কী মনে হল, কেন মনে হল জানি না, আমি সামনের রাস্তা ছেড়ে পিছনের দিকের র্থাৎ উত্তর দিকের রাস্তা ধরলাম। আমার হাতে একটা লাঠিও নেই। তবু নকুলকে বাঁচাতেই হবে। আমার জন্যে ওকে মরতে দেব না। কিন্তু এই নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে কোথায় খুঁজব ওকে? ও তো সেই অশরীরীর পিছনে উন্মাদের মতো ছুটেছে।
আমিও ছুটতে লাগলাম। এই গভীর রাত্রে কেমন এক শিরশিরে বাতাস বইছে। সে বাতাস যেন পৃথিবীর বাতাস নয়। আমি দুহাত দিয়ে গা আগলে ধরলাম–যেন বাতাসটা সহ্য করতে পারছিলাম না। ছুটতে ছুটতে পুকুরধারে এসে পড়লাম।
এই রকম গভীর রাতে কোনোদিন এই পুকুরের দিকে আসিনি। আসতে সাহস হয়নি। দুর্নাম আছে পুকুরটার। গভীর রাতে এখানে এলে নাকি দেখতে পাওয়া যায় কেউ যেন মাঝ পুকুরে ডুবছে আর উঠছে। অনেকেই পুকুরের মাঝখানে জল তোলপাড় করার শব্দ শুনেছে। কিন্তু কিছু দেখতে পায়নি। ঝুপ করে কে যেন ডুব দিল। তারপর শুধু খানিকটা জল হুস করে উঠল। ব্যস্ এই পর্যন্ত। ও নাকি দেখা যায় না। আমার সৌভাগ্য এদিন ওরকম কোনো শব্দ শুনতে পাইনি। কিছু দেখতেও পাইনি। তবু যা দেখেছিলাম তাই যথেষ্ট।
পুকুরের পাড়ে মানুষের মতো কী যেন পড়ে আছে। ছুটে গেলাম। দেখি নকুল উবুড় হয়ে পড়ে আছে। মাথার কাছে লাঠিটা পড়ে আছে ভাঙা। হুমড়ি খেয়ে ওর বুকে মাথা রেখে বুঝলাম এখনও বেঁচে আছে।
.
০৩.
আমার সৌভাগ্য যে নকুল সে যাত্রায় বেঁচে গেল। কিন্তু উঠে দাঁড়াতে সময় নিল পাক্কা একটি মাস।
তারপর আস্তে আস্তে সুস্থ হল বটে কিন্তু সে রাত্রের ঘটনা কিছুই মনে করতে পারত না। এমন কি অবাক হয়ে আমার কাছে জানতে চাইত অত রাতে পুকুরপাড়ে গেলাম কেন? কী করেই বা গেলাম? আমি অনেক ভাবে প্রকৃত ঘটনাটা মনে করাতে চেষ্টা করেছি কিন্তু ওর কিছুই মনে পড়ত না। বললাম, সে রাতে তুমি বিছানায় না শুয়ে আলমারির পিছনে লুকিয়েছিলে। তুমি কী করে বুঝতে পেরেছিলে সে রাত্রেই এরকম ঘটনা ঘটবে?
ও শুধু কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। তারপর অন্য দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, জানি না।
বললাম, তুমি যে সেই ছায়ামূর্তির পিছু পিছ তাড়া করে গিয়েছিলে তাও কি মনে করতে পারছ না?
ও শুধু মাথা নেড়ে বলল, না। সব অন্ধকার, দাদা। আমি আর বসে থাকতে পারছি না। ঘুম আসছে।
আমি তখনই ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আমার ঘরে চলে এসেছিলাম। ভাবলাম এই বেলা এগারোটায় ঘুম! তাহলে সুস্থ হল কই?
কিন্তু কী হচ্ছে এইসব? এখন নিশ্চিত হয়েছি–এতদিন যা দেখেছি তা মিথ্যে নয়। কিছু একটা আছেই। সেই অপার্থিব বস্তুটাকে আমি ছাড়া আরও একজন দেখেছে। কিন্তু কে এই ছায়ামূর্তিটা? কেনই বা আমার ঘরেই হানা দেয়? আমার সাঁইত্রিশ বছর বয়েস পূর্ণ হবার সঙ্গে তার কি সত্যিই কোনো সম্পর্ক আছে?
এই জন্যেই অনেক হিসেব-নিকেশ করে মৃতদের একটা তালিকা করতে আরম্ভ করেছিলাম। কাজটা শেষ করা হয়নি। এবার দেখছি আবার এটা নিয়ে বসতে হবে।
ভেবেছিলাম যিনি মাঝে-মধ্যে আসছিলেন তিনি হঠাৎ বেশ কিছুদিন আসা বন্ধ করেছিলেন। আবার আসছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এখন তার আক্রমণের লক্ষ্যস্থল আমি নই, নকুল। বেচারি নকুল। সে তো সবে এসেছে। এরই মধ্যে কীভাবে জড়িয়ে গেল আমার জীবনের সঙ্গে যার ফলে সেও অশরীরী ক্রুদ্ধ আত্মাটির আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠল!
আত্মাটি তার ওপর এতই ক্রুদ্ধ যে তাকে খুন করতে পর্যন্ত তার ঘরে ঢুকেছিল। এর কারণ কী?
কোন অলৌকিকতার প্রভাবে নকুলকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নির্জন পুকুরের পাড়ে? কে ভাঙল তার মজবুত লাঠিটা? কেনই বা অচৈতন্য হয়ে পড়ল নকুল? আর কীসের প্রভাবে সে তার স্মৃতি হারিয়ে ফেলল! ঐ রাত্রির ঘটনা যেন নকুলের মন থেকে একেবারে মুছে গেছে।
এসবই আমাকে আবার ভাবিয়ে তুলল। যতই ভাবি কোনো কূলকিনারা পাই না। অথচ এ এমন ব্যাপার যে লোক ডেকে বলা যায় না। কারণ, এমন কোনো প্রমাণ দেখাতে পারব না যা দিয়ে বিশ্বাস করাতে পারব–এমন কি নকুলের ভাঙা লাঠিটাও অবিশ্বাসীদের কাছে তেমন জোরদার প্রমাণ বলে গণ্য হবে না। অথচ এখন মনে হচ্ছে সব ঘটনা জানিয়ে পরামর্শ নেবার একজন বিশ্বস্ত লোক চাই।
চাই তো বটে কিন্তু পাই কোথায়?
তখন মনে পড়ল পাড়াতেই তো থাকেন পাদ্রী জগদীশ অ্যান্টনি। বয়েস হয়েছে। শান্ত স্বভাবের ভদ্রলোক। কারও সাতে-পাঁচে থাকেন না। উনি নাকি এই সব আত্মা-টাত্মার বিষয় বোঝেন। এ নিয়ে গোপনে ক্রিয়াকলাপ করেন কিনা জানি না। তবে পড়াশোনা করেন। শুনেছি ওঁর সিন্দুকে নাকি রোমান হরফে লেখা দুষ্প্রাপ্য প্রেতের বই আছে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সেই বই ব্যবহার করেন গোপনে।
ওঁর কাছেই যাব ভাবলাম। তবু যাব-যাব করেও যেতে উৎসাহ পেলাম না। কারণ আমার মতো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন কী করে তার কাছে গিয়ে বলবে, আমার বাড়িতে দুষ্ট আত্মার আবির্ভাব হয়েছে। হে পাদ্রী মশাই, আপনি বিধান দিন কী করে তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাব।
না, অসম্ভব। এ আমি পারব না। অতএব পাদ্রী-মশাইয়ের কাছে আর যাওয়া হল না। ভাবলাম আর কিছুদিন দেখাই যাক না।
এই কিছুদিনের মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটে গেল। নকুলের স্মৃতি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা যখন মাইনাস করে দিয়েছিলাম তখনই নকুল একদিন সকালবেলা গজগজ করতে করতে এসে বলল, দাদা, আমি না হয় বেশ কিছুদিন ঘর ঝাট দিতে পারিনি, তাই বলে কেউ ঝট দেবে না?