আমার চোখ-মুখের যা অবস্থা–আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম কেউ ভালো করে নজর করলেই ধরে ফেলবে আমিই সেই।
হঠাৎ দেখলাম কয়েকজন লোক আমার দিকেই আসছে। কি করব–কোথা দিয়ে কেমন করে পালাব ভাবছি এমনি সময়ে কারেন্ট এসে গেল। আমি তাড়াতাড়ি লিফটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটু পরেই লিফট চালু হলো। আমি লিফটে উঠে পড়লাম। আমার সঙ্গে এবার উঠল আরও কয়েকজন ভদ্রলোক। সোজা চলে গেলাম ছতলায় পিসেমশাইয়ের নিশ্চিত হেপাজতে।
.
ঘটনাটা এখানেই শেষ হওয়া উচিত ছিল। তা যে হয়নি সে শুধু আমার কপালদোষে।
সাত দিন কেটে গেছে। এই সাত দিন ধরে শুধু একটা কথাই মনে হয়েছে– সে দিন অন্ধকার সিঁড়িতে যা দেখেছিলাম তা সবই কি ভুল? সেই যে সাহেব যার কপাল পর্যন্ত ঢাকা টুপি, হিংস্র ভয়ানক চোখ–সেই যে ঘাড়-কাৎ-করে-পড়ে-থাকা মৃতদেহ–সব ভুল?
শেষ পর্যন্ত আবার সেই সর্বনেশে কৌতূহল ঘাড়ে চেপে বসল। ঠিক করলাম আবার একদিন ঐ সিঁড়ি দিয়ে উঠব। দেখি তেমন কিছু চোখে পড়ে কিনা।
যেমনি ভাবা তেমনি কাজ।
আবার একদিন সেই সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। আজ লোডশেডিং নয়। চারিদিকে আলোয় আলো। লিফটও চলছে। কিন্তু আমি সিঁড়ি দিয়েই উঠতে লাগলাম।
সিঁড়ি আজও নির্জন। লিফট থাকতে কে আর কষ্ট করে সিঁড়ি ভাঙে। শুধু আমিই একা উঠছি। সিঁড়ির প্রতিটি বাঁকে আলো।
একতলা-দোতলা-তিনতলা করে উঠতে লাগলাম। পাঁচতলার কাছে যেতেই থমকে দাঁড়ালাম। কি করে, কেমন করে যেন মনে হলো এই সেই জায়গাটা। ভালো করে বোঝার জন্যে দেওয়ালটার দিকে এগোচ্ছি আর ঠিক তখনই সব আলো নিভে গেল।
আমি নিশ্চিত জানি এটা লোডশেডিং ছাড়া কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়, কিন্তু তবু কেন যেন সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এক মুহূর্তে মনে হলো আমি অন্ধকার সমুদ্রের মধ্যে দিশেহারা হয়ে দাঁড়িয়ে। আর ঠিক তখনই একটা কনকনে হাওয়া বদ্ধ সিঁড়িতে আর্তনাদ করে আছড়ে পড়ল। তারপরেই একটা বরফের মতো কঠিন ঠাণ্ডা হাত যেন আমার মুখটা চেপে ধরবার চেষ্টা করল। আমি চিৎকার করতে গেলাম, কিন্তু পারলাম না।
তারপর কি করে যে নিচে নেমে এসেছিলাম বলতে পারব না।
বাইরে তখন শেষ-পৌষের মিষ্টি রোদ ঝলমল করছে।
পরে পিসেমশাইয়ের কাছে শুনেছিলাম, আমি একাই নই–ঐ দৃশ্যটা আরও দু চারজন দেখেছে। তবে একটি বিশেষ দিনে, বিশেষ সময়ে। আমার দুর্ভাগ্য সেই বিশেষ দিন আর বিশেষ সময়েই আমি সেদিন অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলাম। কিন্তু পরের একদিনকার ঘটনাটা–ঐ যে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া, বরফের মতো ঠাণ্ডা হাত…ব্যাপার কী! না, বুদ্ধিতে সব কিছুর ব্যাখ্যা চলে না।
অভিশপ্ত ৩৭
০১.
সামনের মে মাসে আমার সাঁইত্রিশ বছর পূর্ণ হবে। এ কথা মনে করতেই ভয়ে গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। একটা অজানা ভয়ে গায়ে কাঁটা দেয় তার কারণ এই নয় যে, কোনো জ্যোতিষী আমার হাত দেখে মে মাসে আমার বিপদের কথা জানিয়েছেন। অন্তত আমার তা মনে পড়ে না। তবে
তবে আমার পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়েসের সময় থেকেই খুব অস্পষ্ট কিছু কিছু যেন চোখের সামনে ভেসে উঠতে চায়। যেমন–নির্জন দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সামনের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে অনেক অনেক দিন আগের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সাদা দেওয়ালে ভেসে ওঠে অস্পষ্ট একটা মানুষের চেহারা। সেই চেহারার মধ্যে গোটা মানুষটাকে বোঝা না গেলেও তার নাক চোখ মুখের গঠন যে বিকটাকৃতি ছিল তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। সেই মূর্তি হাত তুলে কাকে যেন কিছু বলছে। যাকে বলছে তার ছায়া এতটা অস্পষ্ট যে কিছুই বোঝা যায়নি।
দেওয়ালে সেই বীভৎস ছায়ামূর্তি দেখার পর থেকে আমার যেন কিছু মনে পড়তে লাগল। কিন্তু তা খুব অল্পক্ষণের জন্য। ফেনার বুদ্বুদ যেমন বাতাসে ভাসতে ভাসতে যায়, সেই রকমই মুহূর্তের জন্যে চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা বাড়ি। তারপরেই সেটা সরে যায়। দেখা দেয় একটা মৃতপ্রায় রোগী। সেই রোগী ভয়ে চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে খোলা জানলার দিকে। মৃতপ্রায় রোগীটি কী দেখছিল জানলা দিয়ে? ঘরে। একটা লণ্ঠন জ্বলছে। তারপরেই ভোজবাজির মতো সব অদৃশ্য।
যেসব কথা বললাম তা কিন্তু স্বপ্ন নয়। একটুও বানিয়ে বা বাড়িয়ে বলা নয়। যেটুকু দেখেছিলাম তাই লিখলাম। কিন্তু তার সঙ্গে আমার জন্মমাসের কী সম্পর্ক? ভয়ের কারণই বা কী ভেবে পাই না।
তারপর আমি পরের ঘটনাগুলো মনে করবার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাছিম যেমন মাঝে মাঝে তার শক্ত ভোলা থেকে একবার মুখ বার করেই খোলের মধ্যে আবার ঢুকিয়ে নেয়, তেমনি আমার স্মৃতিগুলোও একবার ফিরে এসেই পরক্ষণে দূরে মিলিয়ে যায়। মহা মুশকিল। জীবনের একটা সময়ে ভয়ংকর নিশ্চয় কিছু ঘটেছিল। কিন্তু কী ঘটেছিল তা আজ ঠিক মনে করতে পারি না। সেই সময়ের কটা মাস আমার কাছে একেবারে ব্ল্যাক আউট হয়ে গেছে।
এরকম হওয়ার কারণ সেই সময়ে আমি কঠিন ব্যাধিতে পড়েছিলাম। কয়েকদিন জ্ঞান ছিল না। ভগবানের দয়ায় চিকিৎসার গুণে আমি ভালো হয়ে উঠেছিলাম ঠিকই কিন্তু হারিয়ে ফেলেছিলাম আমার স্মৃতিশক্তি। অনেক চেষ্টায় স্মৃতিশক্তি ফিরল বটে কিন্তু অসুখের সময়ের স্মৃতি তেমন ফিরল না। তবে এতদিন পর এখন একাগ্র মনে ভাবতে থাকলে মাঝে মাঝে অস্পষ্ট কিছু মনে পড়ে। কিন্তু সাঁইত্রিশ বছরে পড়লেই ভয়ংকর কোনো ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে এমন সম্ভাবনার কথা কেউ সেদিন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল কিনা তা স্পষ্ট মনে পড়ে না।