তবে কেন এই বছরে এই মে মাসটা পড়বার আগেই এত ভয়?
ভয়ের কারণ আছে।
মফঃস্বল শহর। বেশ আরামে থাকি। একলা মানুষ। এক-এক সময়ে খুব নিঃসঙ্গ লাগে– বিশেষ করে সন্ধেবেলাটা। কিন্তু কীই বা করতে পারি। ইচ্ছে করলেই তো যাকে তোক ডেকে বন্ধু পাতানো যায় না।
এ বাড়িতে আমি অনেক দিন আছি–অনেক দিন। তাই এ বাড়ির গলিঘুজি আমার নখদর্পণে। এ বাড়ির উঠোনের মাঝখানে একটা পুরোনো কুয়ো আছে। খুব দরকার পড়লে সেই জল তুলে ব্যবহার করি। জলটা ভালোই। কুয়োর গায়ে একটা নারকেল গাছ। তার পাশেই একটা পেঁপে গাছ। কুয়োতলা থেকে দুধাপ উঠলে একটা রক। একটা বাঁক ফিরে নেমে গেছে খিড়কির দরজার দিকে। বাইরে যাবার এই খিড়কির দরজাটা আমি বড়ো একটা খুলি না। ওটা খিল আঁটা থাকে।
সেদিন–সন্ধে তখনও হয়নি। পুরোনো এই বাড়িতে এরই মধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছে। কুয়োতলার অনেকখানি তফাৎ দিয়ে যাতায়াতের যে পথটা দোতলায় উঠে গেছে, আমি সেই পথ ধরে ওপরে ওঠার জন্যে যাচ্ছি, হঠাৎ মনে হল কুয়োতলায় অন্ধকারে গা মিশিয়ে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে।
নিশ্চয় চোর!
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম–কে ওখানে?
উত্তর দিল না। তবে ধীরে ধীরে খিড়কির দরজার দিকে চলে গেল।
মরুক গে। চলে তো গেছে।
নিশ্চিন্ত হয়ে ওপরে উঠছিলাম, মনে হল–তাই তো! চলে গেলে খিড়কির দরজা খুলেই তো যাবে। তা হলে দরজাটা বন্ধ করতে হবে। আর তা করতে হবে আমাকেই।
অগত্যা সেই অন্ধকারেই কুয়োতলাটা বাঁ দিকে রেখে রকের ওপর দিয়ে এগোতে লাগলাম। কেমন যেন ভয় করছিল। হাতে একটা লাঠি পর্যন্ত নেই। খিড়কির দরজার বাঁকে যদি চোরটা দাঁড়িয়ে থাকে!
কিন্তু উপায় নেই। খিল বন্ধ করতে যেতেই হবে। পায়ে কী ঠেকল। দেখলাম একটা শাবল। পরশু দিন কুয়োপাড়ে একটা বাঁশ পোঁতবার জন্যে মাটি খুঁড়ছিলাম। ভালোই হল। সেটা তুলে নিলাম। হাতে একটা কিছু রইল।
কুয়োতলা থেকে এগিয়ে উঁচু রকটা যেখানে তিনখানা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেছে খিড়কির দরজার দিকে–আমি সেদিকে গেলাম। এখানটায় যেন বড্ড বেশি অন্ধকার। কিন্তু উপায় কী। আমি আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম। কেবলই মনে হচ্ছিল অন্ধকারের মধ্যে থেকে এই বুঝি কেউ ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার ওপর।
ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল। তবু পালালে চলবে না। খিড়কির দরজায় খিলটা লাগাতেই হবে।
তাই অনেক চেষ্টা করে কথা বলতে গিয়ে কোনোরকমে একটা চাপা ভাঙা স্বর বেরিয়ে এল–ক্যা–? আর সেই সঙ্গে লোহার শাবলটা মাটিতে ঠুকে জানান দিলাম–জেনে রেখো আমার হাতে শাবল আছে।
যদি কেউ সাড়া দেয় তাই মিনিট দুই চুপ করে অপেক্ষা করলাম। তারপর মনে মনে জয় মা বলে এক লাফে খিড়কির দরজার কাছে।
না, কেউ কোথাও নেই।
বুঝলাম যে এসেছিল সুবিধে করতে না পেরে কেটে পড়েছে।
কিন্তু ব্যাপারটা যে এত সহজ নয় তা পরক্ষণেই খিল লাগাতে গিয়ে বুঝলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। দরজা তো খোলাই হয়নি। খিল তো ভিতর থেকে লাগানো।
বিশ্বাস হল না। পকেট থেকে দেশলাই বের করে জ্বালোম। যতবারই জ্বালি অমনি নিভে যায়। মন হল কেউ যেন খুব কাছে দাঁড়িয়ে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিচ্ছে। শেষে পাঁচবারের বার জ্বলল। অমনি ক্ষণিকের সেই আলোয় দেখলাম খিলটা যেমন অনেক দিন থেকে আঁটা তেমনিই আছে। কেউ খোলবার চেষ্টা মাত্র করেনি। মাকড়সার জালগুলো পর্যন্ত ছিঁড়ে যায়নি।
তা হলে কী প্রমাণিত হল?
হল এই –যাকে আমি স্বচক্ষে কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম–তারপর যে গটগট করে খিড়কির দরজার দিকে এগোচ্ছিল সে কিন্তু খিড়কির দরজা খুলে বেরিয়ে যায়নি। কারণ আমি নিজের চোখেই দেখেছি খিল বাড়ির ভিতর থেকে আঁটা।
তাহলে?
তাহলে যিনি ছিলেন তিনি শরীরধারীই হন কিম্বা দেহমুক্তই হন, বাড়ির মধ্যেই কোথাও রয়েছেন। কেমন করে বাড়ির ভেতরে ঢুকেছিলেন জানি না। তবে বেরোতে পারেননি। হ্যাঁ, বাড়ির ভেতরেই কোথাও রয়েছেন!
এ কথা মনে হতেই আমার মাথাটা ঝিমঝিম্ করে উঠল। কারণ তিনি যিনিই হন, এই বাড়িতে গোটা রাত্রি তাঁর সঙ্গে থাকা যাবে না।
থাকা যাবে না বললে কী হবে? না থেকে যাব কোথায়? আর সেই তিনি যে কোথায় গেলেন পরের দিন তন্ন তন্ন করে খুঁজেও হদিস করতে পারলাম না। অগত্যা সব কিছু ভগবান আর ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজের কাজকর্ম নিয়ে ভাবতে লাগলাম।
ভেবেছিলাম ঐ রকম ঘটনা আর ঘটবে না। কিন্তু
সেদিন সন্ধের সময় দোতলার ঘরে বসে লেখালিখির কাজ করছি, হঠাৎ মনে হল কেউ যেন নিঃশব্দে পিছনে এসে দাঁড়াল। শুধু দাঁড়িয়ে থাকা নয়, একদৃষ্টে যেন তাকিয়ে আছে পিঠের দিকে। সেই মুহূর্তে কী করব কিছুই ভেবে পেলাম না। উঠে পালাব সে উপায় নেই। অগত্যা টেবিলের নীচে ঘাড় গুঁজে রইলাম।
কতক্ষণ এইভাবে ছিলাম জানি না। এক সময়ে ঘাড় টন্টন্ করায় সোজা হয়ে বসলাম। জানলা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস এল এক ঝলক, সাহস করে পিছন ফিরলাম। কেউ নেই।
এখন কেউ নেই এ কথা যেমন সত্য, তেমনি একটু আগেও কেউ যে ছিল তাও সত্য। কিন্তু কে সে? কী চায়? কেনই বা আমার কাছে এসেছিল? এইসব চিন্তা আমায় বিভ্রান্ত করে তুলল। মন হল কদিন আগে কুয়োতলায় যাকে অস্পষ্ট দেখেছিলাম সেও কি তবে অশরীরী ছিল? কী সর্বনাশ!