আপনি আমায় বলছিলেন না আশ্রমের উদ্দেশ্যের কথা, ভালো বুঝতে পারি নি। বিপিনবাবু ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
কি বলেছেন বিপিনবাবু?
কথা আর কথার ভঙ্গি মাধবীলতাকে একটু দমাইয়া দিল। সন্দিগ্ধভাবে বলিল, কিভাবে সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকা যায়, মানুষকে তাই বুঝিয়ে দেওয়া, ধর্মের মধ্যে যে বিকার এসেছে, সংশোধন করা, সমাজ-গঠনে–
হ্যাঁ, হ্যাঁ বুঝেছি। জীবন, ধর্ম, সমাজ, দেশ, এই সবের জন্য বড় বড় কাজ করা আশ্রমের উদ্দেশ্য।
এভাবে বলছেন যে? তাই উদ্দেশ্য নয় আশ্রমের?
আহা, চোখ দুটি ছলছল করে মাধবীলতার। আঘাত পাইবে জানিয়া টসটস করিয়া জল ঝরানোর জন্য চোখ দুটিকে যেন প্ৰস্তুত করিয়া নিতেছে। হঠাৎ একটা তীব্র সন্দেহের স্পর্শে সদানন্দের মন হাত দিয়া আগুন হেঁয়ার মতো ছাৎ ছাৎ করিয়া ওঠে। মনে হয়, মাধবীলতা যেন ভান করিতেছে। বোকামির ভান, সরল বিশ্বাসের ভান, শব্দ সংজ্ঞাগুলির অর্থ না বুঝিয়াও তৎসংক্রান্ত চিরন্তন আদর্শবাদের যে অসংখ্য পূজারিণী আছে, সেও তাদেরই একজন–
অথবা তার নিজেরই ভুল? যেটা মাধবীর ভান মনে হইতেছে, মাধবী আসলে তাই, সে নিজেই মাধবীলতা সম্বন্ধে একটা ভুল ধারণা সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছে? মাধবী প্রশ্নভরা শঙ্কিত দৃষ্টিতে চাহিয়া আছে দেখিয়া সে বলিল, মোটামুটি তাই। একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে আশ্রমের, এখানে কিছুদিন থাকলেই আস্তে আস্তে সেটা বুঝতে পারবে। আরেকদিন তোমাকে ভালো করে বুঝিয়ে দেব।
মাধবীর স্বস্তি ও কৃতজ্ঞতাবোধ অত্যন্ত স্পষ্ট। নিজের অস্বস্তি ও দুর্বোধ্য জ্বালাবোধ সদানন্দকে পীড়া দিতে থাকে। সে চিৎ হইয়া শুইয়া পড়ে। মাধবীলতা সম্বন্ধে সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছিল সে, সে-ই করিয়া দিয়াছিল তার আশ্রমবাসের ব্যবস্থা। মাধবী অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিল, মন খারাপ হইয়া গিয়াছিল মাধবীর, রাত্রে ঘুম হইতেছিল না। চোখের পলকে বিপিন তার জীবনকে সহজ ও সানন্দ করিয়া দিয়াছে। আশ্রমের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের কথা কতবার সদানন্দ বলিয়াছে মাধবীকে, বুঝিতে না পারিয়া মনে মনে কাতর হইয়া পড়িয়াছে মাধবী। বিপিন দু কথায় সব তাকে বুঝাইয়া দিয়াছে, হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিয়াছে মাধবী।
পা টিপে দেব?
সদানন্দের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাতে মাধবীর ঔৎসুক্য মুছিয়া যায়, চোখ নামাইয়া জড়োসড়ো হইয়া সে। বসে। প্রথমে এখানে আসিয়া শেষরাত্রে সদানন্দের পিঠের সঙ্গে মিলিয়া যেভাবে কুণ্ডলী পাকাইয়া শুইয়াছিল, লজ্জায় সঙ্কোচে যেন তেমনি কুণ্ডলী পাকাইয়া যাইবে। কৈফিয়ত দেওয়ার মতো ভয়ে নিজে হইতে সে বলে, বিপিনবাবু বলছিলেন, আপনার একটু সেবা করতে। আপনি নাকি কারো সেবা যত্ন নেন না, বড় কষ্ট হয় আপনার।
না, পা টিপতে হবে না। বৃষ্টি আসছে, তুমি এবার যাও মাধবী।
আহত হইয়া মাধবী চলিয়া যায়। রাগে সদানন্দের গা জ্বালা করিতে থাকে। মাধবীকে এ কি করিয়া দিয়াছে বিপিন; নিজে আড়ালে থাকিয়া এ কি সম্পর্ক সে গড়িয়া তুলিতেছে তার আর মাধবীর মধ্যে? বিপিনের সঙ্গে কথা বলিবার সময় কত হাসে মাধবী, আশ্রমের জীবন নাকি তার হাল্কা হাসিখুশিতে ভরিয়া উঠিয়াছে, অজস্র কথা বলে, মনের আনন্দে চঞ্চলপদে ঘুরিয়া বেড়ায়, কাজের ফাঁকে ফাঁকে গুনগুন করিয়া গানও নাকি শোনা যায় তার সময় সময়। প্রথম প্রথম সদানন্দের কাছেও তো প্রায় এই রকমই ছিল মাধবী, আকস্মিক অবস্থা পরিবর্তনের ধাক্কায় একটু যা কেবল হইয়া পড়িয়াছিল কাবু। এখন সামনে পড়িলে মনোভাবের সবগুলি উৎসমুখে সে তাড়াতাড়ি ছিপি আঁটিয়া দেয়, খোলা রাখে কেবল সভয় শ্রদ্ধাভক্তির উৎসটা, আর–
এইখানে একটু খটকা লাগে সদানন্দের। আর কি? আর কি উথলাইয়া পড়ে তার সান্নিধ্যগত মাধবীর সর্বাঙ্গীণ অস্তিত্ব হইতে? পরিণত নারীর সেবা ও স্নেহের সাধ? কিন্তু সেটা কেমন হয়। সেই সহজ ও সাধারণ সাধটা তাকে কেন্দ্ৰ করিয়া মাধবীর মধ্যে যদি অস্বাভাবিকরকম জোরালো হইয়া উঠিয়াও থাকে, এইভাবে কি তা আত্মপ্রকাশ করে, এমন দুর্বোধ্য ও রহস্যময় প্রণালীতে? সর্বদা যেন আত্মসচেতন মাধবী, সর্বদা সংযত গভীর দীনভাবে সর্বাঙ্গে তার একটানা ছেদহীন রোমাঞ্চ।
বৃষ্টি নামি নামি করিয়া বহুক্ষণ আকাশে আটকাইয়াছিল। হয়তো শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি আজ নামিবেই না। একবার ডাকিয়া পাঠাইলে কেমন হয় মাধবীকে, একটু সেবা করিবার অনুমতি দিলে? কোমরে আঁচল জড়াইয়া হয়তো মাধবী কুটিরের মেঝে বঁট দিতেছে–শাড়ি, সেমি এলোমেলো, চুল এলোমেলো, কথা এলোমেলো, হাসি এলোমেলো। ডাক পৌঁছিলে হাত ধুইয়া কোমরে বাধা আঁচল খুলিবে, চুলটা তাড়াতাড়ি ঠিক করিয়া লইবে, কথা ও হাসি দিবে বন্ধ করিয়া। তার সেই হিলতোলা জুতাটি পায়ে দিয়া এই উঠান পর্যন্ত আসিবে তাড়াতাড়ি–ঠকঠক শব্দ স্পষ্ট কানে আসিবে সদানন্দের। তারপর জুতা শাড়িটা এখানে ওখানে একটু টানিয়া, দুহাতে কপাল হইতে আলগা চুল কয়েকটি শেষবারের মতো উপরের দিকে ঠেলিয়া তুলিয়া ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকিয়া বলিবে, ডাকছিলেন?
সদানন্দ উঠিয়া অন্দরে গেল। অন্দরে কেউ নাই। সদরে গিয়া দাঁড়াইতে চোখে পড়িল, কিছুদূরে ছোট ফুলের বাগানটিতে আশ্রমের কয়েকটি মেয়ে ফুল তুলিতেছে। তাদের একজন মাধবী। তাই তো বটে, বিশ-বাইশ বছর আগে একজনকে কোমরে আঁচল জড়াইয়া ঘর ঝট দিতে দেখিয়াছিল বলিয়া মাধবীকেও যে ঘরই ঝাঁট দিতে হইবে তার কি মানে আছে!