আমি থতমত খেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঘর ঝাঁট দেওয়ার কথা কাকে বলছে? কে ঝট দেবে? আমার বাড়িতে তো আর কেউ নেই যে ঘর ঝাঁট দেবে? বুঝলাম নকুলের মাথাটা এখনও পরিষ্কার হয়নি। সে কথা চেপে গিয়ে বললাম, কেন? কী হয়েছে? আবার মেঝে খুঁড়ে মাটি তুলছে?
এর আগেও নকুল এই অভিযোগ করেছিল। আমি গুরুত্ব দিইনি। আজ ভাবলাম, এ তো অদ্ভুত কথা। সিমেন্টের মেঝে। ঘরে এমন অপ্রয়োজনীয় জিনিসের জঞ্জাল নেই যে ইঁদুরের বাসা হবে। তা হলে?
চলো তো দেখি।
আমার এ কথায় নকুল খুব উৎসাহ পেল। আমার সামনে সামনে বীরদর্পে এগিয়ে চলল।
ওর ঘরে ঢুকে ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম টাটকা তোলা মাটি নয়। বেশ কিছুদিন আগে উঠেছে। তারপর কিছুদিন মাটিতে পড়ে থেকে থেকে কেমন ভিজে ভিজে ঠেকছে। আমি তখন নিজেই একটা ঝাঁটা দিয়ে মাটিগুলো সরিয়ে দিলাম। কিন্তু ইঁদুর কেন পিঁপড়ের গর্তও দেখা গেল না। তখন বুঝলাম মাটিগুলো কোনোদিন উপর থেকে ঝুর ঝুর করে পড়েছে। যেমন পুরোনো বাড়িতে দেওয়াল বা কড়িবরগার পাশ থেকে চুন-বালি খসে পড়ে। এতক্ষণে যেন ব্যাপারটার একটা মানে খুঁজে পেলাম। যদিও একবার মাথা উঁচু করে তাকিয়ে কোনো খসে যাওয়া চুন-বালির চিহ্ন দেখতে পেলাম না।
একে তো ভাবনার অন্ত ছিল না। কে ঐ অশরীরী আত্মাটি? আমার ওপর কেন তার এত রাগ? কী চায় আমার কাছে? বেচারি নকুল এমন কী অপরাধ করল যে, রাতদুপুরে তার জানলা দিয়ে ঢুকে তাকে মেরে দিতে গিয়েছিল! এখন আবার নতুন ভাবনা জুটল হঠাৎ মেঝেতে মাটি এল কোথা থেকে? একবার নয়, কয়েকবার। পাদ্রীবাবার কাছে যাব কি যাব না ভাবতে ভাবতেই দিন চলে যায়।
এমন সময়ে তার কাছে যাবার একটা উপলক্ষ এসে গেল।
জগদীশ অ্যান্টনি প্রতিদিন যখন মিশনে পুরোনো চার্চের দিকে যান তখন পথে আমার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়ে যায়। কিন্তু কথা হয় না। সেদিন দেখা হতেই উনি বললেন, এই যে বাবাজীবন, রোজই ভাবি বলব, কিন্তু খেয়াল থাকে না।
আমি নম্র গলায় বললাম, আমি কি আপনার বাড়িতে যাব?
হ্যাঁ বাবা, তা তো যাবেই। তবে একটা বই-এর খোঁজ করছি। পাচ্ছি না। তুমি যদি পার
কী বই বলুন।
উনি যে বই-এর নাম বললেন তা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। মনে মনে ভবলাম, এ বই আজ কোথায় পাব?
তবু তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললাম, খুঁজে দেখব। যদি থাকে–
তাই দেখো। বড্ড দরকার হচ্ছে। মানে নিতান্তই কৌতূহল। পাও ভালোই। না পাও তবু এসো। তোমাদের মতো আধুনিক মনের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলেও আনন্দ।
এই এক নতুন হাঙ্গামা। উনি ভ্যামপায়ারের ওপর বই খুঁজছেন। সে বই এখানে কোথায় পাব? মনে পড়ল ক্লাস নাইন-টেনে পড়বার সময় প্রথম পড়েছিলাম ভ্যামপায়ার বা রক্তচোষা বাদুড়ের কথা। বইটা জন্মদিনে উপহার পেয়েছিলাম। খুঁজে দেখব যদি পুরোনো আলমারিতে কোথাও থাকে।
দুদিন পর বইটা পেয়ে বেশ উৎসাহ সহকারেই ওঁর কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা দেখে উনি এমন ভাবে হেসে উঠলেন যে লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে গেল। বললেন, এ তো ভ্যামপায়ার নিয়ে কিশোর-পাঠ্য গল্পের বই। এ বই নিয়ে কী করব? আমি চাই ভ্যামপায়ারের ওপর তথ্য।
হঠাৎ ভ্যামপায়ার নিয়ে ভাবনা-চিন্তা মাথায় চাপল কেন জিগ্যেস করতে গিয়েও সাহস পেলাম না। শেযে উনি নিজেই বললেন, তুমি অবশ্য ভূত-প্রেত-অশরীরী আত্মায় বিশ্বাসী নও। ও সব নিয়ে মাথা ঘামাও না। তবু বলছি, সময়ের পরিবর্তনে ভূত-প্রেতদের ঠিকুজি কুষ্ঠিও বদলে যাচ্ছে। আগে এদের দেখা যেত শ্মশানে, কবরখানায়। কখনও আসশ্যাওড়া গাছে পা ঝুলিয়ে বসে থাকত কিম্বা পোড়ো বাড়ির ন্যাড়া আলসেতে শুয়ে শুয়ে নিশাচর পাখি ধরে চিবোত। তারপর দ্যাখো, আগে স্কন্ধকাটা, কবন্ধভূত, ব্রহ্মদত্যি, শাঁকচুন্নি, গেছোভূত, মেছোভূত কত কী ছিল। এখন তারা পাততাড়ি গুটিয়েছে। তার বদলে দেখা দিয়েছে কালো বেড়াল, মরা বাঁদরের পা, কুকুর প্রভৃতি। কিন্তু বাদুড় কোন গুণে বেশির ভাগ ভূতের কাহিনিতে জায়গা করে নিল সেটাই জানতে ইচ্ছা করে। সেইজন্যে রক্তচোষা বাদুড়ের ওপর লেখা বই পড়ে দেখতে চাই। বুঝতেই পাচ্ছ, বাদুড় যদি ভূত হতে পারে, তাহলে চিল শকুন কাক ইঁদুর ছুঁচোর ভূত হতে বাধা কী?
ওঁর এই শেষের কথাগুলোয় হঠাৎ আমি এমনই চমকে উঠলাম যে পাদ্রীবাবার কাছে ঘটা করে বিদায় না চেয়েই হঠাৎ উঠে পড়লাম।
আজ যাই। বলেই বেরিয়ে পড়লাম। সারা পথ শুধু একটি কথাই মনে হতে লাগল– তাহলে সত্যিই কি বেড়াল, বাদুড়ের মতো চিল, শকুন, কাকের মধ্যে দিয়েও প্রেতাত্মার আবির্ভাব হতে পারে? আর তাই যদি হয়
হঠাৎ যেন একটা জটিল সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। তাতে যেমন সাময়িকভাবে স্বস্তি পেলাম, তেমনি নতুন ভয় শুরু হল। ইঁদুর দেখা যায় না, ইঁদুরের গর্তও চোখে পড়ে না। অথচ মাটি পড়ে থাকছে। কে তুলছে এই মাটি? কোথা থেকে তুলছে? যে-ই তুলুক সে। যে ঠিক সাধারণ কোনো প্রাণী নয়, জগদীশ অ্যান্টনির মুখের আগা একটি কথাতেই তা পরিষ্কার হয়ে গেল। ইঁদুরও তা হলে ভূত হতে পারে।
লোকে শুনলে হাসবে কিন্তু এ ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না, পরের দিনই আমি মিস্ত্রি লাগিয়ে বেডরুম, কিচেন, দালান–সর্বত্র মেঝে খুঁড়িয়ে নতুন করে সিমেন্ট করে নিলাম। যাতে দৃশ্যই হোক আর অদৃশ্যই হোক ইঁদুরের লেজটুকুও দেখা না যায়।