দরকার নেই।
অগত্যা পবিত্র কবরগৃহে জুতো পরেই এগিয়ে চললাম। একটাই ভরসা–ফকিরের দেওয়া লোহার চিমটেটা আমার মুঠোয় শক্ত করে ধরা।
জেকব চারদিকে টর্চের আলো ফেলছে। হঠাৎ ও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
এ কী! এ ঘরে এত কবর!
আমিও অবাক হলাম। দুপাশে সাতটা মাঝারি সাইজের কবর।
কিন্তু তা তো হবার কথা নয়। জেকবের লক্ষ্য কোনো এক ফিরোজ শাহের কবর। তিনি সুলতান ছিলেন। প্রচুর ঐশ্বর্য। অত্যন্ত খেয়ালী। মরার আগে তিনি নাকি কোনো গোপন জায়গায় নিজের সমাধিঘর তৈরি করে রেখেছিলেন। সেখানে নিশ্চয় তিনি শুধুই রাজপোশাক পরে শুয়ে থাকবেন না। সঙ্গে সোনাদানা, ধনরত্নও থাকবে। আর নিশ্চয় সেই কবরগৃহ হবে তাঁর একারই।
তাই যদি হয় তাহলে এই কবরগুলো কাদের? তবে কি এটা সুলতান ফিরোজ শাহের কবর নয়?
জেকব যেন আমার মনের কথা টের পেয়ে বলল, এগুলো হয়তো তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের।
তাহলে সুলতানের কবরটা কোথায়?
জেকব চারদিকে টর্চের আলো ফেলতে লাগল। অন্ধকার এতই জমাট যে টর্চের আলো বেশিদূর যাচ্ছিল না। হঠাৎ চোখে পড়ল দেওয়ালের একদিকে প্রায় চার হাত উঁচুতে একটা ছোটো দরজা। আমরা তাড়াতাড়ি সেইদিকে এগিয়ে গেলাম। হ্যাঁ, দরজাই। তবে এটাকে দরজা না বলে একটা বড় জানালা বলা যেতে পারে। তবে জানালা নয়। জানালা হলে গরাদ থাকত। এতে দরজার মতোই মস্ত দুটো পেতলের কড়া লাগানো আছে। আর কড়া দুটো সিল করা। দরজার গায়ে ফারসীতে কী যেন লেখা আছে। অক্ষর উঠে গেছে। জেকব ভালো করে পড়তে পারল না। তবে সে নিশ্চিত এই ঘরেই সুলতান আছেন।
তখনই সে যন্ত্রপাতি দিয়ে সিল ভেঙে ফেলল। আমার বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল। স্পষ্ট অনুভব করলাম আমার পিছনে কারা যেন নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে। চকিতে পিছন ফিরলাম। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। শুধু একটা তপ্ত হাওয়া আমার শার্টটাকে দুলিয়ে দিয়ে গেল। এই বদ্ধ ঘরে হাওয়া কোথা থেকে আসবে তা বুঝতে পারলাম না। আমি চিমটেটা আরও শক্ত করে ধরলাম।
ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে বার কয়েক ঝকানি দিতেই দরজাটা খুলে গেল। মূর্খটা পকেট থেকে রিভলভার বার করে জুতো পায়েই ভেতরে লাফিয়ে পড়ল। বুঝল না কার জন্যে রিভলভার? কে আছে ঘরে? কে থাকতে পারে তাকে রিভলভার কিছু করতে পারে না।
আমিও টর্চ জ্বেলে ভেতরে ঢুকছিলাম। জেকব কড়া গলায় বললে, তুমি বাইরে থাকো। ডাকলে তবে এসো।
আমি যেন বেঁচে গেলাম। সেই কুঠুরির বাইরে দাঁড়িয়েই আমি ভেতরটা এক ঝলক দেখে নিলাম। সাজানো-গোছানো ঘর। দেওয়ালে দেওয়ালে ফারসীতে কোরানের বাণী। একটা উঁচু বেদীর ওপর স্থাপিত কষ্টিপাথরের মত চকচকে কালো পাথরের বিশাল একটা কবর। কবরের গায়ে নীল, সাদা, হলুদ, সবুজ মিনার কাজ। এ ঘরে ঐ একটিই কবর। কবরের দৈর্ঘ্য দেখলেই বুঝতে অসুবিধে হয় না এখানে যিনি শুয়ে আছেন তিনি লম্বায় ছয় ফিটেরও বেশি।
সমাধির ওপর টাঙানো রয়েছে সাদা সিল্কের সামিয়ানা। জীর্ণ, বিবর্ণ। চারটে লাল থামে সামিয়ানার চার কোণ দড়ি বাঁধা। ঝুলছে সোনার চেন।
লক্ষ্য পড়ল কবরের চারপাশে হাতির দাঁতের ক্যাশবাক্সের মতো বড় বড় বাক্স। দেখলাম জেকব একটা বাক্স ভেঙে ফেলল। তারপরে ভেতর থেকে বের করতে লাগল হীরে, পান্না, চুনি–রাশি রাশি।
তখনই গোটা তিনেক বাক্স ঝুলির মধ্যে ঢুকিয়ে নিল।
এবার সে উঠে একটা হাতুড়ি নিয়ে কবরটার দিকে গেল। ও যে কী করতে যাচ্ছে ভেবে শিউরে উঠলাম। অমন সুন্দর কারুকার্যকরা কবরটা ও হাতুড়ির গায়ে ভেঙে ফেলবে! তার নিচ থেকে টেনে তুলবে কফিন। ওর ধারণা কফিনের মধ্যে মৃতদেহ ধুলো হয়ে গেলেও নিশ্চয় আরো অনেক ধনরত্ন আছে।
জেকব কবরের গায়ে জোরে হাতুড়ির ঘা মারল। আমি সে দৃশ্য দেখতে পারলাম না। ওখান থেকে পিছিয়ে আগের ঘরে এসে দাঁড়ালাম।
অন্ধকার কবরের রাজ্যে একা দাঁড়িয়ে থাকা যে কী ভয়ঙ্কর তা যে কখনো দাঁড়িয়েছে। সে ছাড়া আর কেউ কল্পনা করতে পারবে না।
ওদিকে হাতুড়ির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। বুঝতে পারছি পাথরের কবর চৌচির হয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ হাতুড়ির শব্দ ছাপিয়ে কাচ করে একটা অস্বাভাবিক শব্দ। আমি চমকে উঠে সেইদিকে এগিয়ে গেলাম। দেখি যে ঘরে জেকব কবর ভাঙছিল সেই ঘরের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বিকট আর্তনাদ। তারপরেই হাড়-হিম-করা গোঙানি।
এ যে জেকবের গলা তা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হলো না।
কী হলো জেকবের?
আমি ছুটে গেলাম বন্ধ দরজাটার কাছে। প্রাণপণে ঠেলতে লাগলাম। কিন্তু দরজা এতটুকু নড়ল না।
আমি দরদর করে থামতে লাগলাম। কী করব এখন? কি করে জেকবকে বাঁচাব? আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম।
কিন্তু এভাবে এখানে যে একা দাঁড়িয়ে থাকা মোটেই ভালো নয় একথা মনে হতেই টর্চ জ্বেলে বাইরের দরজার দিকে ছুটলাম।
দেখি বাইরের দরজাটাও আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
আমি প্রাণপণে ছুটে যখন দরজার কাছে গেলাম তখন পাল্লা দুটো প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। কোনোরকমে কাত হয়ে আমি বেরিয়ে এলাম।
.
পুলিশকে খবর দেওয়া আমার উচিত ছিল। নইলে জেকবের মৃতদেহ খুঁজে পেলে পুলিশ আমাকেই ধরবে। ভাববে ধনরত্নের লোভে আমিই জেকবকে খুন করেছি।
কিন্তু থানা-পুলিশ করতে সাহস পেলাম না। সেই রাতেই মোহন মাণ্ডিকে সব কথা বললাম।