ও যেন দমকা কাশির মতো বলে উঠল, দাদা, এ বাড়িটা খারাপ।
আমি চমকে উঠলাম। ও-ও কি তাহলে কিছু দেখেছে? সামলে নিয়ে বললাম, মানে?
ও নানাভাবে বোঝাতে চাইল যে, ও নাকি প্রায় সন্ধেবেলায় কাউকে ভেতর-বারান্দায় চলে বেড়াতে দেখে। যে চলে বেড়ায় তাকে ডাকলে সাড়া দেয় না। আলো নিয়ে গেলেও দেখা যায় না। নকুল নিশ্চিত যে, দেখা না গেলেও বুঝতে পারে কেউ একজন আশেপাশে রয়েছে।
সর্বনেশে কথা। আমি ভয় পেলাম। বুঝলাম আগে যাকে দেখতাম সে তাহলে যায়নি। এখানেই আছে। ইদানিং আমায় দেখা দেয়নি।
ভয় পেলাম ঠিকই। কিন্তু নকুলের কাছে তা প্রকাশ করলাম না। একটু হেসে বললাম, তাই বুঝি?
উত্তরে নকুল তার বাঁ হাতের তালুতে ঘুষি মেরে আমায় বলল, আমায় ভয় দেখানো? আমি কিন্তু ছাড়ব না। এবার দেখা পেলে জাপটে ধরবই।
ব্যস্ত হয়ে বললাম, ও সব করতে যেও না। কী থেকে কী বিপদ ঘটে যায় তা বলা হায় না। যাকে মনে করছ আছে সে থাকুক না। সে তো ক্ষতি করছে না।
কী যে বলেন দাদা! রোজ দেখছি সন্ধে হলেই গোটা বারান্দায় দাপিয়ে বেড়ায়। সে। কি শুধু শুধু? ও আপনার ক্ষতি করবার মতলবেই এখানে আসে। হয়তো ঠিকমতো সুযোগ পাচ্ছে না। আপনি কিন্তু দাদা সাবধান হবেন।
মুখে হাসি টেনে বললাম, কী ভাবে সাবধান হব বলো?
নকুল বলল, আপনি বাড়িতেও একা থাকবেন না। আমাকে ডাকবেন। প্রেতাত্মাই হোক আর যাই হোক আমি একাই শায়েস্তা করে দেব। এই বলে ও বীরদর্পে ভেতরে চলে গেল।
মহা সংকটে পড়লাম। প্রেতাত্মাটি আবার বাড়ির মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভেবেছিলাম তিনি যেমন এসেছিলেন, আবার চলেও গেছেন। ভেবে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম, কিন্তু এখন তো দেখছি নিশ্চিন্ত হবার উপায় নেই। যদিও আমার কাছে আসেননি কিন্তু নকুলকে তো দেখা দিচ্ছেন। উদ্দেশ্যটা কী? তবে কি আমার সাঁইত্রিশ বছর বয়স পূর্ণ হতে যাচ্ছে বলেই
সেদিন দেখলাম বাজার থেকে একটা মোটা লাঠি নিয়ে এসেছে। বললাম, লাঠি দিয়ে কী হবে?
ও বলল, একটা লাঠি বা বল্লম থাকা দরকার। কখন কী দরকার পড়ে
বুঝলাম দরকার তো একটাই। কিন্তু লাটি দিয়ে কি প্রেতাত্মা তাড়ানো যাবে? তা অবশ্য যাবে না কিন্তু এ অবস্থায় কী যে করি! কার পরামর্শ নিই তখনই ভেবে পেলাম না। দেখাই যাক না আর কোনো ঘটনা ঘটে কিনা–ভাবতে ভাবতেই কদিন কেটে গেল।
তারপর সেদিন–
রাত তখন ঠিক কত জানি না। ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার পরও অনেকক্ষণ বুঝতে পারলাম না ঘুমটা কেন ভাঙল। আমার ঘরের উত্তর দিকের জানলাটা খোলাই ছিল। ওদিকে একটা বড়ো পুকুর। পুকুরের ওপারে ঘন ঝোপঝাড়। তার পিছনে বড়ো বড়ো দেবদারু গাছ। শুক্লপক্ষের বোধহয় ত্রয়োদশী। ফ্যাকাশে জ্যোৎস্না এসে পড়েছে পুকুরপাড়ের সুপুরি গাছটার পাতায়। বাতাস নেই তবু পাতাগুলো অল্প অল্প নড়ছে ঠিক যেমন মফঃস্বলে মড়া নিয়ে যাবার সময় চালিতে শোওয়ানো মৃতের মাথাটা নড়ে এদিক-ওদিক। সুপুরি গাছটার দিকে তাকিয়ে আমার গা-টা কেমন ঘুলিয়ে উঠল। এ তো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, অন্য কিছু।
এমনি সময়ে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পেলাম। নকুল আমার পাশের ঘরে শোয়। সেই ঘর থেকেই শব্দটা এল। নকুল কি ঘর থেকে বেরোচ্ছে? কিন্তু অত চুপি চুপি কেন?
নকুলের ঘরের দিকে খড়খড়িওলা একটা জানলা ছিল। জানলাটা বন্ধই থাকত। খোলার দরকার হত না। আমি ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম জানলাটার দিকে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে সাবধানে খড়খড়িটা একটুখানি ফাঁক করলাম। ঘরের ভেতর গাঢ় অন্ধকার। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলাম না। তারপর চোখ দুটো সয়ে গেলে কিছু যেন দেখতে পেলাম। কেউ যেন অন্ধকারে নড়ছে।
কী আশ্চর্য! যে নড়ছে সে যদি নকুলই হয় তাহলে সে তো দরজার দিকে যাবে। কিন্তু এখানে চলমান বস্তুটি দরজার দিক থেকে নকুলের বিছানার দিকে যাচ্ছে। …এর মানে কী? কে যাচ্ছে অন্ধকারে গা মিলিয়ে? কোনো চোর? ডাকাত? খুনে?
সে খুব সাবধানে এক পা ফেলছে আর শব্দ হচ্ছে খট। আবার এক পা এগোচ্ছে অমনি শব্দ খট খট্–
এ কি মানুষের হাঁটার শব্দ? এ তো হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি! কিছু ভাববার আগেই একটা কাণ্ড ঘটে গেল।
ছায়ামূর্তিটা শূন্যে দুপা তুলে দুহাত লম্বা করে যেন প্রচণ্ড আক্রোশে জলে ডাইভ দেবার মতো নকুলের বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে–আমি হুঁশিয়ার করে দেবার জন্যে চেঁচিয়ে উঠলাম–ন-কু-ল–
সঙ্গে সঙ্গে একটা আলমারির পেছন থেকে উদ্যত লাঠি হাতে যে ত্বরিত গতিতে এগিয়ে এল সে যে নকুল তা বুঝতে বাকি রইল না।
মাত্র দু-তিন মুহূর্তের মধ্যে ঘটনাটা ঘটে গেল। ছায়ামূর্তি দুহাত আরও লম্বা করে শূন্য বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়তেই নকুল সজোরে তার পিঠে লাঠি দিয়ে মারল। অবাক কাণ্ড
মোটরের টায়ার বাস্ট করলে যেমন শব্দ করে বাতাসটা বেরিয়ে গিয়ে টায়ারটা চুপসে পড়ে থাকে তেমনি একটা শব্দ করে কালো আলখাল্লার মতো কী যেন একটা বিছানায় পড়ল। তার পরক্ষণেই সেই পরিত্যক্ত বস্তুটা শূন্যে ভাসতে ভাসতে সরু হয়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে নকুলও পিছন পিছন ছুটল।
আমি ফের চেঁচিয়ে উঠলাম, নকুল–যেও না
নকুল সাড়া দিল না–ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। আমিও দেরি না করে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সুইচ টিপে আলো জ্বালোম। পাশেই নকুলের ঘর হাট করে খোলা। আমিও ছুটলাম। কিন্তু কোন দিকে যাব?