রাত্রি দশটার পর কারো কুটিরের বাহিরে থাকা বারণ বিপিন ও সদানন্দ ছাড়া।
রাত প্রায় এগারটার কাছাকাছি গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিও নামিল, ছাতি-মাথায় বিপিনও হাজির হইল গাছতলায়। দাতে ব্যর্থ হওয়ায় বিপিন গলা, মুখ, চোয়াল, কান, সমস্ত ঢাকিয়া সযত্নে কম্ফৰ্টার জড়াইয়াছে। ঠাণ্ডা লাগিলে তার দাঁতের ব্যথা বাড়ে। মুখের ঢাকা একটু সরাইয়া সে বলিল, আপনারা দাওয়ায় উঠে বসবেন, যান। মাদুর আর বালিশ দিচ্ছি। মহেশ চৌধুরী স্ত্রীকে বলিলেন, যাও না দাওয়ায়, যাও না তোমরা? বৃষ্টিতে ভিজে যে মারা পড়বে তুমি! যাও, দাওয়ায় যাও।
বিভূতির মা বলিল, আর তুমি?
এক কথা এক শ বার কেন বলছ? বললাম না প্রভুকে দর্শন করতে না দিলে আমি উঠব না এখান থেকে? তুমি এখানে বসে থেকে কি করবে, তাতে লাভটা কি হবে শুনি?
তুমি এখান থেকে না উঠলে আমিও উঠব না।
সন্ধ্যা হইতে এ বিষয়ে দুজনের মধ্যে অনেক তর্ক, রাগারাগি হইয়া গিয়াছে, মহেশ চৌধুরী আর কিছু বলিল না, কেবল শশধরকে হুকুম দিল দাওয়ায় গিয়া বসিতে। শশধর দাওয়াতে গেল, বিপিন মাদুর আর বালিশ আনিয়া দিলে তৎক্ষণাৎ মাদুর বিছাইয়া শুইয়াও পড়িল। আফসোস করিয়া বলিল, বর্ষাকালে এ কি ঠাণ্ডা মশায়, এ্যাঁ? এ কি শালার শীতকাল নাকি?
বিপিনের সহানুভূতি জাগিবার লক্ষণ নাই দেখিয়া গলা নামাইয়া আবার বলিল, বৌটা এসেছে কাল ছমাস বাপের বাড়ি ছিল। কি গরমটা কাল রাতে, তা বৌ বলে কিনা বাবু, বাদলার দিন ঠাণ্ডা লাগবে।–বলে—
আপনি বাড়ি ফিরে যান না?
শশধর উঠিয়া বলিল—আমিঃ মামি কাল বাড়ি ফিরেই কি করবে জানেন? কানটি ধরে বলবে, বেরো বাড়ি থেকে। কেবল আমাকে নয় মশায়, নিজের জন্য কি আমি ভাবি–বৌটাকে সুদ্ধ। গায়ে দেবার দিতে পারেন কিছু কাপড়চোপড় যা হোক?
বিপিন একটা চাদর আনিয়া দিল। কিন্তু বাদল রাতে সদানন্দের সদর দাওয়ায় চাদর মুড়ি দিয়া আরাম করিবার অদৃষ্ট বেচারির ছিল না। বিভূতির মা ডাকিয়া বলিল, ও শশী, ভদ্রলোকের
কাছ থেকে ছাতিটা চেয়ে রাখ, আর জিজ্ঞেস কর আরো যদি ছাতি থাকে একটা
একটা কেন, আরো তিনটা ছাতি ছিল, সবগুলি আনিয়া দাওয়ায় শশধরের কাছে ফেলিয়া বিপিন ভিতরে চলিয়া গেল। দাঁতের অসহ্য যন্ত্রণায় তার মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করিতেছিল, ইচ্ছা হইতেছিল মাটিতে শুইয়া হাত-পা ছুড়িতে থাকে, আর চিৎকার করিয়া কদে।
ছাতি নিয়া শশধর গাছতলায় গেল, একটি ছাতি খুলিয়া দিল মামির হাতে, আরেকটি ছাতি খুলিয়া মহেশ চৌধুরীকে দিতে গেলে সে বলিল না, আমার ছাতি চাই না।
স্ত্রী বলিল, কেন? এখেনে ধনে দিয়েছ, না খেয়ে বসে থাকবে, তা না হয় বুঝলাম বিষ্টি যখন পড়ছে, ছাতিটা মাথায় দিতে দোষ কি?
মহেশ চৌধুরী বলিল–নিজে থেকে আমি করব না।
তখন মহেশ চৌধুরীর স্ত্রী আবার এমনভাবে নিজের মরণের জন্য আফসোস আরম্ভ করিল যে, মনে হইল, আবার বুঝি আজ অপরাত্নের মতো বালার আঘাতে নিজের কপাল কাটিয়া রক্ত বাহির করিয়া ছাড়িবে। কিন্তু খানিক আফসোস করিয়া নিজের ছাতিটা বন্ধ করিয়া শশধরকে ফেরত দিল, বলিল, যা তুই, দাওয়ায় শো গে যা শশী।
শশধর একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, থাক, আমি বসে বসে ভিজি এখানে, আমিই বা বাদ যাব কেন।
তারপর মিনিট দুই সব চুপচাপ। এ অবস্থায় গাছের পাতায় বাতাসের মৃদু শো শো শব্দ আর গাছের পাতা হইতে জল ঝরিবার ক্ষীণ জলো জলো আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ কানে শোনাও পাপ। মনে অবশ্য অনেক কথা টগবগ করিয়া ফুটিতে থাকে এবং সেগুলি স্মৃতিও নয়।
সারাটা জীবন আমায় তুমি জ্বালিয়ে খেলে, আমার শনিগ্ৰহ তুমি। আমার সব ব্যাপারে তোমার বাহাদুরি করা চাই, হাঙ্গামা বাধানো চাই। যদি শান্তি পাবার জন্যে গাছতলায় ধন্না দিয়ে পড়ে থাকি, তোমার কি তাতে, কেন তুমি এসে আমার মন বিগড়ে দেবে, কে ডেকেছিল তোমায়? স্বামীভক্তি দেখানো হচ্ছে স্বামীর একটা কথা শুনবে না, স্বামীভক্তি দেখাতে গাছতলায় এসে ভেজা চাই। কি অদ্ভুত সতী রে আমার! স্বামীর শান্তি নষ্ট করে সতীত্ব ফলানো।