বললাম, টাকা তিনটে তুমি রাখো।
ও যেন কৃতার্থ হল। টাকা তিনটে তুলে নিয়ে হঠাৎ আমায় প্রণাম করল। বলল, আপনার এই দয়া যতদিন বাঁচব ততদিন মনে রাখব। বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। জিগ্যেস করলাম, কোথায় যাবে এখন?
জানি না স্যার। এ বেলা যা খেয়েছি তাতে দুদিন না খেলেও চলবে। আর শোওয়া? রাস্তার ধারে খোলা রক তো কতই পড়ে রয়েছে।
চলে যাচ্ছিল, ডাকলাম, শোনো।
ও ফিরে দাঁড়াল।
তুমি আমার কাছে থাকবে?
ও কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর অস্ফুটস্বরে বলল, আমায় বলছেন, স্যার?
হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি।
ও তবু যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। বলল, আমি এই বাড়িতে থাকব! দুবেলা খেতে পাব?
হেসে বললাম, হ্যাঁ, তাই।
আমায় কী করতে হবে?
কিচ্ছু না। তুমি চা করতে পার?
তা আর পারি না? কত চায়ের দোকনে তো কাজ করলাম।
তাহলে তো ভালোই। তোমার কাজ হবে আমার সঙ্গে গল্প করা। আর মাঝে মাঝে চা করে খাওয়ানো। আর একটা কাজ–আমার কিছু ধানজমি আছে। সাইকেল আছে। মাঝে মাঝে গিয়ে একটু দেখাশোনা করা।
নকুল এবার আর কোনো কথা বলতে পারল না। হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো আনন্দে একটা পাক খেয়ে নিল। সেই থেকে নকুল হয়ে গেল আমার সঙ্গী।
নকুলকে পেয়ে আমার সুবিধেই হয়েছে। কথায় বলে, একা না বোকা! তা সত্যি একা থাকলে কেমন ভয় ভয় করে। তাছাড়া যত উদ্ভট অবাস্তব কল্পনা মাথায় খেলে বেড়ায়।
হ্যাঁ, উদ্ভট ভাবনা। নকুল আসার পর থেকে সেই পরলোকগত আত্মাগুলির নাম-পরিচয় বাছাই করার মতো পাগলামি বন্ধ ছিল। সেই অদৃশ্য আত্মাটিও আর উৎপাত করেনি। করবেই বা কী করে? চিরকালই তো শুনে আসছি একের বেশি মানুষ থাকলে আত্মাটাত্মা কাছে ঘেঁষে না। এই কথা ভেবে নিশ্চিন্ত আছি।
নকুল বেশ স্বচ্ছন্দেই আছে। বাড়ির সব কাজই করে। বলতে হয় না। তবে একটু বেশি উৎসাহী। তড়বড় করে ঝুল ঝাড়তে গিয়ে সেদিন একটা ছবির কাচ ভেঙে ফেলল। এসব ব্যাপারে সে মোটেই লজ্জিত নয়। আমিও কিছু বলি না। তবু তো বাড়িতে একটা সচল প্রাণী নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে।
প্রতিদিন ও কী দোকান-বাজার করল তার একটা ফর্দ দেয়। দুজন মানুষের সামান্য খরচ। তবু ও বোধ হয় নিজের সতোর প্রমাণ দেবার জন্যে নিজেই ফর্দ দেয়। আমি মোটামুটি চোখ বুলিয়ে নিয়ে হিসেব বুঝে নিই। একদিন দেখলাম ফর্দের তলায় লেখা ইঁদুর মারার ওষুধ।
আমার বাড়িটা পুরোনো হলেও আজ পর্যন্ত সাপ, বিছে, ব্যাঙ, ইঁদুরের উৎপাত হয়নি। তা হঠাৎ ইঁদুরের এমন উৎপাত হল–কী ব্যাপার?
আমি নকুলকে ডেকে জিগ্যেস করলাম, হঠাৎ ইঁদুর মারার ওষুধ? বাড়িতে ইঁদুর দেখা যাচ্ছে নাকি?
ও ওর স্বভাবমতো মাথা চুলকে বলল, আজ্ঞে না। ইঁদুর দেখা যায়নি বটে কিন্তু মাটি তুলছে খুব।
মাটি তুলছে মানে?
প্রায়ই দেখছি এখানে-ওখানে শুকনো মাটি পড়ে। কত পরিষ্কার করি বলুন তো?
বললাম, ইঁদুর মারার ওষুধে যদি মাটি ভোলা বন্ধ হয় তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু তুমি যা বলছ এখানে-ওখানে মাটি উঠেছে তাহলে তো অনেক গর্ত। গর্তগুলো দেখেছ তো?
নকুল বলল, ইঁদুর মারার ওষুধ খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দিলেই কাজ হয়। গর্তের খোঁজ করতে হয় না!
নকুল জিগ্যেস করল, তা হলে ইঁদুর মারার ওষুধ কিনব তো?
বললাম, না কিনে তো উপায় নেই।
ওষুধ কেনা হল। নকুল বঁট দিয়ে ইঁদুরের মাটিগুলো সাফ করে দিল।
তারপর সে ইচ্ছেমতো রুটির সঙ্গে হঁদুর মারার বিষ মিশিয়ে এমন করে যেখানে-সেখানে ছড়িয়ে দিল যে আমাকেই সাবধানে বারান্দায় চলাফেরা করতে হল। নকুল সদাজাগ্রত প্রহরীর পাহারা দিতে লাগল কখন ইঁদুর সেই রুটি খাবে। কিন্তু একটিও মরা ইঁদুর দেখা তো দূরের কথা, ধেড়ে ইঁদুর, নেংটি ইঁদুরও রুটি খেতে এল না।
শেষ পর্যন্ত নকুল হতাশ হয়ে বলল, ইঁদুরগুলোও এখন সেয়ানা হয়ে গেছে দাদা। অত রুটি ছড়িয়ে রাখলাম একটা ইঁদুরও ত্রিসীমানায় ঘেঁষল না।
বললাম, না ঘেঁষুক। মাটি উঠলে ঝাঁট দিয়ে ফেলে দিও। তা হলেই হবে।
নকুল কথা বাড়াল। চলে গেল।
মেঝেতে আর মাটি উঠেছিল কিনা জানি না, ও বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, তবে নকুল আর ঐ নিয়ে আমার কাছে ঘ্যানঘ্যান করেনি। কিন্তু লক্ষ করছি ও যেন দিন দিন কেমন গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। কথাবার্তা কম বলছে। ও কি কোনো কারণে আমার ওপর রাগ করেছে? জানি না। রাগ করার তো কোনো কারণ নেই। সকলেই জানে আমি কথায় বার্তায় খুব সংযত। কাউকে রূঢ় কথা কখনও বলি না।
একদিন আর থাকতে না পেরে ওকে ডেকে জিগ্যেস করলাম, নকুল, তোমার কি কিছু হয়েছে?
নকুল গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে জানাল, না।
তাহলে এত গম্ভীর কেন?
ও চুপ করে রইল।
বললাম, শরীর খারাপ?
ও আগের মতো মাথা নেড়ে জানাল, না।
তবে মন খারাপ?
এবার নকুল মাথা নাড়তে নাড়তে ভেতরে চলে গেল।
এই এক নতুন ভাবনা শুরু হল। নকুলের যে কিছু হয়েছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। কিন্তু কী হয়েছে তা ধরতে পারছি না। ভাবনা হল–যাও বা একটা ভালো সঙ্গী পেলাম তাও বুঝি আর টেকে না।
যাই হোক, আমি আর নকুলকে ঘাঁটালাম না; ও নিজের মতো করে যে কদিন কাজ করতে চায় করুক।
একদিন দেখলাম, দুপুরে যখন কাগজ পড়ছি, নকুল নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল। বললাম, কিছু বলবে?
ও মুখটা করুণ করে বলল, হ্যাঁ।
অভয় দিয়ে বললাম, বলো।