হঠাৎ এত কাল পর আমার বাড়িতেই এসব উপদ্রব কেন? কী চায়? এই চাওয়ার সঙ্গে এ বছর মে মাসে আমার যে বিপদের কথা–তার সঙ্গে কি কোনো সম্বন্ধ আছে?
আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম।
তৃতীয় যে ঘটনাটা মাত্র গতকাল ঘটল সেটা আরও সাংঘাতিক।
বিকেলে প্রায়ই আমি রাস্তায় একটা চক্কর দিয়ে আসি। খোলা জায়গায় নির্মল বাতাসে শরীর-মন জুড়িয়ে যায়। কাল আমি বাড়ির পিছনের গলি দিয়ে ফিরছিলাম। গলির বাঁ দিকে গৌর ঘোষের বিরাট নারকেল গাছের বাগান। সেই পথটুকু পার হচ্ছি হঠাৎ একটা গাছের ওপরে সরসর শব্দ হল যেন নারকেল পাতা খসে পড়ল। তারপরই হাওয়ার একটা জোর ধাক্কা। সঙ্গে সঙ্গে খুব চাপা গলায় কে যেন বলে গেল–আর মাত্র কিছু দিন। সঙ্গে সঙ্গে বাতাসও মিলিয়ে গেল।
আমি চমকে উঠলাম। প্রথমত যে ধাক্কা দিয়ে গেল তাকে দেখতে পেলাম না। হাত থেকে পেনটা পড়তে যতটুকু সময় লাগে তারও কম সময়ের মধ্যে শুধু একটা দমকা হাওয়া ঘুরপাক খেতে খেতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আর দ্বিতীয় যে জন্যে চমকে উঠলাম সেটা হচ্ছে কথাটা যে বলল তার গলাটা যেন চেনা চেনা অথচ কিছুতেই মনে করতে পারলাম না কার গলা। তবে এটা ঠিক, গলার স্বর যারই হোক সে অন্তত এখন জীবিত নয়।
এই শেষের ঘটনায় আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম এ কদিন যে সব অস্বস্তিকর অবস্থা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল–সত্যি, মিথ্যে, সন্দেহের দোলায় দোলাচ্ছিল এখন তার নিরসন হল। অর্থাৎ যা ছিল সন্দেহ আজ তা দূর হয়ে গিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিল–ব্যাপারটা নিছক মানসিক নয়। সত্যিই কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
কথাটা আমি মনে মনেই রাখলাম। কাউকে বললাম না। বললেই নানা রকম উপদেশ, পরামর্শ যা কোনো কাজে দেবে না। তার চেয়ে বরং ভেবে দেখতে হবে গলার স্বরটা কার হওয়া সম্ভব। আর সে এমন একজন যে এখন আর পৃথিবীতে নেই।
পৃথিবীতে নেই আমার জানাশোনা এমন বহু লোক বহুদিন আগে থেকে পরলোকগামী হয়ে আছেন। তার মধ্যে থেকে ঠিক এই কণ্ঠস্বরের মালিকটিকে খুঁজে বের করা কঠিন ব্যাপার। এ তো গোয়েন্দাগিরি নয়। তবু আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে।
কাজেই এখন আমার প্রথম কর্তব্য হল একান্তে বসে মৃত আত্মাদের বাছাই করে ফেলা।
কী ভাবে বাছাই করব?
প্রথমে যাদের কথা মনে পড়ে এমন মৃত ব্যক্তিদের একটা তালিকা করা। তারপর সেই লম্বা তালিকা থেকে দশ বছর কি তারও কিছু আগে যারা গত হয়েছে তাদের চটপট বাদ দেওয়া। কারণ এতদিনে তাদের পুনর্জন্ম হয়ে গেছে। এতে তালিকা একটু হালকা হবে।
এইভাবে মৃত আত্মাদের নামের ছাঁটকাট করা তালিকাটি নিয়ে কয়েকদিন পর নিরিবিলিতে একদিন বসলাম।
আমার বাড়ির পরিবেশ খুব শান্ত। কেননা আমি ঝাড়া-হাত-পা মানুষ। অর্থাৎ বিয়ে শাদি করিনি। আত্মীয়-স্বজনরা আমার খোঁজ-খবর রাখে না। তাই আমিও তাদের ত্রিসীমানায় ঘেঁযি না। বাড়িতে একাই থাকি। তবে সত্যি কথা বলতে কি মাঝে মাঝে বড্ড একা বোধ করি। বাড়িতেই থোক, বাড়ির বাইরেই থোক কথা বলার মানুষ চাই।
যাই হোক, সেদিন মৃত আত্মাদের তালিকা নিয়ে কাজ করতে করতে অনেক বেলা হয়ে গেল। হঠাৎ চমকে উঠলাম। কেউ একজন আমার বসার ঘরে ঢুকে পড়ার পর বলল, আসব স্যার?
.
০২.
তাকিয়ে দেখি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে উনিশ-কুড়ি বছরের একটি ছেলে দাঁত বের করে বোকার মতো হাসছে। প্রথম দর্শনে অবাক হয়েছিলাম। কেমন যেন চেনা চেনা মুখ। অনেক দিন আগে কোথায় যেন দেখেছি। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না।
বললাম–কী চাই?
ও কিছুমাত্র সংকোচ ন! করে বলল-ভাত খাব।
বলে একটু সলজ্জ হাসল।
আমি তখন ওকে বসিয়ে ওর খবরাখবর নিলাম। নাম নকুল। ওর মা-বাবা যখন মারা যায় তখন ওর বয়েস বারো। বাধ্য হয়ে ও ওর মামার কাছে চলে আসে। মামী প্রথমে এই বয়েসের পরের ছেলের দায়িত্ব নিতে চায়নি। শেযে মামা-মামী দুজনে ঠান্ডা মাথায় পরামর্শ করে ঠিক করল বাজার-দোকান করা, জল ভোলা, বাড়ি-ঘর পরিষ্কার করার মতো ভারী কাজগুলো একে দিয়ে করিয়ে নিলে মাইনে দিয়ে আর লোক রাখতে হবে না।
এই সুবুদ্ধি মাথায় উদয় হতেই মামা-মামী নকুলকে ঠাই দিলেন।
কিন্তু এই সুখ বেচারির বেশিদিন সইল না। মামা-মামীর নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে বাঁচল। তারপর নানা জায়গা ঘুরে খেয়ে, না-খেয়ে, অর্ধাহারে খোলা আকাশের নীচে দিনের পর দিন শুয়ে শেষে একদিন এখানে এসে হাত জোড় করে দাঁড়াল।
ওর কথা শুনে কেমন যেন মায়া হল। বললাম–শোনো, আমার বাড়িতে রাঁধার কেউ নেই। আমি নিজেও রাঁধতে পারি না। হোটেলে খাই। কাছেই হোটেল। তুমি ওখান থেকে খেয়ে নাও। বলে একটা দশ টাকার নোট আর কিছু খুচরো টাকা দিলাম। ও ফের হাত জোড় করে নমস্কার করে চলে গেল।
ভেবেছিলাম একেবারেই চলে গেছে। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরেই সে এসে হাজির। তাকে দেখে বেশ তৃপ্ত বলে মনে হল। বললাম, খেয়েছ?
ও ফের হাত জোড় করে বলল, অনেকদিন পর মাছভাত খেলাম। তিনবার ভাত নিলাম। বলে হাসতে লাগল।
বললাম, পেট ভরেছে তো?
হ্যাঁ–বলে মাথা দোলাল।
তারপর প্যান্টের পকেট থেকে তিনটে টাকা বের করে আমার টেবিলে রাখল। আমি অবাক হয়ে তাকালাম। ও বলল, এ টাকাটা লাগেনি।
তাই ফেরত দিচ্ছ?
আমার যতটুকু লাগার তাই নিয়েছি।